উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৯:০৭, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পরিচালিত শিক্ষাদান কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধাজনক কোনো জায়গায় এ কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা মূলত  দরিদ্র জনমানুষের শিক্ষাদান  কার্যক্রম। এতে যে কোনো বয়সের নিরক্ষর মানুষকে অক্ষর, লেখাপাঠ, গণনা, হিসাব, মনের ভাব লিখন প্রভৃতি মৌলিক বিষয় শেখানো হয়। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীকে সমাজ, পরিবেশ ও দৈনন্দিন বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান দান করা হয়। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা শুধু বিদ্যালয়ের পাঠবঞ্চিতদের জন্য নয়, যারা  দারিদ্র্য ও অন্যান্য কারণে বিদ্যালয় থেকে ‘ঝরে’ পড়ে বা বিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হয় তাদের জন্যও উন্মুক্ত।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা

ব্রিটিশযুগে ১৯১৮ সালে নৈশ বিদ্যালয়ে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯২৬ সাল নাগাদ নৈশ বিদ্যালয়ের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। ১৯৩৫ সালে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার এবং বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে পাড়া বা মহল্লাভিত্তিক সমিতি বয়স্ক শিক্ষা এবং সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৩৯ সালে ফ্রাঙ্ক ল্যুবাক-এর ‘অন্তত একজনকে লেখাপড়া শেখাবো’ আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেয় পল্লী উন্নয়ন অধিদপ্তরকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৭-এর পর বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি এ কার্যক্রম চালু করেন। ১৯৫৬ সালে এইচ.জি.এস বিভার-এর উদ্যোগে ঢাকায় ‘সাক্ষরতা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার উপকরণ হিসেবে একটি প্রথম পাঠ ও কিছু চার্ট তৈরি করে। সাক্ষরতা কেন্দ্রের সূত্র ধরে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান বয়স্ক শিক্ষা সমবায় সমিতি। এটি বয়স্ক শিক্ষার জন্য ২৪টি বই রচনা ও প্রকাশ করে। এগুলোর মধ্যে ১২টি ছিল নব্য অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের পড়ার জন্য। ১৯৬২ সালে বিভারের মৃত্যুর পর বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। ১৯৬৩ সালে  বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী গণশিক্ষা পরিদপ্তরের পাইলট প্রকল্প হিসেবে একটি বয়স্ক শিক্ষা শাখা চালু করে। প্রকল্পটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অব্যাহত ছিল।

বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা রাষ্ট্রীয়  মূলনীতি হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। এরপরও এদেশে নিরক্ষরতার হার কমেনি। সকল শ্রেণির মানুষকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনা প্রায় অসম্ভব। শিশুদের একটি বৃহৎ অংশ নানা কারণে স্কুলে ভর্তি হতে পারে না। যারা ভর্তি হয় তাদের  মধ্যে অনেকেই ঝরে যায়, আর স্কুলে ফিরতে পারে না। এদের জন্যই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রয়োজন। যারা স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়নি, আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে নিরক্ষর রয়ে গেছে তাদের জন্যও এটি আবশ্যক। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে বয়স্কদের ব্যবহারিক শিক্ষা দেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশু, কিশোর ও বয়স্কদের জন্য বিকল্প শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করাই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।

