ইন্ডিয়ান স্ট্যাট্যুটরি কমিশন রিপোর্ট

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৮:৫৬, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ইন্ডিয়ান স্ট্যাট্যুটরি কমিশন রিপোর্ট  ভারতে ভারতীয় সমস্যাবলি অনুসন্ধান করে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার সম্পর্কে প্রতিবেদন পেশ করার জন্য এ কমিশন গঠন করা হয়েছিল (১৯২৭)। এ কমিশন ছিল সরকার ও বিরোধীদলীয় সাতজন সংসদ সদস্য নিয়ে গঠিত একটি সংসদীয় কমিশন। সভাপতি স্যার জন সাইমনের নামানুসারে এ কমিশন সাইমন কমিশন নামেও পরিচিত।

ভারতের শিক্ষিত জনমত বহুদিন ধরেই দ্বৈত শাসনতন্ত্র নিরীক্ষা ও সংশোধনের জন্য উচ্চ কণ্ঠে দাবি জানিয়ে আসছিল। তাছাড়া, ১৯১৯-এর শাসনতন্ত্রেই বিধি ছিল যে, দশ বছর অতিক্রান্ত হলে এ সরকার পদ্ধতির কার্যকারিতা, শিক্ষার বিকাশ ও ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সম্পর্কে তদন্ত করতে একটি কমিশন নিয়োগ করা হবে। কমিশনে কোনো ভারতীয় সদস্য না থাকায় শুরু থেকেই শিক্ষিত ভারতীয়দের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনিশ্চিত। বস্ত্তত, বোম্বাইয়ে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই কমিশন ব্যাপক বৈরিতার সম্মুখীন হয়। কমিশনের বিতর্কে ভারতীয়দের এক ধরনের উপদেষ্টার ভূমিকায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানালে কমিশনের প্রতি ভারতীয়দের বিরোধিতা প্রশমিত হয়।

১৯২৮-২৯ সালে ভারতে দুবার ঐতিহাসিক পরিদর্শনে আসার পর কমিশন এক বিশাল প্রতিবেদন তৈরি করে। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক বহু কর্মকর্তা, বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বকারী বিশিষ্ট জনসেবক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎকার ও তাদের লিপিবদ্ধ বিবরণ, বিবৃতি ও স্মারকলিপির ভিত্তিতে ১৯৩০ সালে কমিশনের ১৭ খন্ডের সমন্বিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। কমিশন কোনো সংস্কার সাধনে ব্যর্থ হলেও এ প্রতিবেদনগুলিতে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান রয়েছে।

কমিশন দ্বৈতশাসনের অবসান ও প্রদেশে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রবর্তনের সুপারিশ করেছিল। নীতিগতভাবে কমিশন সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব অনুমোদন করেনি, তবে হিন্দু ও মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে মীমাংসা না করা পর্যন্ত এটাকে বহাল রাখার সুপারিশ করে। অনুন্নত সম্প্রদায়গুলিকে বা নিম্নবর্ণ হিন্দুদের আইন সভায় সংরক্ষিত আসন দেওয়া হয়। কমিশনকে শিক্ষিত ভারতীয়রা সুনজরে না দেখার কারণে, বিশেষত অর্থবহ রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য কংগ্রেসের অবিরাম পীড়াপীড়ি এবং ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক জটিলতার কথা বিবেচনা করে ব্রিটিশ সরকার অন্য একটি নতুন পদক্ষেপ নেয়। কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার আগে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে যে, শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতির স্বাভাবিক পরিণাম হচ্ছে অধীন রাষ্ট্রের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনাধিকার অর্জন এবং ভারতে শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতি সম্পর্কে ভারতীয়দের মতামত গ্রহণ। কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার আগেই সে ঘোষণা কমিশনের কাজকে কোনো বাস্তব উপযোগিতাহীন এক নিষ্ফল অনুশীলনে পরিণত করে।

তবুও সাইমন কমিশনের প্রতিবেদন বিশের দশকের ভারতের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার বহু কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে আলোকপাত করে। অবশ্য বাংলার দৃষ্টিকোণ থেকে অষ্টম খন্ড ‘মেমোরেন্ডাম সাবমিটেড বাই দি গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল টু দি ইন্ডিয়ান স্ট্যাট্যুটরি কমিশন’ ছিল সবচেয়ে ফলপ্রসূ। এ খন্ডের প্রথম অংশে বাংলা সরকার ১৯১৯ সালের সংস্কার দ্বারা প্রবর্তিত শাসন পদ্ধতির কাজের বিবরণ দেওয়ার প্রচেষ্টায় তাদের সংগৃহীত উপাদান পেশ করে। দ্বিতীয় খন্ডে বাংলা সরকারের বিগত সাত বছরে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র সংশোধনের প্রস্তাব ছিল।

এ মেমোরেন্ডাম-এ ভূমি-রাজস্বের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, কলকাতা বন্দর ও তার আশেপাশে একটি বড় শিল্প ও বাণিজ্যিক সম্প্রদায়ের বিকাশ, এবং প্রায় সমান সংখ্যায় দুটি বড় সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানদের বিভক্তি ইত্যাদির মতো বাংলার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল। এগুলির প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্যই প্রদেশের আর্থিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে বলে মেমোরেন্ডাম-এ উল্লেখ করা হয়।

বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর উল্লেখপূর্বক মেমোরেন্ডাম শিক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমানদের অসম উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে। মুসলমান জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশ ছিল কৃষিক্ষেত্রের কাছাকাছি বসবাসকারী কৃষক এবং প্রদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় তারা অবদান রাখলেও তাদের ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার অভাব। তাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র, যার ফলে প্রাগ্রসর হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে তারা সক্ষম ছিল না। এ পার্থক্য দুসম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈসাদৃশ্য সৃষ্টি করেছিল।

বাংলা সরকার প্রদেশে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বৈরিতার বিষয়টিও উল্লেখ করেছিল এবং উল্লেখ করেছিল যে, রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য নতুন সংগ্রামের সম্ভাবনার কারণে নেতৃবৃন্দ জনসাধারণের অসহিষ্ণুতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনিচ্ছুক ছিল। মেমোরেন্ডাম দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করে যে, জেলা বোর্ড ও পৌরসভাগুলিকে জনগণের নিয়ন্ত্রণে হস্তান্তর সম্পূর্ণ হলেও গ্রামীণ জনগণ, যাদের সুবিধার জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়েছিল, এতে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলি জনগণের নিয়ন্ত্রণে হস্তান্তর করায় জেলা কর্মকর্তাদের অবস্থান সম্পর্কিত বিরোধের কিছুটা আপস-মীমাংসা হলেও, তারা তখনও প্রশাসনের সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান হিসেবে থেকে যান।

প্রদেশের আর্থিক সমস্যাগুলিও তুলে ধরা হয়েছিল। প্রদেশের প্রধান করযোগ্য সম্পদ এবং শুল্ক ও আয়করলব্ধ অর্থ কেন্দ্রীয় রাজস্ব বৃদ্ধি করেছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলস্বরূপ বাংলার ভূমিরাজস্ব আয় সীমিত হয়ে পড়ায় বাংলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজে সামান্য অর্থ বন্টন করা হয়, যা কার্যত সংস্কারগুলির প্রতি নির্বাচকমন্ডলী, আইনসভা বা সংবাদপত্রে কোনো অনুকূল সহানুভূতি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়।

অভ্যন্তর থেকেই শাসনতন্ত্রকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ কংগ্রেস ও স্বরাজপন্থিদের সৃষ্ট বাধার কারণে শাসনপ্রক্রিয়ায় অসুবিধার প্রতিও মেমোরেন্ডাম গুরুত্ব আরোপ করে। উপসংহারে বলা হয় যে, প্রদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে ঐক্য আনয়নকারী শাসনতন্ত্র রচনা করা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ এবং এর জন্য কল্যাণকর সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন।

কমিশনের রিপোর্টের অন্য একটি প্রাসঙ্গিক অংশ ছিল তৃতীয় খন্ডে ‘রিপোর্টস অব দি কমিটিজ অ্যাপয়েন্টেড বাই দি প্রভিন্সিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল টু কো-অপারেট উইথ দি ইন্ডিয়ান স্ট্যাট্যুটরি কমিশন’-এ অন্তর্ভুক্ত ‘রিপোর্ট অব দি বেঙ্গল কমিটি’।  .কে ফজলুল হক, আবুল কাসেম, ভূপেন্দ্র নারায়ণ সিনহা, শশীকান্ত চৌধুরী এবং কে.জি.এম ফারুকী ছিলেন বেঙ্গল কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত বাঙালি সদস্য। দীর্ঘ আলোচনার পর কমিটি পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, পৃথক সাম্প্রদায়িক নির্বাচকমন্ডলী, ভোটাধিকারের যোগ্যতা হ্রাস, সরকারি কর্মে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের যথোচিত ও পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট প্রাদেশিক আইনসভা, কেন্দ্রের সঙ্গে আর্থিক সমন্বয় এবং প্রাদেশিক বিষয়গুলি মন্ত্রীদের কাছে হস্তান্তরের সুপারিশ করে। ‘দি রিপোর্ট অব দি বেঙ্গল কমিটি’ মুসলমানদের শিক্ষা সমস্যাবলি সম্পর্কেও একটি নিবন্ধ যুক্ত করেছিল। ইন্ডিয়ান স্টাট্যুটরি কমিশন বিফল হয়েছিল তবে এটা নিষ্ফল অনুশীলন ছিল না। সপ্তদশ খন্ড, ‘সিলেকশন্স ফ্রম মেমোর‌্যান্ডাম অন ওরাল এভিডেন্স বাই নন-অফিসিয়াল’ (দ্বিতীয় অংশ)-এ বাংলা থেকে নিম্নলিখিতদের প্রামাণিক তথ্যাবলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল:নিখিলবঙ্গ নমঃশূদ্র সমিতি, ‘দি বেঙ্গল ডিপ্রেস্ড ক্লাসেস অ্যাসেসিয়েশন’ এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন।  [এনায়েতুর রহিম]