কক্সবাজার

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৫:২১, ১৭ জুলাই ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ বেলাভূমি, উচ্ছ্বসিত সমুদ্রতরঙ্গ, দিগন্তপ্রসারী ঝাউবন, উচু পাহাড়ের চূড়া, সুদৃশ্য প্যাগোডা, বৌদ্ধ মন্দির ইত্যাদি নিয়ে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। ইংরেজ ক্যাপ্টেন মি. হেরাম কক্স (Captain Hiram Coxs)-এর নামানুসারে এ জায়গার নামকরণ হয় কক্সবাজার। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার। মুদ্রের তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা সংরক্ষিত বনভূমি সমৃদ্ধ ৯৬ কিলোমিটার পাহাড়ের সারি এখানকার অন্যতম বিরল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বলে বিবেচিত। সমুদ্রতট ঘেঁষে গড়ে উঠেছে কটেজ, মোটেল এবং হোটেল রেস্তোরাঁ। চট্টগ্রাম থেকে সড়ক পথে বাস, কোস্টার ও বিলাসবহুল যান কক্সবাজারে চলাচল করে।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

সমুদ্র সৈকতের পথ ধরে ১০-১২ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে হিমছড়ি পিকনিক স্পট। এখানকার ঝর্ণা, ঝাউবন, পাহাড় আর বনানীর সৌন্দর্য্য চিত্তাকর্ষক। কক্সবাজারের সন্নিকটেই বৌদ্ধ তীর্থস্থান রামু। এখানে রয়েছে অনেকগুলো মন্দির ও প্যাগোডা। ছড়িয়ে আছে বৌদ্ধ ধর্মের নানা নিদর্শন। রামু বুদ্ধের অনেক স্মৃতিকে সযত্নে ধারণ করেছে। এখানকার রাবার চাষ প্রকল্পটি দর্শনীয়। কক্সাবাজারের বিপরীতে বঙ্গোপসাগরের বুকে একটি আকর্ষণীয় দ্বীপের নাম সোনাদিয়া। এটি অতিথি পাখিদের স্বর্গরাজ্য। শীতকালে পৃথিবীর নানা স্থান থেকে উড়ে আসে অতিথি পাখিরা। ট্রলার কিংবা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সেখানে যেতে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। সোনাদিয়া দ্বীপের আয়তন ৪৬৩ কিলোমিটার। এখানে ঝিনুক মুক্তা আর শামুকের ছড়াছড়ি। সকালে গিয়ে বিকেলেই ফিরে আসা যায় কক্সবাজার।

কক্সবাজারের উত্তর-পশ্চিমে সমুদ্র মাঝে রয়েছে মহেশখালী দ্বীপ। কক্সবাজার শহরের কস্তরীঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ট্রলার, লঞ্চ ও স্পিড বোটে মহেশখালীতে যাওয়া যায়। এই দ্বীপের ছোট পাহাড় ও অরণ্যে পাখির কলকাকলি, বন্যপ্রাণীর বিচরণ আর পাহাড়ের চূড়ায় আদিনাথ মন্দিরের শোভা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। মহেশখালীর প্রধান আকর্ষণ এই মন্দির বঙ্গোপসাগরের মোহনার সন্নিকটে একটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত। কয়েকশ বছর আগে তৈরি এই মন্দিরে উঠতে ৬৯টি সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়। এটিকে শিব মন্দিরও বলা হয়। প্রতিবছর শিবরাত্রির পর মন্দিরকে কেন্দ্র করে মেলা বসে। এই মেলা সাত-আট দিন ধরে চলে। মহেশখালীর পাহাড় আর অরণ্যে রয়েছে নানা বন্য প্রাণী। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে এই দ্বীপ। দ্বীপের জেলেপাড়ায় গেলে দেখা যাবে শুটকি মাছের প্রাচুর্য। মহেশখালী মিষ্টি পান ও সুপারীর জন্যও বিখ্যাত। সাগরপাড়ে রয়েছে অসংখ্য শামুক ও ঝিনুক। নিকটস্থ দোকানে বিক্রি হয় ঝিনুক ও শামুকের মালা।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

কক্সবাজার থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে বাংলাদেশ-মায়ানমার (বার্মা) সীমান্তে আরেকটি আকর্ষণীয় স্থান টেকনাফ। টেকনাফ বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্তে নাফ নদীর তীরে অবস্থিত একটি ছোট্ট শহর। কক্সবাজার থেকে বাস কিংবা কোস্টারে টেকনাফ যাওয়া যায়। নাফ নদীর তীরে দাঁড়ালে দেখা যায় ওপারের মায়ানমারের মংড়ু শহর। টেকনাফে মগ ও চাকমা উপজাতিদের ফল-ফলাদি বিক্রি করতে দেখা যায়। বাড়িঘর সবকিছুতে বর্মী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যাতায়াত পথে চোখে পড়বে নয়নাভিরাম দৃশ্য। নাফ নদীর পাড় দিয়ে রাস্তা। পাশে পাহাড়, ঝর্ণা এবং পাহাড়ের মাথায় অরণ্য। থাকার জন্য এখানে রয়েছে ডাকবাংলো এবং আবাসিক হোটেল।

টেকনাফ থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে সমুদ্রের বুকে জেগে উঠা প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনস। এই প্রবাল দ্বীপে জাহাজ এবং ট্রলারে যাওয়া যায়। এই দ্বীপের স্থানীয় নাম নারকেল জিঞ্জিরা। টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনসে যেতে সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা পেরিয়ে যাওয়া রীতিমত রোমাঞ্চকর। এই দ্বীপে প্রচুর নারকেল গাছ দেখতে পাওয়া যায়। একদা আরবীয় বণিকরা ব্যবসাবাণিজ্য করতে এসে এখানে বিশ্রাম নিতো। বাংলা, আরাকান ও বার্মা ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে চলে আসার পর জনৈক ইংরেজ মি মার্টিনসের নামানুসারে এই দ্বীপের নাম হয় সেন্ট মার্টিনস। এখানে প্রচুর কেয়া গাছ চোখে পড়ে। বসবাসরত কয়েক হাজার লোকের প্রধান জীবিকা মৎস্য শিকার। এই দ্বীপটির চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র সৈকত। দ্বীপটির আয়তন ৯ বর্গ কিলোমিটার। সুউচ্চ টাওয়ারের চুড়ায় রয়েছে সার্চ লাইট। দ্বীপের যেদিকে যাওয়া যায় চোখে পড়বে ছোট বড় অসংখ্য প্রবাল। এখানে রয়েছে শামুক, ঝিনুক, চুনাপাথর, শৈবাল আর মুক্তার প্রাচুর্য। তাল ও নারকেল গাছ ছাড়াও প্রবাল দ্বীপে রয়েছে আরও অন্যান্য উদ্ভিদ।

এখানকার নির্জন সমুদ্র সৈকত, জেলে নৌকার ব্যস্ত আনাগোনা, ঢেউয়ের উঠানামার মধ্যে উদ্ভাসিত প্রবাল রাজ্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে। সৈকত বরাবর চোখে পড়ে জেলেদের বস্তি। সকাল-সন্ধ্যা মাছ ধরার ব্যস্ততা। দূর সমুদ্রে ভাসে মাছ ধরার ট্রলার, পালতোলা জেলে নৌকা। দমকা হাওয়ায় নারকেল জিঞ্জিরার নারকেল গাছের শাখায় শোঁ-শোঁ করে শব্দ হয়। অনেক সময় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আর ঝড়ে ধ্বংস হয়েছে এ জনপদ, তবুও তার সৌন্দর্য্য অমলিন।

সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ

সেকালে টেকনাফে নলকূপ ছিল না। কারণ টেকনাফের ভূগর্ভে রয়েছে পাথরের আস্তর। মাটি খুড়লেই পাথরের পর পাথর। একালেও তাই নলকূপের সংখ্যা অনেক কম। গোটা টেকনাফে ছিল তখন একটি মাত্র পাতকুয়া আর সেটি ছিল টেকনাফ থানার আঙ্গিনায়। লোকজন সেই পাতকুয়ার পানির উপরই নির্ভরশীল ছিল। এলাকার লোক সেই পাত কুয়া থেকেই পানি সংগ্রহ করতো।

টেকনাফের বড় আকর্ষণ মাথিনের কুপ। মগ রাজকন্যা মাথিন আর পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য্যের বিয়োগান্ত প্রেমের স্বাক্ষর হয়ে রয়েছে এই কূপ। ধীরাজ ভট্টাচার্যের সাথে মগরাজার অপূর্ব সুন্দরী কন্যার প্রেমের কাহিনী কোনো গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। প্রতিদিন পড়ন্ত বিকেলে বান্ধবীদের নিয়ে কুপ থেকে পানি আনতে যেত সুন্দরী মাথিন। মুখে চন্দন। মাথায় খোঁপা। পরনে থাকত নানা রঙের থামি। গলায় থাকত মালা। এ সময়ে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন যশোরের সুদর্শন যুবক ধীরাজ ভট্টাচার্য। এক সময় ধীরাজ বাবু ও মাথিনের মধ্যে গড়ে উঠে ভালোবাসার সম্পর্ক। রাজকন্যা মাথিন মগসম্প্রদায়ভুক্ত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আর ধীরাজ ভট্টাচার্য হিন্দু সম্প্রদায়ের। সম্প্রদায়গত কারণে বাঁধা থাকলেও রাজা এ বিয়েতে রাজি হন। কিন্তু ধীরাজের বাবা ঘটনা জানতে পেরে ছেলেকে জরুরি চিঠি মারফত ডেকে পাঠান। ধীরাজ যেদিন কলকাতার উদ্দেশ্যে জাহাজে পাড়ি জমান সেদিন থেকে প্রেমিকা মাথিনের প্রতীক্ষা শুরু হয়। কিন্তু ধীরাজ আর ফিরলেন না। প্রেমিক হারানোর ব্যথায় রাজকুমারী খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে শয্যাশায়ী হলেন। মগরাজা তার একমাত্র কন্যাকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। কিন্তু রাজপরিবারের লোকজন শত চেষ্টা করেও মাথিনের মুখে এক ফোটা পানি পর্যন্ত দিতে পারলেন না। মাথিনের অবস্থা যখন সঙ্কটাপন্ন তখন কলকাতা থেকে ধীরাজকে আনারও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। রাজকুমারী মাথিন অনাহারে থাকতে থাকতে এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। লেখক ধীরাজ ভট্টাচার্যের যখন পুলিশ ছিলাম উপন্যাসে এই ঘটনার বিবরণ আছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশ কুয়াটির পাশে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেছে।   [মোফাজ্জল হোসেন]