উৎসব

উৎসব আনন্দ প্রকাশ ও লাভের মাধ্যম, এক কথায় যাকে বলা যায় আনন্দানুষ্ঠান; ইংরেজিতে একে ‘এ জয়ফুল অব অনারিফিক সেলিব্রেশন’ বলে সংজ্ঞায়িত করা যায়। উৎসব পরিবারকেন্দ্রিক হতে পারে, আবার ব্যাপকভাবে সমাজকেন্দ্রিকও হতে পারে। কালের বিবর্তনে এসব উৎসবের কোনোটির রূপ বদলায়, কোনোটি বিলুপ্ত হয়, আবার কোনোটি নতুন সৃষ্টি হয়। উৎসবসমূহের কোনোটিতে থাকে সমাজ ও জাতীয়তার ছাপ, কোনোটিতে ধর্মের ছাপ, আবার কোনোটিতে থাকে রাজনীতির ছাপ। আদিম সমাজে মানুষের খাদ্যকামনাকে কেন্দ্র করে যে উৎসবের শুরু হয়েছিল, আজ তা নানা বর্ণ ও বৈচিত্র্যে পূর্ণ। তবে সব অনুষ্ঠানের মূলেই রয়েছে আনন্দ লাভ।

উৎসবের মূল ভিত্তি এবং অধিকাংশ প্রাচীন আচার অনুষ্ঠানই যৌথ কর্ম। মানুষের প্রধান কর্ম কৃষির সঙ্গেও যোগ ছিল অনেক অনুষ্ঠান বা উৎসবের এবং সেসব নিয়ন্ত্রিত হতো চান্দ্রমাস দ্বারা। প্রাচীনকালের আচার অনুষ্ঠানগুলি ছিল অতিপ্রাকৃতিক শক্তিকে বশে আনার এক ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া; পরবর্তীকালের সংস্কৃতিতে তার চারিত্রিক উপাদান রয়ে গেছে। প্রাচীনকালের কৃষিভিত্তিক উৎসবগুলি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, যা পরবর্তীকালে অনেক আনুষ্ঠানিক হয়ে ওঠায় তার স্বতঃস্ফূর্ততা হারায়।

এখানে যেসব উৎসব আলোচিত হবে সেগুলির সঙ্গে ধর্মের যোগ থাকলেও মূলত সেগুলি ধর্মীয় কারণে উদ্ভূত হয় নি, হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবেই; পরে সেগুলি আনুষ্ঠানিক উৎসবে পরিণত হয়। যেমন মুসলমানদের ঈদে কয়েক বছর আগেও গান-বাজনা ছিল একটি প্রধান উপাদান যা স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতীক। কিন্তু বর্তমানে তা লোপ পেয়েছে। তবে বর্তমানে এসব উৎসব অনেকটা ফর্মাল হলেও কখনও কখনও তা কেবল ধর্মীয় মাত্রায় আবদ্ধ থাকে না; হয়ে ওঠে সামাজিক কর্মকান্ড এবং যোগাযোগের মাধ্যম।

বাংলাদেশে প্রচলিত ধর্মীয় উৎসবগুলির উৎস প্রাচীনকালের লোকবিশ্বাস, পরে ধর্ম সেগুলিকে ফর্মাল করেছে। এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের ঈদ ও মুহররম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; সে সঙ্গে রমজানের কথাও বলা যেতে পারে। কালে কালে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসংস্কৃতি এসবের ওপর প্রভাব ফেলেছে এবং তাতে বদল হয়েছে ধর্মের শুদ্ধ রূপেরও, যে কারণে বাংলাদেশের মুসলমান ও মধ্যপ্রাচ্য বা ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনচর্চা এক নয়।

বাংলাদেশের মুসলমানদের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে  ঈদুল ফিত্‌র ও  ঈদুল আযহা। রমজান শেষে ঈদুল ফিত্র পালিত হয়। ঈদের সামাজিক অর্থ উৎসব, আর আভিধানিক অর্থ পুনরাগমন বা বারবার ফিরে আসা। অন্যান্য সামাজিক উৎসবের মতো ঈদও বারবার ফিরে আসে। একই কথা প্রযোজ্য ঈদুল আযহা ও হজ্জ সম্পর্কেও।

আদি যুগে এ দুটি উৎসব পালনে কৃষিজীবী মানুষের লোকায়ত বিশ্বাসের প্রভাব ছিল, পরে কিছু ধর্মীয় রীতি-নীতি যুক্ত হয়। বর্তমানে উৎসব দুটি যতটা গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হচ্ছে, আগে সেভাবে হতো না; কারণ তখন ঔপনিবেশিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ছিল, সে সঙ্গে ছিল জনগণের দারিদ্র্য এবং ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা।

মুগল যুগে ঈদের দিন যে হৈ চৈ বা আনন্দ হতো তা বহিরাগত উচ্চপদস্থ এবং ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ছিল ব্যবধান। তবে মুগলরা যে ঈদের গুরুত্ব দিতেন তা বোঝা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শাহী ঈদগাহর ধ্বংসাবশেষ দেখে।

