কাঠঠোকরা

কাঠঠোকরা [ছবি: আমানুল হক]

কাঠঠোকরা (Woodpecker)  Piciformes বর্গভুক্ত Picidae গোত্রের মজবুত ও কাস্তে-সদৃশ ঠোঁট এবং বাইরে প্রক্ষেপযোগ্য জিহবাসহ লম্বাটে গড়নের পাখি। এদের অধিকাংশই বৃক্ষবাসী এবং তারা  কীটপতঙ্গ খোঁজার সময় বা খোড়ল খোঁড়ার জন্য দীর্ঘ নখরে বাকল অাঁকড়ে ধরে এবং লম্বা ও দৃঢ় পুচ্ছ দিয়ে শরীরের স্থিতিসাম্য রক্ষা করে। গোত্রটিতে প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ২০৪। বাংলাদেশের ২২ প্রজাতির কাঠঠোকরার মধ্যে ২১ প্রজাতি স্থায়ী বাসিন্দা এবং ১ প্রজাতি পরিযায়ী (সারণি)।

বৈজ্ঞানিক নাম ইংরেজি নাম ও  শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য স্থানীয় নাম.বিস্তার
Blythipicus pyrrhotis Bay Woodpecker/Redheaded Bay Woodpecker: দীর্ঘ ঠোঁট; গাঢ়-বাদামি ডোরাসহ শরীরের উপরের অংশ পিঙ্গল, পুরুষ পাখির ঘাড়ের পাশগুলি লাল। অল্পবয়সীদের ডোরাকাটা, পেটের দিকে অনেকগুলি রেখা। -- দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মিশ্র-চিরহরিৎ বন
Celus brachyurus Micropternus brachyurus) Rufous Woodpecker: খাট কালো ঠোঁট ও ঝাঁকড়া ঝুঁটি। শরীর প্রকট কালোদাগসহ লালচে-বাদামি থেকে বাদামি রঙের। পুরুষের কানের পালকের উপর লালচে কাঠঠোকরা সর্বত্র
Chrysocolaptes lucidus Greater Flameback  (Larger Goldenbacked Woodpecker):গলার পশ্চাদভাগ ও পিঠ সাদা বা সাদা-কালো দাগফুটকি, ঠোঁট আকারে বড় ও লম্বা। গোঁফেরদাগ স্পষ্টভাবে বিভক্ত। স্ত্রী পাখির চাঁদি ও ঝুঁটিতে উজ্জ্বল সাদা দাগ। -- --
Dendrocops atratus (Picoides atratus) Stripe-breasted Woodpecker (Stripe-breasted Pied Woodpecker): পিঠের দিকে সাদা ডোরা, পেটের দিক ডোরা-কাটা, গলা ও ঘাড়ের পাশে সাদা এবং পেটের দিকে আবছা সবুজ-হলুদ রঙের প্রলেপ, পিঠের উপরের দিকে সাদা দাগ নেই; ঠোঁট অপেক্ষাকৃত বড় ও পুরুষের কপাল বেশি লাল। -- দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল
Dendrocops canicapillus (Picoides canicapillus) Grey-capped Pygmy Woodpecker (Grey-crowned Pygmy Woodpecker) : খুব ছোট। চাঁদি ধূসর রঙের, চোখের ফালি কালচে, উপরের অংশও কালচে, পেটের দিক কালো ডোরাসহ কালচে পিঙ্গল। ধূসর-মাথা বামন কাঠঠোকরা সর্বত্র
Dendrocops hyperythrus (Hypopicus hyperythrus) Rufous-bellied Woodpecker  (Sapsucker): মুখমন্ডল সাদাটে ও পেটের দিক লালচে-বাদামি। ঘাড়ে সাদা ছোপ নেই। অপ্রাপ্তবয়স্কের পেটের দিকে দাগ থাকে। -- দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল
Dendrocops macei (Picoides macei) Fulvous-breasted Pied Woodpecker (Fulvous-breasted Pied Woodpecker): পেটের দিকে সাদা দাগ ও ছড়ানো লালচে ডোরা। পিঠের সামনের দিক। সচরাচর সাদা ডোরাকাটা। পাকড়া কাঠঠোকরা সর্বত্র
Dendrocops mahrattensis (Picoides mahrattensis) Yellow-fronted Pied Woodpecker: মাথা ও চাঁদির সামনের দিক হলদেটে, পেটের দিক সাদা দাগফুটকি, নাকের কাছের ফালিগুলি অস্পষ্ট মোটা ও ছড়ানো ডোরাসহ পেটের দিক ফ্যাকাসে, পেটের নিচের অংশে লাল রঙের ছোপ এবং লেজের মধ্যস্থলের পালকে সাদা দাগ। পাকড়া কাঠঠোকরা সর্বত্র
Dendrocops nanus (Picoides nanus) Brown-capped Pygmy Woodpecker (Pygmy Woodpecker): খুব ছোট; চাঁদি ও চোখের ফালি বাদামি; পেটের দিক বাদামি বা ধূসরাভ থেকে বাদামি-সাদা; লেজের মাঝখানের পালকে সাদা সাদা ফোঁটা। বন-কাঠঠোকরা সর্বত্র
Dinopium benghalense Black-rumped Flameback (Lesser Goldenbacked Woodpecker): চোখের ফালি ও গলা কালো, ডানার পালক দাগফুটকি ও পিছনের দিক কালো। কাঠঠোকরা সর্বত্র
