কাঠ

কাঠ (Wood)  প্রধানত সেলুলোস (cellulose), হেমিসেলুলোস (hemicellulose) ও লিগনিন (lignin)-এ গঠিত বৃক্ষের অভ্যন্তরীণ অংশ। কাঠের গঠন উপাদানের মধ্যে উচ্চমাত্রায় (২২-২৯%) লিগনিন (lignin) থাকায় কাঠের দেহ অনবদ্য দৃঢ়তা পেয়েছে এবং তাতে কাঠকে বৃক্ষের অন্যান্য দ্রব্য থেকে স্বকীয়তা প্রদান করেছে। একটি গাছ যতই উচ্চতাবিশিষ্ট হোক না কেন কাঠ তাকে খাড়াভাবে থাকতে সাহায্য করে। কাঠকে মাটি থেকে পানি বহন করে গাছের উপরিভাগে সরবরাহ করতে হয়। কাঠের একটি নির্দিষ্ট স্থানে খাদ্য মজুদ থাকে যতক্ষণ না সে খাদ্য জীবন্ত গাছের প্রয়োজন হয়। গাছের ছালের নিকটবর্তী অংশে এক প্রকার হালকা রঙের কাঠ থাকে যাকে সরস বা কোমল কাঠ (sapwood) বলা হয়।

কাঠ

এ অংশও জীবন্ত কোষ দ্বারা গঠিত এবং গাছের জীবনচক্রে এর একটি সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। ক্যামবিয়ামের (cambium) পরেই এর অবস্থান। কোমল কাঠের স্তরের পুরুত্ব এবং এর মধ্যে বিদ্যমান গ্রোথ রিং (মৎড়tঃয ৎরহম)-এর সংখ্যার তারতম্য হতে পারে। কাঠের কেন্দ্রীয় অংশ সাধারণত তুলনামূলকভাবে শক্ত ও গাঢ় রং-এর হয় এবং এ অংশকে বলা হয় অন্তরকাঠ (heart wood)। কোমল কাঠের রিং-এর অভ্যন্তরে জীবন্ত কোষের পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নিষ্ক্রিয় কোষ (inactive cells) দ্বারা এ অংশ গঠিত। সম্ভবত প্রাণরস বহন ও সঞ্চারণ এবং অন্যান্য জীবন পদ্ধতিতে তাদের কার্যক্রম যখন বহুলাংশে কমে আসে তখন এ কোষ সৃষ্টি হয়। অন্তরকাঠ কাঠের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অংশ কারণ অনেক কোমল কাঠের তুলনায় অন্তরকাঠে সহজে পচন ধরে না।

কাঠের মৌলিক শক্ত গঠন কাঠকে বহুবিধ ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত গুণাবলী প্রদান করেছে। বাংলাদেশে  আসবাবপত্র, কেবিনেট, গৃহ,  নৌকা, জাহাজ, রেলওয়ে স্লিপার, বৈদ্যুতিক খুঁটি, জ্বালানি প্রভৃতি কাজে কাঠ ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়। [এম.এ সাত্তার]

