কুলজি

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:৪৪, ২১ আগস্ট ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

কুলজি মানুষের বংশানুক্রমিক ইতিহাস। শব্দটির উদ্ভব সংস্কৃত ‘কুলপঞ্জি’ (genealogy) থেকে। এতে  ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি বর্ণের ইতিহাস, প্রতিটি বর্ণের বংশ ও পরিবারসমূহের উৎকর্ষ-অপকর্ষ ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণনা থাকে। তাছাড়া এগুলিতে সামাজিক অনেক খুঁটিনাটি বিষয়েরও বর্ণনা থাকে। কুলজির বিধান অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট শ্রেণির মধ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধ, ভোজ্যান্নতা প্রভৃতি নির্ধারিত হয়। তাই এগুলিকে কুলশাস্ত্রও বলা হয়। কুলজিগুলি প্রাচীন বঙ্গের সামাজিক ইতিহাসসমৃদ্ধ। সামাজিক জীবনের শৃঙ্খলা ও নিষ্ঠা রক্ষার উদ্দেশ্যেই কুলজিগ্রন্থগুলি রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় রচিত অনেক কুলজিগ্রন্থ রয়েছে। এগুলির রচয়িতারা ঘটক নামে পরিচিত ছিলেন।

ঐতিহাসিকদের মতে, ষোল শতকের সামাজিক ও ঐতিহাসিক পটভূমিকায় কুলজি-সাহিত্যের উদ্ভব ঘটে। রামেশ্বরের শিবায়ন, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আঠারো শতকের মধ্যেই উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে কুলজি গ্রন্থে উল্লিখিত কৌলীন্য প্রথা দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে আঠারো শতকের পূর্বে কুলজিগ্রন্থ খুব বেশি রচিত হয়নি; আঠারো ও উনিশ শতকেই অধিকাংশ গ্রন্থ রচিত হয় এবং এ সময়ে পূর্বের রচনাসমূহেরও নানারূপ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধিত হয়।

কুলজিগ্রন্থের সংখ্যা অনেক। তার মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য এ তিন শ্রেণির গ্রন্থের সংখ্যাই অধিক। কয়েকটি প্রসিদ্ধ কুলজিগ্রন্থ হলো: হরিমিশ্রের কারিকা, এডুমিশ্রের কারিকা, ধ্রুবানন্দ মিশ্রের মহাবংশাবলী, নুলো পঞ্চাননের গোষ্ঠীকথা, বাচস্পতি মিশ্রের কুলরাম ও বরেন্দ্রকুলপঞ্জিকা, ধনঞ্জয়ের কুলপ্রদীপ, রামানন্দ শর্মার কুলদীপিকা, মহেশের নির্দোষকুলপঞ্জিকা, সর্বানন্দ মিশ্রের কুলতত্ত্বার্ণব, মালাধর ঘটকের দক্ষিণরাঢ়ীয় কারিকা, দ্বিজ বাচস্পতির বঙ্গজকুলজী, ভরত মল্লিকের চন্দ্রপ্রভা ও রত্নপ্রভা এবং কাশীরাম দাসের বারেন্দ্র-কায়স্থ-ঢাকুরি। এসব গ্রন্থে ব্রাহ্মণাদি বর্ণ ও তাদের শাখাসমূহের উদ্ভব ও বিস্তার, এ শাখাসমূহ থেকে উদ্ভূত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাগের মধ্যে পরস্পর আহার ও বৈবাহিক সম্বন্ধ প্রভৃতি বিষয় পরিচালনার জন্য উদ্ভাবিত রীতিনীতি ও প্রথাপদ্ধতির ধারাবাহিক ইতিহাস এবং উক্ত বিভাগসমূহের অন্তর্গত বিভিন্ন বংশ পরিবারের ও প্রধানদের কীর্তিকথা, কুলক্রিয়া ইত্যাদির পরিচয় বর্ণিত হয়েছে।

উচ্চ বংশাবলির পরিচয় বিধৃত কুলজিগ্রন্থ বিবাহকার্যে ঘটকদের জন্য অপরিহার্য ছিল এবং তাদের বংশধরেরা এগুলি রক্ষা করত। তবে ঘটকদের রচিত এসব কুলজিগ্রন্থের তথ্য সর্বাংশে নির্ভরযোগ্য বলে পরিগণিত হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল এবং স্বীয় প্রয়োজনে তারা তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়ে কিংবা ভুল তথ্য দিয়ে কুলজির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করত। এসব কারণে বেশির ভাগ গ্রন্থেরই প্রামাণিকতা নেই। তবে ভরত মল্লিকের চন্দ্রপ্রভা ও রত্নপ্রভা গ্রন্থদুটি পান্ডিত্যপূর্ণ ও ইতিহাস-প্রামাণ্য বলে প্রতীয়মান হয়।

বাংলায় বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত কুলজিগ্রন্থের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল, কিন্তু বর্তমানে তা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। অবশ্য পাশ্চাত্যে আঠারো শতক থেকে কুলশাস্ত্র উচ্চ পর্যায়ে অধ্যয়ন-অধ্যাপনার একটি আনুষঙ্গিক বিষয়রূপে পরিগণিত হয়েছে এবং তা সমাজতত্ত্ব, সুপ্রজননবিদ্যা (eugenics), ইতিহাস ও আইনবিদ্যার একটি সহকারী বিষয়রূপে বিবেচিত। [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]