Dinopium javanense Common Flameback (Indian Goldenbacked Threetoed  Woodpecker): আকারে ছোট, গলার নিচের দিক কালো; গলার মাঝখানের নিচে কালো ফোঁটার এলোমেলো রেখা। স্ত্রী পাখির ঝুঁটিতে সরু সাদা সাদা ফোঁটা। -- দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মিশ্র-চিরহরিৎ বন ও সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন
Dinopium shorii Himalayan Flameback (Himalayan Threetoed Goldenbacked Woodpecker): গলার পেছন নিরেট কালো; এলোমেলো সীমারেখাসহ গলার মাঝখানটা বাদামি-হালকা হলুদ। স্ত্রী পাখির ঝুঁটিতে সাদা সাদা ডোরা। -- দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মিশ্র-চিরহরিৎ বন
Gecinulus grantia Pale-headed Woodpecker: ফ্যাকাসে ঠোঁট, সোনালি-ধূসর সবুজ মাথা, প্রাথমিক পালকে বাদামি-হালকা হলুদ রঙের দাগ এবং পেটের দিক গাঢ়-লাল থেকে বাদামি। পুরুষ পাখির চাঁদির উপর উজ্জ্বল লাল-গোলাপি। -- দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মিশ্র-চিরহরিৎ বন
Hemicircus canente Heart-spotted Woodpecker: উন্নত ঝুঁটি; লেজ খুব ছোট। প্রান্তিক পালকের উপর সাদা-কালো দাগ। পুরুষ পাখির ঝুঁটি কালো, স্ত্রী-পাখির ঝুঁটি সাদা। -- দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল
Mulleripicus pulverulentus Great Slaty Woodpecker (Himalayan Great Slatyheaded Woodpecker): ধূসর রঙের লম্বা ঠোঁট; গলা ও লেজ লম্বা। পুরুষ পাখির নাকে গোলাপি-লাল ছোপ। -- দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মিশ্র-চিরহরিৎ বন
Picus canus Grey-headed Woodpecker (Blacknaped Green Woodpecker/Grey Woodpecker): সাদামাটা ধূসর মুখমন্ডল, ঘাড়ের পেছন ও নাক কালো এবং পেটের দিক সর্বত্র সমভাবে ধূসরাভ-সবুজ। -- দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মিশ্র-চিরহরিৎ বন
Picus chlorolophus Lesser Yellownape (Small Yellownaped Woodpecker): ঘাড়ের পেছনে হলুদ গুচ্ছ-পালক, মাথার উপর গাঢ় লাল ও সাদা দাগ, পেটের দিক ডোরা বা ফোঁটাযুক্ত। সাদামাটা ঝুঁটি ও ছোট ঠোটসহ ছোট আকারের পাখি। -- দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মিশ্র-চিরহরিৎ বন ও সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন
Picus flavinucha Greater Yellownape (Large Yellownape Woodpecker): ঘাড়ের পেছনে হলুদ গুচ্ছ-পালক, গলা হলুদ বা লালচে-বাদামি থেকে বাদামি, গলার পুরোভাগ ডোরাকাটা, পেটের দিক দাগহীন; দ্বিতীয় পর্যায়ের পালক লালচে-বাদামি। -- দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মিশ্র-চিরহরিৎ বন ও সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন
Picumnu innominatuss Speckled Piculet : আকারে ছোট, সাদাটে পেটের দিক কালো ফোঁটাযুক্ত, কানের পালকে কালো রঙের ছোপ ও ফালি এবং কালো রঙের লেজে সাদা ডোরা। পুরুষের কপালে কালো ডোরাসহ কমলা রঙের যা স্ত্রী পাখিতে নেই। ক্ষুদে কাঠঠোকরা দেশের উত্তর-পূর্ব বনাঞ্চল
Picus xanthopygaeus Streak-throated Woodpecker (Little Scaly-bellied Green Woodpecker): বুকের নিচের দিক, পেট ও কুক্ষির উপর অাঁশের মতো পালক। ঠোঁট কালো, গলা ও বুকের উপরিভাগ ডোরাকাটা এবং লেজে অস্পষ্ট দাগ। সবুজ কাঠঠোকরা সর্বত্র
Sasia ochracea White-browed Piculet (Rufous Piculet): আকারে খুব ছোট; পেটের দিক লালচে-বাদামি এবং চোখের পেছনে সাদা ভুরু। পুরুষ পাখির মাথার পুরোভাগে সোনালি-হলুদ রং যা স্ত্রী পাখিতে থাকে না। লাল-ক্ষুদে কাঠঠোকরা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চর্ল
Jynx torquilla  Eurasian Wryneck  (Wryneck): শীতকালে বহুদৃষ্ট। শরীরে ধূসর, হালকা হলুদ ও বাদামি রঙের জটিল নকশা। ঘাড় ও পিঠের নিচে কালো ফালি। লেজ লম্বা ও ডোরাকাটা। মেঠো কাঠঠোকরা সর্বত্র