কাঠসংরক্ষণ (Wood preservation)  রাসায়নিক দ্রব্যাদি প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে কাঠ, কাঠজাত  দ্রব্যাদি ও আসবাবের কাঠের ক্ষয়, পচন বা ক্ষতি রোধ। কাঠ সাধারণত ছত্রাক (সাদা পচন, বাদামি পচন ও কোমল পচন ছত্রাক),  কীটপতঙ্গ, ( উইপোকাবিটল, ঘুণপোকা), সামুদ্রিক এক ধরনের ঝিনুক এবং অন্যান্য নানা প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এমন কোনো একক সংরক্ষক নেই যা সংরক্ষণের সবগুলি চাহিদা মেটাতে পারে। কাঠসংরক্ষক হতে পারে তৈলজ, তরল বস্ত্ত অথবা একটি মিশ্রণ। ক্রিয়োসোট ও পেন্টাক্লোরোফেনল (PCP), তৈলজ জৈবসংরক্ষক একসময় বাংলাদেশে কাঠের খুঁটি, খাম্বা ও রেলওয়ে স্লিপার সংরক্ষণে ব্যবহূত হতো। আজকাল ক্রিয়োসোট শুধুই রেলওয়ে স্লিপার সংরক্ষণে ব্যবহূত হচ্ছে। জলজ অজৈব সংরক্ষক হিসেবে ক্রোমিয়ামযুক্ত তাম্র-আর্সেনেট টাইপ সি (CCA-C) বাংলাদেশে কাঠের বৈদ্যুতিক খাম্বা, নোঙর-বাঁধার খাম্বা ও কড়িকাঠে ব্যবহূত হয়ে থাকে। ক্রোমিয়ামযুক্ত তাম্র-বোরন (CCB) আরেকটি সংরক্ষক যা বৈদ্যুতিক মিটারবোর্ড, কাঠের প্যাকেজিং, দরজা, জানালা, আসবাবপত্র ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ সামগ্রীতে ব্যবহূত হয়। তৃতীয়টি হলো সংরক্ষক রং যা তৈল ও পানিযুক্ত এক ধরনের মিশ্রণ, যেমন ক্রিয়োসোটযুক্ত বোরন (HCR)।

সংরক্ষকে প্রক্রিয়াকৃত কাঠের জিনিসপত্রের আয়ু ব্যবহূত সংরক্ষকের কাঠের গভীরে প্রবেশ্যতা, রক্ষণশক্তি ও আটকে থাকার ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। তবে এগুলি সবই নির্ভর করে সংরক্ষণ পদ্ধতির ওপর। বাংলাদেশে ব্যবহূত বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে ধৌতকরণ, প্রলেপন, ছিটানো ও তরলে ডুবানো, ভিজানো, গরম-ঠান্ডা অবগাহ, ব্যাপনক্রিয়া ও চাপপ্রয়োগ। গোটা কোষের উপর চাপপ্রয়োগ সংরক্ষকের ভেদ্যতা বা রক্ষণক্ষমতার দিক থেকে সর্বোৎকৃষ্ট এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাংলাদেশে ব্যবহূত হয়। এ পদ্ধতিতে কাঠের অভ্যন্তর প্রথমে বায়ুশূন্য করে সংরক্ষক দ্রবণে চাপ দিয়ে তা কাঠের শূন্য কোষগুলিতে ভরাট করা হয়। বাংলাদেশে ভূমি ও পানির সংস্পর্শে থাকা কাঠসামগ্রী সংরক্ষণের জন্য CCA-C এবং সারকাঠ ও বাঁশসহ অভ্যন্তরীণ সামগ্রীর জন্য CCB সংবন্ধক দ্রব্য ব্যবহূত হয়।

কাঠ সিজনিং (Wood seasoning)  ভিজা বা কাঁচা কাঠ থেকে আর্দ্রতা অপসারণ অথবা কাঠ শুষ্ককরণ। আর্দ্রতা কাঠের অভ্যন্তরে মুক্ত পানি হিসেবে অথবা কোষপ্রাচীরে রাসায়নিকভাবে আবদ্ধ পানি হিসেবে থাকে। আর্দ্রতার পরিমাণ ৩০ শতাংশের বেশি হলে সে কাঠকে সাধারণত কাঁচা কাঠ বলা হয়।

কাঠ সিজনিং পদ্ধতিতে

সিজনিং বা টেকসইকরণে কাঠের গুণগত মান ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। উপযুক্ত সিজনিং কাঠের আয়ুষ্কাল বাড়ায় এবং ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও অণুজীবের আক্রমণ থেকে কাঠকে বাঁচায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সিজনিংয়ের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য বায়ু, বাষ্প ও পানি সিজনিং এবং বাষ্পীয়, রাসায়নিক, সৌরভাঁটি ও ভাঁটি দ্বারা শুষ্ককরণ আর বুলটন (Boulton) ড্রায়িং।

বায়ু সিজনিং পদ্ধতিতে কাঠ প্রাকৃতিক বায়ু ও তাপে খোলা জায়গায় বা ছায়ায় দীর্ঘ সময় রেখে দেওয়া হয়। এটি একটি চিরাচরিত পদ্ধতি এবং এতে বাংলাদেশের জলবায়ুতে ২৫ মিলিমিটারের অধিক চওড়া গোলাকার ও চেরাই কাঠ পুরো একটি শীত ঋতুসহ কমপক্ষে এক বছরের জন্য ফেলে রাখতে হয়। পাতলা কাঠ, তক্তা, বোর্ড, জ্বালানি কাঠ সাধারণত কেবল তাড়াতাড়ি শুকানোর জন্য সরাসরি রোদে রাখা হয়। অত্যন্ত টেকসই ও শক্ত কাঠের জন্যই বায়ু সিজনিং লাভজনক, পক্ষান্তরে পলকা কাঠ প্রায়ই ছত্রাক, পোকা ও মোল্ড (molds) দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং সমানভাবে সিজনিং সম্ভব হয় না। বাষ্পে শুকানো প্রক্রিয়ায় কাঠ বা কাঠজাত সামগ্রী বদ্ধ শোষণাধারে সিদ্ধ করে পরে বাতাসে শুকানো হয়।

বাষ্পে শুষ্ককরণ অপেক্ষা বাষ্প-ভ্যাকুয়াম প্রক্রিয়া উন্নততর, কেননা বাষ্পস্নানে উত্তপ্ত কাঠ থেকে বায়ু নির্গত হওয়ায় কাঠের আর্দ্রতা হ্রাস পায়।

পানিতে সিজনিং বাস্তবিক কোনো সিজনিং পদ্ধতি নয়, একটি দেশিয় পদ্ধতি মাত্র যা একটি প্রথা হিসেবে বাংলাদেশে প্রচলিত। এ পদ্ধতিতে কাঁচা কাঠ বা বাঁশ কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত পানিতে রেখে পরে বাতাসে বা চুল্লিতে শুকিয়ে ব্যবহার বা সংরক্ষণ করা হয়। পানি প্রয়োগের ফলে কিছু সঞ্চিত খাদ্যবস্ত্ত অপসৃত বা বিনষ্ট হয়, ফলে কাঠগুলি কীটপতঙ্গের আকর্ষণ হারায় এবং অধিক সচ্ছিদ্র হওয়ায় দ্রুত শুকায়।

সৌরভাঁটিতে শুকানোর পদ্ধতিতে কালো রঙের টিনের ছাদওয়ালা কাঁচের তৈরি একটি গ্রিনহাউজ সৌরতাপ আটকে রেখে একটি মোটর ফ্যানের সাহায্যে ওই ভাঁটি বা ঘরে গরম বাতাস সঞ্চালন করলে সেখানে রাখা পাতলা চেরাইকাঠ আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়। অতীতে বাংলাদেশে কড়ি বরগা, মিটার বোর্ড, তক্তা ইত্যাদি শুকানোর জন্য এ ধরনের ভাঁটি স্থাপন করা হতো, কিন্তু সেগুলি এখন আর ব্যবহূত হয় না।

ভাঁটিতে কাঠ শুকানোর প্রক্রিয়ায় তাপরোধক একটি বদ্ধ কক্ষে বা ভাঁটিতে উচ্চতাপ সৃষ্টিসহ আর্দ্রতা ও বায়ু প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। পদ্ধতিটি সর্বোৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত, কেননা এতে সমানভাবে এবং যথাসম্ভব দ্রুত কাঠ শুকানো যায়।

বাংলাদেশে কাঠের খুঁটি, নোঙর বাঁধার খুঁটি, দরজা-জানালা, আলমারি, আসবাবপত্র প্রভৃতি তৈরীর জন্য চেরাই কাঠ শুকাতে শুষ্ককরণ ভাঁটি বা সিজনিং ভাঁটি ব্যবহূত হয়। সাধারণত নরম ও পাতলা কাঠ সহজে ও তাড়াতাড়ি শুকায়, কিন্তু অপেক্ষাকৃত শক্ত ও ভারি কাঠ ধীরে শুকায়। বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন ছাড়াও কতিপয় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মালিকানায় খুলনা, চট্টগ্রাম, কাপ্তাই, ঢাকা, গাজীপুর ও শ্রীমঙ্গলে কাঠ শুকানোর ভাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।  [অরুণ কুমার লাহিড়ী]

কাঠের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ (pests of wood)  কতিপয় কাঠ ছিদ্রকারী পোকা সদ্য কাটা গাছ আক্রমণ করে এবং প্রায়শ কাঠের গভীর পর্যন্ত ছিদ্র বানায়। এ পোকা কাঠভুক নয়, তবে এদেরই তৈরি ছিদ্রের মধ্যে জন্মানো এম্ব্রোসিয়া নামক ছত্রাক এদের খাদ্য। এগুলির মধ্যে আছে Platypus, Crossotarsus, (Platypodidae: Coleoptera), Xyleborus ও Webbia (Scolytidae: Coleoptera) গণের প্রজাতিরা।

কাঠের পোকা

ঘুণপোকা, Heterobostrychus, Sinoxylon, Dinoderus) (Bostrychidae: Coleoptera) শুষ্ক কাঠ আক্রমণ করে। এগুলি শুধু শ্বেতসারপ্রধান কোমলকাঠ ছিদ্র করে এবং কাঠ ময়দার মতো মিহি গুঁড়োয় পরিণত হয়। Hoplocerambyx spinicornis ও Batocera (Cerambycidae: Coleoptera) নামের লম্বা অ্যানটিনাবিশিষ্ট কতিপয় বিটল কাঠের ভিতরে ছিদ্র করে এবং এ সুড়ঙ্গগুলি সাধারণত কাঠের গুঁড়োয় ভরে থাকে। কার্পেন্টার বী (Carpenter bee নামে পরিচিত Xylocopa (Xylocopidae: Hymenoptera) বাসা তৈরীর জন্য কাঠে সুড়ঙ্গ বানায়। বেশ কিছু প্রজাতির উইপোকা মাটিতে ফেলে রাখা, গুদামজাত অথবা ব্যবহূত হচ্ছে এমন কাঠ আক্রমণ করে প্রচুর ক্ষতি করে।

কাঠের পোকার ক্ষতিসাধন থেকে প্রতিরোধের উপায় কাঠে সংরক্ষণমূলক ঔষুধ প্রয়োগ, কীটনাশক ছিটানো, পালিশ লাগিয়ে ভৌত বাধা সৃষ্টি, কাঠ দ্রুত কেটে নিয়ে শুকানো, পানিতে জাগ দেওয়া, কীটপ্রতিরোধক কাঠ ব্যবহার ইত্যাদি। প্রতিষেধক হিসেবে বিষাক্ত গ্যাস ধোঁয়া প্রয়োগ, চুল্লিতে তাপের সাহায্যে ও ফ্রিজে শৈত্যের সাহায্যে নির্বীজন ইত্যাদিও যথেষ্ট কার্যকর। কতিপয় সামুদ্রিক আর্থ্রোপোড ও মোলাস্ক পোতাশ্রয়ের স্থাপনা, পাইলিং, নৌকা এবং লবণাক্ত পানিতে ভাসমান কাঠের ক্ষতিসাধন করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য gribbles, Limnoria spp (Crustacca), Teredo, এবং Bankia (Bivalvia: Mollusca)।  [এম ওয়াহিদ বখশ]

আরও দেখুন আসবাবপত্র; উইপোকা; দারুশিল্প