উনিশ শতকের শেষ দিকে ঈদের আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে যুক্ত হয় একটি নতুন উপাদান লোকায়ত মেলা। সে ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে এবং বর্তমানে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কমপক্ষে বারোটি মেলার আয়োজন করা হয়। বিগত একশ বছরে বাঙালি মুসলমানরা যেভাবে ঈদ পালন করতেন তার বিবরণে দেখা যায়, ঈদ উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ ছিল বিশেষ ধরনের খাওয়া-দাওয়া। মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের খাবারের মধ্যে থাকত কোরমা-পোলাও, ঘরে প্রস্ত্তত নানা রকমের পিঠা, সেমাই ও শিউলি বোটার রঙে মাখানো জরদা। অবিবাহিত মেয়েরা পিঠার ওপর অাঁকতেন প্রজাপতি, যা বহুকাল ধরে বাঙালিদের কাছে বিয়ের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। তবে শহরে এ দেশিয় উপাদানের অভাব ছিল। ঈদের খাওয়ার তালিকায় প্রধান হয়ে উঠত ঘরে তৈরী মিষ্টান্ন। ঢাকায় উনিশ শতকে ঈদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ঈদ মিছিল। সম্ভবত ঢাকার নায়েব-নাজিমগণ ঢাকার বিখ্যাত জন্মাষ্টমী মিছিলের অনুপ্রেরণায় এ মিছিল চালু করেছিলেন। মাঝখানে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর কয়েক বছর আগে থেকে আবার এ মিছিল চালু হয়েছে।

পরবর্তীকালে ঈদের সঙ্গে কিছু স্থানীয় উপাদান যুক্ত হয়েছে, যার অনেকগুলি এসেছে বিভিন্ন লোকাচার থেকে, যেমন ঈদের চাঁদ দেখে সালাম দেওয়া, কদমবুসি করা, মেলা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়।

অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় বা শহুরে সংস্কৃতিও প্রভাব ফেলেছে এ উৎসবে। বিশ শতকের ত্রিশ-চল্লিশ দশকে ঢাকায় ঈদের দিন রমনা, আরমানিটোলা বা অন্যান্য মাঠে ‘খটক’ নাচ অনুষ্ঠিত হতো। এ ছাড়া ছিল নৌকা বাইচ, ঘুড়ি ওড়ানো, ঘোড়দৌড়, হিজরা নাচ ইত্যাদি। ঘোড়দৌড় ও হিজরা নাচ ছিল ঢাকার বাবু কালচারের অঙ্গ, যা যুক্ত হয়েছিল ঈদ উৎসবের সঙ্গে। এ শতকের শুরুতে রাজনৈতিকভাবে মুসলিম স্বাতন্ত্র্য আন্দোলন শুরু হলে ঈদ উৎসব নতুন গুরুত্ব লাভ করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার পর বাংলাদেশে দ’ুটি ঈদই জাতীয় ধর্মোৎসবে রূপান্তরিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে।

বিশ শতকে তিনদিনের ঈদুল আয্হা পালন উপলক্ষে কোরবানি, বিশেষত গরু কোরবানিতে অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে বাধা দেওয়া হতো। কিন্তু সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানরা শক্তিশালী হয়ে উঠলে সে বাধা আর থাকে নি। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে অনেক মধ্যবিত্তের পক্ষে অন্তত একটি খাসি কোরবানি দেওয়া সম্ভব ছিল, কারণ তা পঞ্চাশ থেকে একশো টাকার মধ্যে পাওয়া যেত। গ্রামে অনেকে পোষা খাসি বা গরু কোরবানি দিতেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরে বিত্তবান ও বিত্তহীনের তফাৎ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় কোরবানি এখন সামাজিক মর্যাদার সূচক হয়ে উঠেছে। গ্রামে এখন কোরবানি ধনী এবং মাঝারি চাষীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। শহরের পেশাজীবীদের অধিকাংশই ভাগে গরু কোরবানি দিয়ে থাকেন। অনেকের পক্ষে তাও সম্ভব নয়। বিত্তবানরা নিজেরাই গরু, খাসি কিংবা উভয়ই কোরবানি করেন।

কোরবানির কয়েকদিন আগে থেকেই বিভিন্ন জায়গায় পশু বেচা-কেনার হাট বসে। হূষ্টপুষ্ট দামি গরুর গলায় ঝোলানো হয় কাগজের মালা। আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঈদ উৎসবের এ বৈশিষ্ট্যগুলি এখন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। নগরায়ণ, মধ্যবিত্তের প্রসার প্রভৃতি উৎসবের আমেজে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কোরবানিতে প্রাণীর বৈচিত্র্য এসেছে। খাসি এবং গরুর পাশাপাশি এখন উট ও দুম্বাও সীমিত সংখ্যায় কোরবানি দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষের ঈদ মানে পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে মিলিত হওয়া, নতুন কাপড় কেনা এবং ঈদের দিন যথাসাধ্য উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করা।