চড়ুই থেকে কাকের আয়তন পর্যন্ত নানা আকারের কাঠঠোকরা আছে। শরীরের রং সাধারণত প্রকট–কালো ও সাদা বা জলপাই। মাথার উপরের কোনো কোনো অংশ প্রায়শই লাল দেখায়। এদের উড়াল গুরুভার ও তরঙ্গিত। এদের ঠোঁটের ঠোকরের আওয়াজ গানের মতোই মধুর শোনায়, বিশেষত বাসা বানানোর মরসুমে। সচরাচর বৃক্ষকান্ড খুঁড়ে বাসা বানায়, তাতে দুটি সাদাটে ডিম পাড়ে এবং সেখানে অন্য কোনো উপকরণ থাকে না। কোনো কোনো প্রজাতির কাঠঠোকরা ৮-১০টি ডিমও পাড়ে। নবজাত শাবকের শরীর উদোম থাকে। পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ই বাসা তদারক করে।

কাঠঠোকরা গাছের গুঁড়ি ও ডালে উঠে কাঠের পোকামাকড় ও গর্তবাসী শুঁয়াপোকা খুঁড়ে খুঁড়ে বেশির ভাগ সময় কাটায়। ছিদ্রকারী কীট ধরার মতো এদের আছে মোটা কাস্তের মতো ঠোঁট, নাসারন্ধ্রের উপর একগুচ্ছ পালক যা নাকে কাঠের গুঁড়া ঢুকতে দেয় না এবং গর্ত থেকে শুঁয়াপোকা টেনে তোলার মতো আগায় কাঁটাযুক্ত একটি লম্বা ও প্রক্ষেপযোগ্য জিহবা। ভিন্ন স্বভাবের অনেক কাঠঠোকরাও রয়েছে। ইউরোপের সবুজ কাঠঠোকরা (Picus viridis) ও আমেরিকার ফ্লিকার (Flicker, Colaptis rom) গাছ থেকে দূরে মাটির উপরের কীটপতঙ্গ খায় এবং দক্ষিণ আমেরিকার একটি প্রজাতি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত প্রান্তরে বাস করে, মাঠ থেকে কীটপতঙ্গ ধরে এবং মাটির ঢালের গর্তে বাসা বানায়। দক্ষিণ আফ্রিকার ভূতলবাসী কাঠঠোকরা (Geocolaptis olivaceus) একইভাবে বনাঞ্চল ছেড়ে খোলামাঠে বসবাস করে। কাঠঠোকরা গোত্রের একমাত্র সদস্য Wryneck গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায় না, প্রাকৃতিক গর্ত, কাঠঠোকরা বা বসন্তবৌরির পুরানো খোড়লকে বাসা হিসেবে ব্যবহার করে। [মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম]