কাগজ

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৯:৫০, ৬ আগস্ট ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

কাগজ পাতলা পত্র বা লিখনের উপকরণ। কাগজ সৃষ্টি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে। বর্তমানে ব্যবহূত কাগজের আদি অবস্থায় বাঁশ, মালবেরি ও প্যাপিরাস গাছের বিশেষ ভূমিকা ছিল। প্রাচীন সভ্যতার উৎসভূমি চীন, মিশর প্রভৃতি দেশের ন্যায় বাংলায়ও দেশজ পদ্ধতিতে কাগজ তৈরির সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ছিল। তবে আবহাওয়াগত কারণে ও সংরক্ষণের অভাবে এখানে অতীত কালের কাগজের কোনো নমুনা পাওয়া যায় নি।

কাগজ কল

প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর ও টাঙ্গাইল-এ দেশিয় পদ্ধতিতে কাগজ প্রস্ত্তত করা হতো মেস্তা (এক প্রকার দেশি শণ) এবং  পাট গাছ থেকে। কয়েক প্রকার কাগজ প্রচলিত ছিল, তার মধ্যে আফসানি ও তুলোট কাগজ উল্লেখযোগ্য। তুলোট কথাটি সম্ভবত  তুলা থেকে এসেছে। কারণ তুলার মন্ড থেকে এক সময় কাগজ তৈরি হতো। আফসানি বা জার আফসান কাগজ ছিল স্বর্ণ বা রৌপ্য চূর্ণমিশ্রিত কাগজ। রাজা-বাদশাহরা এ কাগজ ব্যবহার করতেন। এক সময় পাটনা কাগজের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তাকে বলা হতো পাটনাই কাগজ।  উইলিয়ম কেরী যখন  শ্রীরামপুর মিশনে ছাপাখানা স্থাপন করেন তখন তিনি প্রথমে পাটনাই কাগজ ব্যবহার করতেন। পরে শ্রীরামপুরে কাগজ তৈরির কারখানা স্থাপিত হলে সকল গ্রন্থই সেখানকার কারখানায় প্রস্ত্তত কাগজে ছাপা হতো। সে সময় আমাদের দেশে তৈরি কাগজ শক্ত বা ক্যালেন্ডার করার জন্য ভাতের মাড় ব্যবহূত হতো। এতে কাগজে কীটপতঙ্গের সংক্রমণ ঘটত। কেরী সাহেব ভাতের মাড় ব্যবহার না করে অন্য উপায়ে কাগজ শক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। ১৮২০ সালে কাগজের মন্ড তৈরির জন্য শ্রীরামপুরেই সর্বপ্রথম বাষ্পচালিত ইঞ্জিন ব্যবহূত হয়েছিল। ব্রিটিশ ভারতে বেশ কয়েকটি উন্নতমানের কাগজকলের প্রতিষ্ঠা হয়, যেগুলির মধ্যে টিটাগড়ের কাগজকল ছিল প্রসিদ্ধ।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর চট্টগ্রামে  কর্ণফুলি নদীর তীরে সরকারি উদ্যোগে  কর্ণফুলি পেপার মিল, খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল ও পাবনায় নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল স্থাপন করা হয়। এ সকল কাগজকলে ব্যবহূত হয় যথাক্রমে  বাঁশসুন্দরবন এর গেওয়া কাঠ ও আখের ছোবড়া। সিলেটে প্রতিষ্ঠিত মন্ড মিলে ব্যবহূত হয় ঘাস। তবে অধিকাংশ তৃণক্ষেত্র ফসলের জমিতে রূপান্তরিত হওয়ার ফলে মন্ডমিলটি বর্তমানে বাঁশ ও শক্তকাঠ ব্যবহার করছে। পাটের আঁশ ব্যবহারের চেষ্টা করা হলেও তা পদ্ধতিগত কারণে ব্যর্থ হয়। মিলটি বিকল্প হিসেবে সোডা ব্যবহার করায় মন্ডের উৎপাদন ও গুণগত মান ক্রমান্বয়ে দুর্বল ও খারাপ হয়ে পড়ছে। সিলেট মন্ড ও কাগজ কলের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৩০,০০০ মেট্রিক টন।

খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল

বর্তমানে বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে ৫৫টি কাগজ কল রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সোনালি পেপার মিল, হাশেম পেপার ও পাল্প মিল, হোসেন পেপার মিল, সাদেক পেপার মিল, মাগুরা পেপার মিল, বেঙ্গল পেপার মিল, হাক্কানি পেপার মিল, টঙ্গী বোর্ড মিল, বসুন্ধরা পেপার মিল ইত্যাদি। এ সকল আধুনিক কাগজ তৈরির কারখানায় প্রধানত আমদানিকৃত রাসায়নিক মন্ড ব্যবহার করে উন্নতমানের কাগজ তৈরি করা হয়। আবার এখানে পুরাতন কাগজকে পুনরায় মন্ডে রূপান্তর করে কাগজ তৈরির ব্যবস্থাও রয়েছে। এ ছাড়া পাটের কাটিং ও শলা মন্ড তৈরির কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। এ সকল কাগজ কলে বছরে প্রায় ৫ লক্ষ ৫০ হাজার টন কাগজ উৎপন্ন হয়। সরকারি ও বেসরকারি কাগজের কলগুলি মিলে বাংলাদেশের বর্তমান চাহিদার (২০১০ সাল পর্যন্ত) মোট ৬০% পূরণ করতে পারে। বাকী ৪০% কাগজ বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়।

কাগজের প্রকৃতি, মান ও গুণের দিক থেকে কাগজকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে যেমন নিউজপ্রিন্ট, বুক পেপার বা প্রিন্টিং পেপার, লেজার কাগজ, কভার ও কার্ড বোর্ড। নিউজপ্রিন্ট কাঠের মন্ড থেকেই তৈরি হয়ে থাকে। সাধারণত পাইন, দেবদারু, হেমলক, ফার প্রভৃতি গাছের কাঠ থেকে এ মন্ড তৈরি হয়ে থাকে। আমাদের দেশে প্রধানত সুন্দরবনের গেওয়া কাঠ থেকে নিউজপ্রিন্টের মন্ড তৈরি হয়। ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস (বিবিএস) কাগজকে চারটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করেছে, যেমন লেখার কাগজ, ছাপার কাগজ, নিউজপ্রিন্ট এবং প্যাকেজিং জাতীয় কাগজ। বিবিএস-এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ১৫% লেখার কাগজ, ৩৫% ছাপার কাগজ, ৪০% নিউজপ্রিন্ট এবং ১০% প্যাকেজিং-এর কাগজ উৎপাদিত হয়। তবে, মন্ড, কাগজ ও কাগজকেন্দ্রিক দ্রব্যাদি উৎপাদনের এ হার স্থানীয় চাহিদার তুলনায় কম। বর্তমানে, বাংলাদেশে আমদানিকৃত মন্ড, বর্জ্য কাগজ, লেখার কাগজ, কাগজের বোর্ড ইত্যাদির ব্যয় বার্ষিক প্রায় ৪ বিলিয়ন টাকা।

নিউজপ্রিন্ট সবচেয়ে সস্তা এবং কম টেকসই। দীর্ঘকাল সংরক্ষণের জন্য কোনো কিছু এ কাগজে ছাপানো সঠিক নয়। কিছুদিন পর এর রং লালচে হয়ে যায় এবং এটি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। নিউজপ্রিন্ট বা কাঠের মন্ডে রেজিন-এর পরিমাণ বেশি থাকে যা আলো বাতাসের সংস্পর্শে অক্সিডাইজড হয়। ফলে যত দিন যায় কাগজ তত লালচে হয়ে পড়ে ও ভঙ্গুরতা লাভ করে।