বাংলাদেশে শিয়া সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কম হলেও উনিশ শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে মুহররম পালিত হয়েছে, যার রেশ এখনও বিদ্যমান। সুষক্ষ্ম মতাদর্শী মুগল শাসকদের অনেকেই মুহররমের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। মুর্শিদকুলী খান থেকে মুবারকউদ্দৌলা সবাই ছিলেন শিয়া সমর্থক।  সিরাজউদ্দৌলা তাঁদের জন্য নির্মাণ করে দিয়েছিলেন ইমামবারা। শুধু তাই নয়, নওয়াবগণ মুহররম শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণও করতেন এবং মুহররমের ব্যয় নির্বাহ হতো সরকারি কোষাগার থেকে। ইংরেজ আমলে তা রহিত করা হয়। ঢাকার নায়েব-নাজিমরা ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আঠারো ও উনিশ শতকে ঢাকায় শিয়া আধিপত্য প্রবল হয়। বাংলাদেশে তখন ঢাকা ছিল মুহররম পালনের প্রধান কেন্দ্র। গ্রামাঞ্চলে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে উনিশ শতকে। মুহররম নিয়ে গ্রামাঞ্চলে অনেক পুঁথি রচিত হয়েছে। সেগুলি মুহররম ছাড়া অন্যান্য সময়েও সুর করে পড়া হয়। মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু  প্রকাশের (১৮৮৫-৯১) পর বাংলাদেশে মুহররম নতুন মাত্রা লাভ করে।

বাংলাদেশে যে মুহররম পালিত হয় তাতে বিভিন্ন সময়ে এখানকার হিন্দু ও লোকায়ত অনেক আচার-অনুষ্ঠান যুক্ত হয়। ইরানে মুহররমের মিছিলে একটি শবযান বহন করা হয়, কিন্তু বাংলা তথা ভারতে থাকে দুটি। কারণ ভারতীয়সহ বাঙালি মুসলমানরাও বিশ্বাস করেন যে, হযরত আলীর দুছেলেই কারবালার যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেছিলেন; তাই আশুরার দিন ‘হায় হাসান! হায় হোসেন!’ বলে শোক প্রকাশ করা হয় এবং রোজা রাখা হয় দুজনের সম্মানেই। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তা নয়; হাসানকে বিষপানে হত্যা করা হয়েছিল মদীনায় ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে, আর হোসেন শাহাদত বরণ করেন কারবালায় ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে।ঢাকা ব্যতীত বাংলাদেশে অন্যান্য অঞ্চলের মুহররম পালন সম্পর্কে তেমন প্রাচীন তথ্য পাওয়া যায় না। উনিশ শতকের শেষার্ধে বাংলাদেশের প্রতিটি মুসলমান গ্রামে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে তাজিয়া মিছিল বের করা হতো।

ঢাকায় এখন মুহররম পালনের মূল কেন্দ্র শিয়া সম্প্রদায়ের ইমামবারা হোসেনী দালান। তবে ঢাকার সবচেয়ে পুরনো ইমামবারা ফরাশগঞ্জের বিবিকা রওজা মহল্লায় অবস্থিত। জনৈক আমীর খান ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন। ১৮৬৯ সালের ঢাকার মানচিত্রে একটি পুরনো হুসেনী দালানের উল্লেখ আছে; ফুলবাড়িয়ার কাছে ছিল মীর ইয়াকুবের হুসেনী দালান। আরও দুটি পুরনো হুসেনী দালান ছিল ছোট কাটরা এবং মুকিম কাটরায়।

মুহররম মোটামুটি ১০ দিনের অনুষ্ঠান। আশুরার বা দশম দিনের অনুষ্ঠানটিই উল্লেখযোগ্য। ওই দিন ঢাকার আজিমপুরে বসত বিরাট মেলা, যা এখনও টিকে আছে। বিভিন্ন ইমামবারা থেকে ওই দিন তাজিয়া নিয়ে মিছিল করে সবাই আসে আজিমপুরের হুসেনাবাদে। সেখানে তাজিয়াগুলি কালো কাপড়ে ঢেকে নিঃশব্দে নিয়ে আসা হয় হুসেনী দালানে।

মুহররমের প্রধান অঙ্গ তার মিছিল। মিছিলে থাকে সাজানো তাজিয়া, দুলদুল ঘোড়া, নানা রঙের হাজারো নিশান, ‘হায় হাসান, হায় হুসেন’ ধ্বনি আর তাজিয়ার ওপর থাকে হাজার জালালী কবুতর। কিন্তু জন্মাষ্টমীর মিছিল যেমন হিন্দু-মুসলমান, নারী-পুরুষ সকলের নিকটই প্রিয় ছিল, মুহরমের মিছিল তেমনটি ছিল না। তখন মুহররমের মিছিলের অগ্রভাবে চলত লাঠি ঘোরানো, তলোয়ার খেলা আর পেছনে থাকত জ্বলন্ত ইটের মিছিল। অতীতে ঢাকায় শিয়া মুসলমানদের সংখ্যা কম হলেও শান-শত্তকতের সঙ্গে মিছিল বের করা হতো।

ষাটের দশক পর্যন্ত মুহররম মিছিলে জাঁকজমক ছিল, ক্রমে তা কমতে থাকে। এখন মূল যে মিছিল বের হয় তা সকালে শুরু হয় হুসেনী দালান থেকে। সেখান থেকে বখশীবাজার, আজিমপুর, পুরানা পল্টন হয়ে বিকেলে ধানমন্ডির লেকে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে তাজিয়া বির্সজন দেওয়া হয়। আগে করা হতো আজিমপুরের কারবালার ঝিলে, এখন সে ঝিল আর নেই।

ঢাকার মুহররমের একটি প্রধান আকর্ষণ মেলা। মুহররম উপলক্ষে মেলা বসে হুসেনী দালান, বখশীবাজার, ফরাশগঞ্জ ও আজিমপুরে। এর মধ্যে আজিমপুরের মেলাটিই সবচেয়ে বড়। এ ছাড়া বাংলাদেশের যে কোনো অঞ্চলেই মুহররম পালিত হোক না কেন, এর আনুষঙ্গিক উপাদান হিসেবে মেলা থাকবেই।

বর্তমানে ঢাকা, মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিছুটা ভিন্ন মাত্রায় মুহররম পালিত হয়। কোনো কোনো এলাকায় নির্ধারিত বাড়িতে বংশ-পরম্পরায় বিভিন্ন লৌকিক পীর-ফকিরের অনুষ্ঠান ও শির্নী মানতের তারিখ অনুযায়ী মুহররম উদযাপিত হয়ে থাকে। উল্লিখিত বাড়িগুলিতে মুহররম মাসের প্রথম তারিখেই বাড়ির প্রাঙ্গণ বা বাড়ি সংলগ্ন একটি স্থানে মাটি দিয়ে চতুষ্কোণ বিশিষ্ট তিনতাকের একটি বেদি তৈরি করা হয়। বেদিটির সামনেই খনন করা হয় ছোট একটি পুকুর। বেদির চারকোণায় চার রঙের চারটি পতাকা গেঁথে তার মাঝে মাঝে কাঁচা মাটির ওপর পেতল বা রুপার তৈরী ছোট ছোট চাঁদ, তারা, চোখ ইত্যাদি লাগান হয় এবং সামনের পুকুরটি সাধ্যানুযায়ী দুধ বা পানিতে পূর্ণ করার পর বেদির একপাশে একটি ধারালো ছুরি বা তীর বিদ্ধ করা হয়। পূর্ণাঙ্গ এ বেদিটিকে বলা হয় ‘বরকত মা’র থল। বেদির চারপাশে রঙ্গিন কাগজের ঝালর ও ছোট ছোট নিশান পুতে সীমানা নির্ধারণ করা হয়। তারপর একে কেন্দ্র করেই শুরু হয় অনুষ্ঠান। এখানে সবাই এসে মানত করে এবং জিনিসপত্র দিয়ে যায়। যিনি ‘থল’ পরিচালনা করেন তিনি দশদিন শুধু নিরামিষ খেয়ে রোজা রাখেন। এ ছাড়া মুহররমের বাকি অনুষ্ঠান যেমন, মর্সিয়া, জারি গাওয়া, লাঠি খেলা এসব অন্যান্য অঞ্চলের মতোই। তবে এসব গ্রামে মুহররমের সব অনুষ্ঠানের কেন্দ্রই ‘থল’ এবং দশই মুহররম মাটির বেদিটিকেই বিসর্জন দেওয়া হয়।

মুহররমে শুধু মুসলমানরাই নয়, এক  সময় হিন্দুরাও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতেন। ১৮৩১ সালের একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, বাংলায় বছরে ১৪ হাজার তাজিয়া নির্মিত ও প্রদর্শিত হতো, তার মধ্যে ৬০০টিই হিন্দুদের তৈরি। আসলে উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ধর্মীয় উৎসবগুলি ছিল সর্বসাধারণের জন্য এক ধরনের আনন্দোৎসব বা মিলনোৎসব, যে কারণে দুর্গাপূজা সহ হিন্দুদের উৎসবেও মুসলমানদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।

মুহররমের অনুষ্ঠানের একটি প্রধান উপাদান মর্সিয়া,ভাটিয়ালি এবং জারি গাওয়া। এর একটি কারণ হলো হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাংলার লোকসমাজের সঙ্গীতপ্রিয়তা। মুহররম উপলক্ষে মর্সিয়া ও জারি গান তাই সাধারণ মানুষকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে।

বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। এক সময় যখন ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণের ওপর ততটা গুরুত্ব আরোপ করা হয় নি এবং হিন্দু ও মুসলমানের পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে নি, তখন গ্রামাঞ্চলে দুর্গাপূজায় যোগ দিতেন আপামর পল্লীবাসী। তখন ধর্মীয় ভেদাভেদ বর্তমানের মতো প্রখর না থাকায় তাতে উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিতেন সবাই। ওই একটি দিন গ্রামীণ সমাজের একঘেয়ে জীবনযাপনে আসত বৈচিত্র্য। এ উপলক্ষে উন্নতমানের ভোজ এবং থিয়েটারসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো এবং সকলে আপনবোধে সেসব উপভোগ করত।

দুর্গাপূজা একটি প্রাচীন উৎসব, তবে কত প্রাচীন তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। মহিষমর্দিনী দুর্গার সবচেয়ে প্রাচীন যে মূর্তিটি পাওয়া গেছে তা পনেরো শতকের। প্রাচীনকালে যে দুর্গাপূজা হতো তার প্রকৃতি ও রূপ ছিল ভিন্ন। এখন বাংলাদেশে যে দুর্গাপূজা প্রচলিত তা সম্পূর্ণ বঙ্গীয় ব্যাপার, প্রাচীন পদ্ধতিরই লৌকিকরূপ, যা বর্তমানে পরিণত হয়েছে শারদীয় উৎসবে। এটি অকালবোধন নামেও পরিচিত, কারণ অতীতে দুর্গাপূজা হতো বসন্তকালে এবং ওটাই ছিল দেবীপূজার প্রশস্ত সময়, কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাম কর্তৃক অকালে (শরৎকালে) দেবীর পূজা করার প্রসঙ্গ থেকেই শারদীয় পূজার প্রচলন হয়।

বাংলাদেশে দুর্গাকে অবলম্বন করে উৎসবের একটি পরম্পরা অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত আশ্বিনের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর বোধন হয়। তারপর সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এ তিনদিন পূজা হয় এবং বিজয়া দশমীতে হয় বিসর্জন। বিজয়ার পরদিন থেকে পনের দিন ধরে চলে বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময়। এর পরের পূর্ণিমা তিথিতে হয় লক্ষ্মীপূজা; কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে হয় কার্তিকপূজা এবং মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে হয় সরস্বতী পূজা; এর আগে সাধারণত কার্তিক মাসের আমাবস্যা তিথিতে হয় দুর্গারই আরেক রূপ কালীর পূজা। আশ্বিনে দুর্গাপূজা দিয়ে যার শুরু, মাঘে সরস্বতী পূজা দিয়ে তার শেষ। এভাবে সকল দেবদেবীর আলাদা আলাদা পূজার বিধান থাকলেও গণেশ পূজার আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই, তবে অন্য যে কোনো দেবদেবীর পূজার আগে গণেশ পূজা করে নিতে হয়; ‘ওঁ গণেশায় নমঃ’ না বলে কোনো দেবদেবীরই পূজা করা চলে না।

বঙ্গে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন সম্রাট আকবরের চোপদার রাজা কংসনারায়ণ (বাংলার দীউয়ান এবং তাহিরপুরের রাজা) ষোল শতকে। দীউয়ান হওয়ার পর কংসনারায়ণ চেয়েছিলেন মহাযজ্ঞ করতে। তখন রাজপুরোহিত ছিলেন বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্য বংশ। এ বংশের রমেশ শাস্ত্রী সে সময় সমগ্র বাংলা-বিহারে শাস্ত্রজ্ঞ হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। তিনি রাজাকে বলেন, যে চাররকমের যজ্ঞ করার নিয়ম আছে তার কোনোটিই এ আমলে করা সম্ভব নয়; রাজা যেন বরং দুর্গাপূজা করেন; এ পরামর্শ দিয়ে তিনি দুর্গাপূজার পদ্ধতিও লিখে দিয়েছিলেন। তখন রাজা প্রায় আট-নয় লক্ষ টাকা খরচ করে মহাসমারোহে দুর্গাপূজা করেন। সে থেকে দুর্গাপূজার শুরু।

বাংলাদেশে দুর্গাপূজা হিন্দুদের সর্বজনীন এবং সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হতে প্রায় তিনশ বছর লেগেছিল। দুর্গাপূজা জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব হিসেবে প্রথম পালিত হয় কলকাতায় উনিশ শতকে। এরপর থেকে আস্তে আস্তে দুর্গাপূজা ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং একে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় উৎসবে পরিণত করার পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখেন জমিদাররা।

তৎকালে ফরিদপুরের কোটালিপাড়ায় দুর্গাপূজার একটি চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় কৃষ্ণকুমার মিত্রের আত্মজীবনী থেকে। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী ঢাকের বাদ্য ও প্রতিমা গড়ার মধ্য দিয়ে শুরু হতো পূজোর উৎসব। শরৎকালে মাঠময় জল থই থই করত এবং তার মধ্য দিয়েই প্রায় ঘরে ঘরে দুর্গোৎসব পালিত হতো। পূজায় প্রচুর পাঁঠাবলি হতো; অবস্থাপন্ন গৃহস্থবাড়িতে তার সংখ্যা হতো কমপক্ষে ষাট। ঢাক, ঢোল ইত্যাদির বাদ্যে পাঁচ-ছয় দিন ওই জলময় অঞ্চল থাকত মুখরিত। গান, বাদ্য, আহার, বিহার এবং আমোদ-প্রমোদে নারী-পুরুষ, যুবা-বৃদ্ধ সকলে মাতোয়ারা হয়ে যেত। দুর্গাপূজা উপলক্ষে তখন আনুষঙ্গিক বিষয় হিসেবে থিয়েটার, কীর্তন, ঢপ, যাত্রা প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হতো।

এভাবে ময়মনসিংহের মুক্তগাছা ও গৌরীপুরের জমিদাররাও ১৯৪০-৪১ সাল পর্যন্ত মহাসমারোহে দুর্গাপূজা করেছেন। পূজা উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠিত হতো যাত্রা, কবিগান, ঢপকীর্তন ইত্যাদি। মুক্তাগাছায় বিজয়ার দিন হাতির মিছিল হতো। প্রজারা পূজা উপলক্ষে একদিন রাজবাড়ির ভোজে আমন্ত্রিত হতেন। রাজবাড়ি ছাড়া সাধারণ গৃহস্থদের ঘরেও পূজা অনুষ্ঠিত হতো। পূজার সময় প্রবাসী সকলে নিজ নিজ বাড়ি এসে আনন্দোৎসবে যোগ দিতেন। দুর্গাপূজায় কোনো বর্ণভেদ নেই; সব সম্প্রদায়ের হিন্দুরাই পূজা করতে এবং পূজায় অংশগ্রহণ করতে পারতেন। তবে বর্ণপ্রথার কিছুটা প্রভাব থাকতই।

উনিশ শতকের ত্রিশের দশকে ঢাকায় দুর্গাপূজা পালনের বিবরণ পাওয়া যায় বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের আত্মজীবনীতে। তখন মৈশুন্ডির এক বাড়িতে লাল দুর্গার প্রতিমা তৈরি করা হতো। সূত্রাপুরে ‘ঢাকার বাবু নন্দলালের’ বাড়িতে দোতলার সমান উঁচু প্রতিমা হতো। তবে  রামকৃষ্ণ মিশনএর পূজাই ছিল বিখ্যাত। সেখানে দর্শনার্থীদের প্রচন্ড ভিড় হতো; সন্ন্যাসীরা কীর্তন করতেন। এ সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে ব্রাহ্মণেতর মানুষদের মধ্যে এক ধরনের জাগরণ ঘটে। তাঁরা ব্রাহ্মণদের আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করেন এবং কেউ কেউ পুরোহিত ছাড়া নিজেরাই পূজা করেন। নেত্রকোণার চন্দপাড়ায় এরকম কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল।

১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে বাংলাদেশের অনেক অবস্থাপন্ন হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায়। এর ফলে গ্রামাঞ্চলে এককভাবে পূজা অনুষ্ঠান করা কষ্টকর হয়ে ওঠে। তাই গ্রামাঞ্চলে বর্ণবিভেদ ভুলে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সকলে একত্রিত হয়ে চাঁদা তুলে পূজার অনুষ্ঠান শুরু করেন যা এখন ‘সর্বজনীন পূজা’ হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তান আমল থেকেই বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে যত দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে তার প্রায়ই সব সর্বজনীন। তবে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক উদ্যোগেও পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিণত হয়েছে দুর্গাপূজা উদ্যাপনের প্রধান কেন্দ্রে। এখানে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় পূজা কমিটির মাধ্যমে প্রতিবছর দুর্গপূজাসহ অন্যান্য পূজাও অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশে দুর্গোৎসবে এক সময় সব সম্প্রদায়ের মানুষই যোগ দিতেন, এখনও দেন, তবে আগের মতো নয়। বাঙালি হিন্দুর কাছে দুর্গা কন্যারূপে পরিগণিত। প্রতিবছর তিনদিনের জন্য তিনি পুত্রকন্যাসহ পিত্রালয়ে আসেন ‘নাইয়র’ কাটাতে। এ উপলক্ষে তাই রচিত হয়েছে অনেক আগমনী-বিজয়া গান।

এক সময় এ অঞ্চলের মানুষ, বিশেষ করে ঢাকাবাসীরা আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করতেন জন্মাষ্টমীর মিছিলের জন্য। জন্মাষ্টমী পালন এ অঞ্চলের একটি প্রাচীন উৎসব, বিশেষ করে ঢাকা শহরের; এতে এক সময় হিন্দু-মুসলমান সবাই অংশগ্রহণ করতেন। জন্মাষ্টমীর সময় ঢাকা শহরে যে মিছিল বের হতো তা সারা বাংলায় বিখ্যাত ছিল। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে কথিত হয়, তাই এ দিনটি হিন্দু সম্প্রদায়ের নিকট অতিশয় পবিত্র। উপমহাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই কোনো না কোনোভাবে এ তিথি উদযাপিত হয় ধর্মীয় উৎসব হিসেবে। তবে অনেকেই ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিলের উল্লেখ করায় মনে হয় বিভিন্ন জায়গায় এটি অন্যান্য ধর্মীয় তিথির মতো সাধারণভাবে পালিত হলেও ঢাকায় বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হতো।

জন্মাষ্টমী পালনের প্রধান অঙ্গ ছিল এর মিছিল। তবে কেন এবং কখন এর শুরু হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না। ১৯১৭ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ভুবনমোহন বসাকের একটি পুস্তিকা থেকে এ সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়। সে অনুযায়ী ১৫৫৫ সালে (ভাদ্র, ৯৬২ বঙ্গাব্দ) জনৈক সাধুর নেতৃত্বে ‘শ্রীশ্রী রাধাষ্টমী’ উপলক্ষে হলুদ পোশাক পরিহিত বালক ও ভক্তদের এক মিছিল বের হয়। এর দশ বছর পরে তাদেরই নেতৃত্বে ১৫৬৫ সালে (ভাদ্র মাসে) শ্রীকৃষ্ণের জন্ম উপলক্ষে প্রথম জন্মাষ্টমীর মিছিল বের হয়। পরে এর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব অর্পিত হয় নওয়াবপুরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কৃষ্ণদাস বসাকের পরিবারের ওপর।

কালক্রমে সে মিছিল একটি সাংগঠনিক রূপ লাভ করে এবং প্রতি বছর জন্মাষ্টমী উৎসবের নিয়মিত অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। মুসলমানরা এ মিছিলের নামকরণ করেছিলেন ‘বাল গোপালের মিছিল’ বলে। এরপর নওয়াবপুরের অন্যান্য অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি নিজ নিজ উদ্যোগে মিছিল বের করতে শুরু করেন। প্রায় একশ বছর পরে উর্দু বাজারের গঙ্গারাম ঠাকুর নামে জনৈক বৈষ্ণব ব্রাহ্মণও নওয়াবপুরের বসাকদের অনুকরণে জন্মাষ্টমীর মিছিল বের করা শুরু করেন। তাঁর মিছিল আসত উর্দু রোড থেকে নওয়াবপুর পর্যন্ত। অন্যান্য মিছিলও সাধারণত নওয়াবপুর থেকে বাংলা বাজার হয়ে নওয়াবপুরেই প্রত্যাবর্তন করত। তবে গঙ্গারাম ঠাকুরের মিছিল বেশি দিন চলে নি। সম্ভবত এক সময় নওয়াবপুরের বিভিন্ন মিছিল সমন্বিত করে একটি মিছিলে রূপ দেওয়া হয়েছিল, যা পরিচিত হয়ে ওঠে নওয়াবপুরের মিছিল নামে।

১৭২৫ সালের দিকে গদাধর ও বলাইচাঁদ বসাকের নেতৃত্বে ইসলামপুর থেকেও জন্মাষ্টমীর একটি মিছিল বের হতে থাকে। এর সঙ্গে নওয়াবপুরের মিছিলের একবার সংঘর্ষ হলে বাংলার তৎকালীন লেঃ গভর্নর স্যার সিসিল বিডন একেক দিন একেক দলের মিছিল বের করার বিধান করে দেন। এর পর উনিশ শতকে ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল জমকালো হয়ে ওঠে এবং এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়। তখন দূরদূরান্ত থেকে লোক আসত ঢাকায় জন্মাষ্টমীর মিছিল দেখতে। সমগ্র ঢাকা তখন হয়ে উঠত উৎসবের নগরী। জন্মাষ্টমীর মিছিলের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে সুস্পষ্ট যে, আদিতে এটি ছিল একান্তভাবে ধর্মীয়, পরে ধর্মীয় প্রভাব অনেকটাই শিথিল হয় এবং হিন্দু-মুসলিম সকলের অংশগ্রহণে তা সর্বজনীন রূপ লাভ করে।

জন্মাষ্টমী মিছিলের প্রধান আকর্ষণ ছিল সঙের নাচ-গান। সঙরা বিভিন্ন রকম গান গাইত ও নাচত। সময়ের বিবর্তনে তাদের গানের পরিবর্তনও ঘটত এবং তা থেকে বিশেষ বিশেষ সময়ে জন্মাষ্টমীর স্বরূপগত পরিবর্তনটা বোঝা যেত। ১৮৬৪ ও ১৮৭২ সালের বর্ণনা থেকে দেখা যায়, দুটি মিছিলে এক পক্ষ অন্য পক্ষের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছে। এতে বিশেষ বিশেষ ঘটনার বর্ণনাও স্থান পেত এবং এ ধারা অব্যাহত ছিল বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাবু কালচারের উপাদানসমূহ, যেমন অশ্লীল গান, নাচ ও খেমটা।

বিশ শতকের তিন এর দশকে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের অবনতি ঘটলে মিছিলের জাঁকজমক অনেকটা হ্রাস পায় এবং পাকিস্তান আমলে সরকারি আদেশে তা বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া তখন নানা কারণে মিছিল বের করার পরিবেশও ছিল না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পরে ঢাকায় আবার জন্মাষ্টমীর মিছিল বের হতে শুরু করে।

বাংলাদেশে হিন্দু ছাড়া আরও দুটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় খ্রিস্টান ও বৌদ্ধদেরও বিভিন্ন উৎসব পালিত হয়। তবে সেগুলি কখনও মূল ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিল না এবং এখনও নয়। বৌদ্ধদের প্রধান উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা। বুদ্ধদেবের জন্ম, গৃহত্যাগ, বুদ্ধত্ব লাভ, পরিনির্বাণ সবই বৈশাখী পূর্ণিমায় ঘটেছিল, তাই এ উৎসব বৌদ্ধদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র উৎসব। বাংলাদেশে সহস্রাধিক বছর আগে থেকেই মহাসমারোহে বৈশাখী পূর্ণিমা পালিত হতো বলে অনুমান করা হয়।

ঔপনিবেশিক শাসনামলে খ্রিস্টানদের ক্রিস্টমাস বা যিশু এর জন্মদিন (বড়দিন) সাড়ম্বরে উদযাপিত হতো, বিশেষ করে কলকাতায়। এ উপলক্ষে দেশিয়রাও নানারকম অনুষ্ঠান করতেন। বড়দিনের উৎসব একদিনের। গির্জায় গির্জায় বিশেষ প্রার্থনা, ভোজসভা এবং উপহার বিতরণ এ উৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বর্তমানে বাংলাদেশে বৌদ্ধ বা খ্রিস্টানদের সংখ্যা নগণ্য, তাই তাদের উৎসবও পালিত হয় অনেকটা নীরবে।

বর্তমান বাংলাদেশে বিকশিত হচ্ছে আরেকটি উৎসব যার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, সেটি হলো বাংলা নববর্ষ। বাংলা বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ মহাসমারোহে পালিত হয়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য এ যে, এটি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে একটি সামাজিক উৎসব। এর চরিত্র সর্বজনীন। ধর্মভিত্তিক নয় অথচ সর্বজনীন এমন উৎসব পৃথিবীতে বিরল। বিগত ৪০০ বছরে কৃষি ও ঋতুর সঙ্গে যুক্ত অনেক অনুষ্ঠান এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে এবং এভাবে আবর্তিত হয়ে পহেলা বৈশাখ রূপান্তরিত হয় নববর্ষে। বিশ শতকের ষাটের দশক থেকে বাংলা নববর্ষ এক নতুন মাত্রা লাভ করে। আইয়ুব আমলে (১৯৬৪) রবীন্দ্রসঙ্গীত ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ শুরু হলে ছায়ানট পহেলা বৈশাখ নববর্ষ পালন উপলক্ষে রমনার বটমূলে আয়োজন করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান। ছায়ানটের এ প্রচেষ্টা ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।  বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা নববর্ষ ঘোষিত হয় সরকারি ছুটির দিন হিসেবে। বাংলা নববর্ষ এখন বাংলাদেশের একটি প্রধান সামাজিক উৎসব।

কালে কালে এ নববর্ষের সঙ্গে জড়িত হয়েছে আরও অনেক আনুষঙ্গিক বিষয়। সেসবের কোনোটি এখন বিলুপ্ত, কোনোটি লুপ্তপ্রায় এবং কোনো কোনোটি আবার অঞ্চলবিশেষে প্রচলিত আছে। লুপ্তপ্রায় একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে পুণ্যাহ। এর উদ্ভবকাল সঠিকভাবে জানা যায় না, তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটি প্রচলিত ছিল। এদিন প্রজারা ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ পরে জমিদারের কাচারিতে যেতেন খাজনা-নজরানা দিতে, যেন পুণ্য কাজ করতে যাচ্ছেন। তাই এর নাম হয়েছে পুণ্যাহ।

হালখাতা অনুষ্ঠানটি অবশ্য এখনও প্রচলিত আছে। প্রধানত ব্যবসায়ী মহল এটি পালন করে। নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা পুরনো বছরের হিসাব-নিকাশ সমাধা করেন। এ জন্য অনেকে লাল কাপড়ের মলাটের এক বিশেষ খাতা ব্যবহার করেন, যাকে বলা হয় খেরো পাতা। এদিন ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করান। শুধু তাই নয়, সাধারণ লোকদের মধ্যেও অনেকেই আজকাল নববর্ষ পলক্ষে মিষ্টিসহ ভালো খাবারের আয়োজন করেন। এ উপলক্ষে আঞ্চলিক অনুষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চট্টগ্রামের জববারের বলীখেলা বা কুস্তি। রাজশাহীর গম্ভীরাও এমনি একটি অনুষ্ঠান। ঢাকার মুন্সিগঞ্জে এক সময় গরু দৌড় প্রতিযোগিতার প্রচলন ছিল। তবে পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড়ো অনুষ্ঠান মেলা। কোথাও কোথাও এ মেলা সপ্তাহ কিংবা পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। নববর্ষের এ মেলাগুলি দেশের প্রাচীন আর্তব উৎসব, কৃষি উৎসব প্রভৃতির বিবর্তিত রূপ; কেননা এগুলিতে এখন পর্যন্ত স্থানীয় কৃষিজাত ও কুটিরশিল্পজাত দ্রব্যাদির বেচাকেনা হয়। বৈশাখী মেলার আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো অন্যান্য মেলার মতো এতে ধর্মীয় প্রভাব নেই। সমগ্র বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ ও বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ২০০ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকাসহ অন্যান্য শহর বা শহরাঞ্চলে আয়োজিত মেলায় মাটির ও কুটিরজাত পণ্যের সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থমেলারও আয়োজন করা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান নববর্ষের শুভেচ্ছা হিসেবে মক্কেলদের বই উপহার দেয়।  [মুনতাসীর মামুন]