শিক্ষার সুযোগ, শিক্ষা কার্যক্রম ও সময়সূচি, পাঠক্রম এবং শিক্ষার পরিবেশ বিবেচনায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা দরিদ্রদের জন্য একটি আকর্ষণীয় শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাছেই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার স্কুল বসানো হয় যাতে তাদের স্কুলে যেতে আসতে কম সময় লাগে। আর শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সাধারণত হয় একই পাড়া বা মহল্লার মানুষ। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার স্কুলে অধিকাংশ শিক্ষকই মহিলা। শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত সাধারণত ৩০:১ থেকে ৪০:১।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ স্কুলঘরভিত্তিক অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়িতে পাঠের চাপ থাকে না। পাঠক্রম বেশ সাজানো থাকে। এটি শিক্ষার্থী শিশু, কিশোর ও বয়স্কদের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় এবং তাদের পার্থিব জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার শক্তি যোগায়। শিক্ষার পদ্ধতিও হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের নাচ, গান, শরীরচর্চা, চিত্রাঙ্কন ও অন্যান্য পাঠ্যবহির্ভূত কাজে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দান করে। শিক্ষা উপকরণ স্কুল থেকে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় চলে। এতে শিক্ষার্থীদের অহেতুক পরীক্ষার ভয়ে ভীত থাকতে হয় না। এখানে নিয়মিত পাঠের তত্ত্বাবধান ও মূল্যায়ন হয়। শিক্ষার্থীদের বাবা, মা, স্থানীয় সমাজকর্মী ও নেতাদের সঙ্গে পরামর্শের জন্য নিয়মিতভাবে মাসিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বিভিন্ন  এনজিও এবং বাংলাদেশ সরকার সাত ধরনের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এগুলো হচ্ছে প্রারম্ভিক শিশু উন্নয়ন শিক্ষা, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা, কিশোর শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, সাক্ষরতা উত্তর অব্যাহত শিক্ষা এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা। প্রারম্ভিক শিশু উন্নয়ন শিক্ষার আওতায় কিছু কিছু বেসরকারি সংস্থা ‘শিশু লালনপালন শিক্ষা’ এবং ‘প্রাক-শৈশব উদ্দীপনা, শিক্ষণ ও তত্ত্বাবধান কর্মসূচি’ পরিচালনা করে।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় কেউ  সাক্ষরতা অর্জন করার পর ভুলে গিয়ে পুনরায় নিরক্ষরে পরিণত না হয় সাক্ষরতা উত্তর অব্যাহত শিক্ষা তা নিশ্চিত করে। সাক্ষরতা উত্তর অব্যাহত শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী ব্যবস্থা। এটি ক্রমপ্রসারী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেয়। অব্যাহত শিক্ষা কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার ও এনজিওসমূহ প্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরি এবং সাক্ষর জনমানুষের নিকট সেগুলো পৌঁছে দেওয়ার কাজে সচেষ্ট রয়েছে। অনেক বইপত্র গ্রাম এলাকার বিভিন্ন পাঠাগার, ভ্রাম্যমাণ পাঠশালা ও শিক্ষা পরিচালনা কেন্দ্রসমূহে পাঠানোর কাজ অব্যাহত রয়েছে।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সমাজভিত্তিক একটি কার্যক্রম। এই শিক্ষাপদ্ধতি নিরক্ষর ও দরিদ্র জনসাধারণকে স্থানীয় শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা এবং তদারকির সঙ্গে যুক্ত করে। শিক্ষাকেন্দ্রের স্থান ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী নির্বাচন এবং স্কুলের সময়সূচি ও ছুটির দিন নির্ধারণ বিষয়ে এই সকল মানুষ সহায়তা করে থাকে। এ ছাড়া সন্তানদের স্কুলে পাঠানো, মাসিক অভিভাবক সভায় যোগদান এবং অন্যান্য কাজে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশে মানবসম্পদ উন্নয়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো জনসংখ্যার অধিকাংশ বিশেষ করে পল্লী এলাকার জনগণের মৌলিক শিক্ষালাভের সুযোগ নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে এনজিওসমূহ দারিদ্র্য বিমোচন এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত কর্মকান্ডের পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে  ব্র্যাককারিতাসসিসিডিবি, ডানিডা, কনসার্ন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র,  আরডিআরএস এবং ভিইআরসি (ভার্ক)। পরে এগিয়ে আসে  ঢাকা আহছানিয়া মিশন, গণসাহায্য সংস্থা, সপ্তগ্রাম নারী স্বনির্ভর পরিষদ,  প্রশিকা, জাগরণী চক্র এবং আরও অনেক এনজিও। প্রথম দিকে জোর দেওয়া হয় বয়স্ক শিক্ষার ওপর। এর পর পর্যায়ক্রমে চালু হয় প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, কিশোর, বয়স্ক ও অব্যাহত শিক্ষা। বিশ শতকের আশি ও নববই দশকে এনজিওসমূহ মাঠ পর্যায়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষায় যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতা অর্জন করে। এ ক্ষেত্রে তারা বেশকিছু উদ্ভাবনী কার্যক্রমও চালু করে।

১৯৯৪ সালে গণসাক্ষরতা অভিযান (Campaign for Popular Education-CAMPE) উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকারী এনজিওদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করে। প্রথমদিকে সংগৃহীত তথ্যের মধ্যে ছিল ৪৩৫টি এনজিওর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রক্রিয়া, আওতাধীন এলাকা ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা, শিক্ষাকেন্দ্র এবং অন্যান্য সাধারণ তথ্য। CAMPE-এর তথ্যানুযায়ী ১৯৯৪ সালে এনজিওসমূহের ৪.৮% প্রাক্-প্রাথমিক, ৭২.২% প্রাথমিক, ৪১.৮% কিশোর এবং ৭৯.৮% বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিল। মোট শিক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৮৬,৯২৯টি যেগুলোর ৯১৭টি প্রাক-প্রাথমিক, ৩৮,৪১৩টি প্রাথমিক, ১১,৯০৭টি কিশোর এবং ৩৫,৬৯২টি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র। মোট শিক্ষার্থীর ৬৮.২৫% মহিলা এবং বাকি অংশ পুরুষ। ১৯৯৬ সালে ৪৩৫ টি এনজিওর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনুমানিক ২৫ লক্ষ শিক্ষার্থী ছিল। বড় এনজিওসমূহ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় শিক্ষার্থীদের বইপত্র যোগান দেয়। ছোট এনজিওগুলো বড় এনজিওদের তৈরি প্রথম পাঠ ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করে। ১৯৮০ সাল থেকে ব্র্যাক উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা উপকরণ তৈরি ও সরবরাহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে।

একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, এনজিওসমূহ সারা দেশের প্রায় ১০% প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ পরিচালনা করে। আবার আনুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক সব মিলিয়ে প্রায় ১০% প্রাথমিক  শিক্ষার্থী এনজিওসমূহের ব্যবস্থাপনাধীনে রয়েছে। বাংলাদেশ ‘২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা’ ও ‘শিশুদের জন্য বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলন’-এর ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দেয় এবং শিশু-কিশোর-যুবক ও বয়স্কদের শিক্ষা সম্প্রসারণে নিজের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। ১৯৮০ সালে গণসাক্ষরতা নামে জাতীয় বয়স্ক শিক্ষার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে লক্ষ্য করে ১৯৯১ সালে ‘সমন্বিত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম’ প্রকল্প চালু করা হয় এবং উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার একটি মৌলিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়। ১৯৯২ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসংক্রান্ত কর্মকান্ড সম্প্রসারণ ও সুসংহতকরণের জন্য ‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই বছর ১৯৯০ সালের ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা’ আইন অনুযায়ী ৬৮টি থানায় বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলনের কাজ শুরু হয়। ১৯৯৩ সাল থেকে দেশের সকল থানা ও ইউনিয়নে এ আইন বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা হয়।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের অধীনে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা পরিদপ্তর ৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ৩,৪৪,০০০ নিরক্ষর লোককে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ আরম্ভ করে। গ্রামীণ জনগণ বিশেষ করে মহিলাদের সাক্ষর করে তোলাই ছিল এ কার্যক্রমের প্রধান লক্ষ্য। প্রকল্পের আওতাভুক্তদের মধ্যে ছিল স্কুলে ভর্তি হয় নি এমন সকল ছেলেমেয়ে, স্কুল থেকে ঝরে যাওয়া শিশুকিশোর, যুবক ও প্রাপ্তবয়স্ক লোক, শহরের বস্তিবাসী ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত শিশুকিশোর, কয়েদি, উপজাতীয় জনগণ এবং ভবঘুরে জনগোষ্ঠী। ব্যবহূত শিক্ষাদান পদ্ধতির মধ্যে আছে কেন্দ্রভিত্তিক পদ্ধতি, প্রচারণাভিত্তিক পদ্ধতি এবং প্রাথমিক শিক্ষার বই বিতরণভিত্তিক পদ্ধতি।

২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৭৫০টি এনজিও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এদের অর্ধেকই নিজ উদ্যোগে কর্মসূচি পরিচালনার পাশাপাশি সরকারের সহযোগী হিসেবে সরকারি কার্যক্রম বাস্তবায়নেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বাকি যারা শুধুই নিজস্ব উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে বা যারা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা করে তাদের উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার বই, নির্দেশিকা এবং প্রশিক্ষণ উপকরণ বিতরণ করে।

২০০৪ সাল পর্যন্ত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা পরিদপ্তরের আওতায় বাংলাদেশে  শিশু, কিশোর, যুবক এবং বয়স্ক নিরক্ষরদের জন্য চারটি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্প চালু ছিল। আওতাভুক্ত এলাকা, কার্যক্রম বাস্তবায়ন পদ্ধতি, কোর্সের মেয়াদ ও ধরণের দিক থেকে প্রকল্পগুলি ছিল সমৃদ্ধ। কেয়ার,  সেভ দ্য চিলড্রেন, কনসার্ন, ওয়ার্লড ভিশন প্রভৃতি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিজ নিজ পুষ্টি এবং মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি ছাড়াও শিশু শিক্ষা  কার্যক্রম পরিচালনা করে। কোনো কোনো সংস্থা নতুন শিশু ও বয়স্ক শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করে। আবার কোনো কোনো সংস্থা সরাসরি উপানুষ্ঠনিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। অনেক সংস্থা স্থানীয় পর্যায়ের এনজিওসমূহকে উপানুষ্ঠনিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেয়।

১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে  পোশাক শিল্প কারখানায় কর্মরত শিশু-কিশোরদের শিক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্ত্ততকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির ( বিজিএমইএ) মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ১৪ বছরের কমবয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়োগ রহিত করা হয় এবং এদের মধ্যে যারা কাজ করতো তাদের স্কুলে পাঠানোর বিধান প্রবর্তিত হয়। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এ সমঝোতা স্মারকটি বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্ত্ততকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি গার্মেন্টস শিল্পকে শিশুশ্রমমুক্ত বলে ঘোষণা দেয়। এ শিল্পে কর্মরত শিশু শ্রমিকের জন্য ১৯৯৭ সালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামে ৩১৮টি বিদ্যালয় চালু করা হয়। ১৯৯৮ সালে এসব স্কুলের বিদ্যার্থীর সংখ্যা ছিল ৮,২০০। পড়াশোনায় উৎসাহদান এবং চাকরি ত্যাগের ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিদ্যার্থী শিশুকিশোরদের মাসে ৩০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়া হয়।

শহরের ৮-১৪ বছর বয়সী পথশিশুদের জন্য ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে ১৯৯৯ সালে চালু হয় হার্ড টু রিচ চিলড্রেন প্রোগ্রাম  নামের একটি বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম। এ কার্যক্রমের লক্ষ্য ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট এই ছয়টি বিভাগীয় শহরের শিশু শ্রমিকদের শোষণমূলক এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে রক্ষা করা। প্রাথমিক পর্যায়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ১৫০টি এনজিও এই শিক্ষা কার্যক্রমের অধীন  শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। এ শিক্ষা কার্যক্রমটি সফলভাবে পরিচালনা করার কাজে সহযোগিতা করে  সিটি কর্পোরেশন এবং সরকারের স্থানীয় সংস্থাসমূহ। ক্রমান্বয়ে এ প্রকল্প আরও সম্প্রসারিত হয়।

২০০৫ সালে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর বিলুপ্ত হয় এবং উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো গঠন করা হয়। সবার জন্য শিক্ষা-র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লক্ষ্য পূরণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০০৬ সালে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। এ শিক্ষানীতির সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্যাবলির মধ্যে রয়েছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সাব-সেক্টর তৈরি, শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিতকরণ এবং চাহিদামূলক, অর্থ উপার্জনোপযোগী ও  যথার্থ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো ও সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি অংশীদারি এবং সহযোগিতাপূর্ণ কর্মপদ্ধতি তৈরি করা। এ ছাড়া মেয়েশিশু ও কর্মজীবী শিশুদের মৌলিক শিক্ষা, অর্থ উপার্জনোপযোগী প্রশিক্ষণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

বাংলাদেশ সরকারের  দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে সবার জন্য শিক্ষা-র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ১. মানব উন্নয়নে সাক্ষরতা উত্তর ও অব্যাহত শিক্ষা প্রকল্প-২ (কর্মএলাকা ও অভীষ্ট দল: দেশের ২৯টি জেলার ২১০টি উপজেলায় ১১-৪৫ বছর বয়সী নব্যসাক্ষর), ২. শহরের কর্মজীবী শিশুকিশোরদের জন্য মৌলিক শিক্ষা প্রকল্প-২য় পর্যায় (কর্মএলাকা ও অভীষ্ট দল: নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ ৬টি শহরের ১০-১৪ বছর বয়সী ২ লক্ষ কর্মজীবী শিশুকিশোর- ৬০% মেয়ে শিশু)। এদের মধ্য থেকে ১৩+ বয়সী কিশোরদের পর্যায়ক্রমে জীবীকা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং অর্থ উপার্জনোপযোগী কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালের মধ্যে দেশে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের লক্ষ্য ঘোষণা করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো বেশ কয়েকটি প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মৌলিক সাক্ষরতা ও অব্যাহত শিক্ষা প্রকল্প-১ (৬১ জেলা), মৌলিক শিক্ষা ও অব্যাহত শিক্ষা প্রকল্প-২ (৩টি পার্বত্য জেলা), কর্মজীবী শিশুদের মৌলিক শিক্ষা ও জীবিকা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রকল্প (৫৬টি জেলা শহরের ১০-১৪ বছর বয়সী কর্মজীবী শিশু), আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সমতাভিত্তিক উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্প এবং তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় জীবনব্যাপী শিক্ষা প্রকল্প।

বাংলাদেশে নিরক্ষরতার হার অনেক বেশি। ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপ অনুসারে বাংলাদেশের বয়স্ক (১৫+বয়সী) জনগণের মধ্যে ১৯৮০ সালে ৩২% এবং ১৯৯৫ সালে ৩৮% সাক্ষরতার হার ছিল। বাংলাদেশ সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দলিলে এই হার দেখানো হয় ৪৭%। পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক নমুনা জরিপে দেখা যায় যে ১৯৯৮ সালে দেশে সাক্ষরতার হার দাঁড়ায় ৫১%।

প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সাক্ষরতার সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। ২০০২ সালে গণসাক্ষরতা অভিযান কর্তৃক ‘বাংলাদেশের সাক্ষরতা পরিস্থিতি’ বিষয়ক এক জরিপ পরিচালিত হয় এবং ২০০৩ সালে তা এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্ট  ২০০৩ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এ রিপোর্ট অনুসারে ১১ বছর বা তদুর্ধ বয়সী জনগণের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৪১.৪% (পুরুষ ৪৭.৬% ও নারী ৩৫.৬%)। পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাংক, ইউনেসকো এবং ইউনিসেফ কর্তৃক প্রদত্ত রিপোর্টে সাক্ষরতার হার হয় ৪১%-৪৮%। এসব পরিসংখ্যান থেকে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশে অসংখ্য লোক এখনো নিরক্ষর এবং  প্রয়োজনীয় শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত। দেশের সমগ্র জনসংখ্যাকে অনতিবিলম্বে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব নয়। তাই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার হিসেবে অভিহিত করে আর্থিক বরাদ্দ অব্যাহত রাখা হয়।

২০০৯ সালে গণসাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ১৪০০ এনজিও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় নিয়োজিত রয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০% প্রাথমিক/মৌলিক শিক্ষা কার্যক্রম এনজিওগুলির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে সরকার এবং এনজিওসমূহের সহযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে এবং একই সঙ্গে বয়স্ক শিক্ষার পরিধি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুযায়ী বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার ৫৩%। সদ্য অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা যাতে অর্জিত অক্ষরজ্ঞান ও লেখাপড়া ভুলে না যায় সে জন্য তাদেরকে বিদ্যাচর্চার উপযোগী উপকরণ সরবরাহ করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যায়ে বেতার এবং টেলিভিশন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম প্রচারের ক্ষেত্রে যুগোপযোগী ভূমিকা রাখতে পারে।  [শাহীদা আখতার]