বই ছাপার কাগজ বা প্রিন্টিং পেপার বহু প্রকারের হয়। সচরাচর ব্যবহূত কাগজ হচ্ছে মেশিন ফিনিশ বা এমএফ কাগজ, সুপার ক্যালেন্ডার কাগজ, অ্যান্টিক ফিনিশ কাগজ এবং কোটেড বা আর্ট পেপার। এমএফ কাগজ হচ্ছে বই ছাপার সাধারণ কাগজ যা সাদা, নরম এবং কিছুটা মৃদু উজ্জ্বলতা বহন করে। কম স্ক্রিনের হাফটোনসহ সবধরনের টাইপ মুদ্রণের জন্য এ কাগজ বেশ ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়। সুপার ক্যালেন্ডার কাগজ প্রকৃতপক্ষে এমএফ কাগজকে আরও শক্ত ও পিচ্ছিল করে তৈরি করা হয়। এ কাগজে কোনো প্রকার ক্যালেন্ডারিং হয় না। সাধারণত পুরাতন স্টাইলের ব্যবহার করে যেসব বই ছাপা হয় তার জন্য এ কাগজ বেশি উপযোগী। র‌্যাগ মন্ড থেকে অ্যান্টিক কাগজ তৈরি হয় বলে দীর্ঘসময় এর শুভ্রতা ম্লান হয় না। এতে লাইন এনগ্রেভিং ও টাইপ ছাপা খুব ভালো হয়। তবে এটি হাফটোন ব্লকের জন্য উপযুক্ত নয়।

যে কাগজ যত অস্বচ্ছ, মুদ্রণের জন্য সে কাগজ তত ভাল। স্বছতা কমিয়ে আনার জন্য কাগজকে পুরুভাবে তৈরি করা যেতে পারে অথবা কাগজের মন্ডে কিছু অস্বচ্ছ উপাদান যেমন চীনামাটি মিশিয়ে দিতে হয়। অস্বচ্ছ উপাদান মিশ্রণকে বলা হয় লোডিং। এরপর কাগজকে যখন খুব ভালভাবে মসৃণ বা ক্যালেন্ডার করা হয় তখন তা আর্ট কাগজ বা কোটেড কাগজে উন্নীত হয়। খুব সূক্ষ্ম স্ক্রিনের হাফটোন অথবা খুব ক্ষুদ্র টাইপ বা সূক্ষ্মরেখা প্রভৃতি মুদ্রণে আর্ট কাগজের প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি।

বিলেতি হিসাবে কাগজ মাপা হয় ৫০০ শিটের এক রিম কাগজের ওজনের ভিত্তিতে, ডবল ডিমাই ২৩ × ৩৬ সাইজের ৫০০ শিটের এক রিম কাগজের ওজন ৩৬ পাউন্ড অথবা তার চেয়ে মোটা ৪২ পাউন্ড কাগজ। এ ভিত্তিতে দুটি ভিন্ন মাপের কাগজ যেমন, ডবল ডিমাই ও ডবল ক্রাউন যে গুণগত দিক থেকে একই তা বোঝা যায় না। সেজন্য জিএসএম পদ্ধতি নামে আর একটি মাপ প্রবর্তিত হয়েছে। জিএসএম অর্থ প্রতি বর্গমিটারে কত গ্রাম কাগজ বিদ্যমান, যেমন ৭০ বা ৮০ জিএসএম হচ্ছে প্রতি বর্গমিটারের ওজন ৭০ বা ৮০ গ্রাম। ৮০ গ্রাম কাগজ ৭০ গ্রামের কাগজের চেয়ে ভারি বা পুরু।

আরেক প্রকার কাগজের মাপের প্রচলন আছে যার উদ্ভাবন হয় জার্মানিতে। একে বলা হয় ডিআইএন সিরিজের কাগজের মাপ। DIN বলতে বোঝায় Deutsche Industrie Normen। এ সিরিজের কাগজের বৈশিষ্ট্য এ যে, ভাঁজ করলেও এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত সব সময় একই থাকে।  [ফজলে রাবিব]