আমেরিকান

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৮:০৭, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

আমেরিকান  স্বাধীনতার পূর্বে পশ্চিম ইউরোপের নৌ-জাতিগুলির মতো ভারতের সঙ্গে সরাসরি নৌ-সম্পর্ক স্থাপন করেনি। ব্রিটিশ নেভিগেশন অ্যাক্ট শুধু পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং ইংল্যান্ডে বাণিজ্য করার জন্য আমেরিকানদের সুযোগ দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর পরই আমেরিকার নৌ-পথের ব্যবসায়ীগণ প্রাচ্য দেশিয় বিশেষ করে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু এ ধরনের বাণিজ্য স্বাভাবিকভাবে জয়েন্ট স্টক কোম্পানির মাধ্যমে হতে থাকলেও আমেরিকানদের বেলায় তা হয়নি। অভিযান পরিচালনা দ্বারা পুঁজিপতিগণ সে সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকে একটি সমুদ্র যাত্রার আয়োজন করে এবং আগ্রহী বিনিয়োগকারীদেরকে সমুদ্র যাত্রায় ব্যক্তিগতভাবে অথবা অধিকার প্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। এ সমুদ্রযাত্রা একজন বাণিজ্যিক ক্যাপ্টেন এবং সুপার কার্গোর (জাহাজে বোঝাই মালামালের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা) তত্ত্বাবধানে আয়োজন করা হয়।

১৭৮৫ সালে টমাস বেল-এর নেতৃত্বে ‘United States’ নামের আমেরিকান বাণিজ্য জাহাজ প্রথম বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। ১৭৮৭ সালে আমেরিকার পরবর্তীটি জাহাজ ‘Chesapeake’ কলকাতা পৌঁছে। এ দুটি সমুদ্রযাত্রা ছিল অনুসন্ধানমূলক এবং বাংলায় পশ্চিমাদের বাণিজ্যের ভাল সম্ভাবনা রয়েছে এমন ধারণা নিয়ে তারা নিরাপদে আমেরিকায় ফিরে যায়। ১৭৮৮ সাল থেকে বাংলার সঙ্গে আমেরিকানদের বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে। তখন থেকে বাণিজ্যের পরিমাণ এত বেশি বেড়ে যায় যে, একটি সরকারি হিসেবে আঠারো শতকের শেষে আমেরিকা বঙ্গোপসাগরের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়। নেপোলনীয় যুদ্ধ বাণিজ্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। ইউরোপীয় শক্তিগুলি যখন যুদ্ধের সময় গভীর সমুদ্রে একে অপরের জাহাজ দখল করছিল তখন সমুদ্রে একটি নিরপেক্ষ শক্তি হিসেবে আমেরিকা প্রায় একচেটিয়া বাণিজ্য দখল করে। ইঙ্গ-ভারতীয়গণ যারা অবৈধভাবে সম্পদ আহরণ করেছিল তারা তাদের অবৈধ অর্জিত সম্পদ নিরাপদে পাচার করার জন্য আমেরিকার জাহাজকে অগ্রাধিকার সহকারে ব্যবহার করে।

ঐতিহ্যগতভাবে বাংলা ছিল একটি রফতানি নির্ভরশীল দেশ। কিছু পণ্য শুধু আমদানি করতে হতো। তাই বিদেশিরা নগদ অর্থ নিয়ে বাংলায় আগমন করতে বাধ্য ছিল। বিদেশিরা মালামাল ক্রয়ের জন্য স্বর্ণ নিয়ে আসত এবং স্থানীয় মুদ্রায় পরিবর্তন করে তাঁরা পণ্য ক্রয় করত। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকানগণ তাদের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ধন রত্ন নিয়ে আসে। বাংলার বাজার থেকে তারা প্রধানত  সোরা, লাক্ষা,  চামড়া, চটের থলে, হলুদ, আদা, নীল, সিল্ক, মাদুর এবং অন্যান্য পণ্য ক্রয় করে। ১৮২০ সালের পর থেকে আমেরিকার বণিকেরা বাংলার বাজারসমূহে তাদের নিজস্ব উৎপাদন বিক্রি করতে শুরু করে, বিশেষ করে জিন্স, নৌ-ভান্ডার এবং মদ। এগুলি Madeire থেকে ক্রয় করা হতো। ১৮৪০-এর দশকে আমেরিকান বরফ বাজারজাত করে আমেরিকান বণিকদের একটি দল বিপুল বাণিজ্য করে। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকান বরফের ব্যবহার একটি বড় ধরনের উদ্ভাবন ছিল। কিন্তু এ পণ্যের বাজার ছিল স্বল্প সময়ের জন্য। শীঘ্রই তৈরি করা এবং হিমালয় থেকে কম খরচে প্রাপ্ত বরফ আমেরিকানদের বাজার দখল করে। যে সকল আমেরিকান বন্দর বাংলায় সমুদ্রযাত্রার আয়োজন করে সেগুলি ছিল সালেম, ফিলাডেলফিয়া, নিউ ইয়র্ক, মার্বেল হেড এবং বোস্টন। দেশের বাণিজ্য পরিস্থিতি অনুযায়ী কলকাতায় আগমনকারী জাহাজের সংখ্যা কমবেশি হতো। নেপোলনীয় যুদ্ধের সময়ে কলকাতা অভিমুখী জাহাজের সংখ্যা বছরে তিন ডজনের অধিক ছিল। ১৮১৫ সালে পুনরায় বাণিজ্য শুরুর পর এ সংখ্যা কখনও পনেরটির বেশি হয়নি।

১৮০৭ সালে বহির্বিশ্বে সমুদ্রযাত্রার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট মেডিসনের স্ব-আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলায় আমেরিকান বাণিজ্য বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ ছাড়া ১৮১২ সালে ইঙ্গ-আমেরিকান যুদ্ধও এ ক্ষেত্রে কাজ করে। ১৮১৫ সালে ভিয়েনা কংগ্রেসের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আমেরিকানরা বঙ্গোপসাগরীয় বাণিজ্যে নব উদ্যমে ফিরে আসে। কিন্তু তাদের বাণিজ্যের পরিমাণ কখনও নেপোলনীয় যুগের পরিমাণকে অতিক্রম করতে পারেনি। যাহোক, তাদের বাণিজ্যের পরিমাণ ১৮২০ এবং ১৮৩০ এর দশকে বেশ বৃদ্ধি পায়। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে আগ্রহ বাড়তে থাকায় ১৮৫০ এর দশকে বাংলার সঙ্গে আমেরিকানদের সম্পর্ক কমে যায় এবং আমেরিকার গৃহ যুদ্ধের সময় তা একেবারে মুছে যায়। ইউরোপীয় বণিকেরা তাদের ব্যবসা ইউরোপীয় এজেন্সি হাউস এর মাধ্যমে সম্পাদন করলেও আমেরিকান বণিকেরা এ ক্ষেত্রে বেনিয়াদের নিয়োগ করে। এজেন্সি হাউসের চেয়ে বেনিয়াদের কাজ অনেক সুলভে পাওয়া যেত। ফলশ্রুতিতে বাংলার বেনিয়ারা আমেরিকানদের দ্বারা আর্থিকভাবে উপকৃত হয় এবং তাদের মাধ্যমে আধুনিক বাণিজ্য পদ্ধতি শিখতে পারে। আমেরিকানদের একজন সরকার হিসেবে ১৭৯০ সালে কর্মজীবন শুরু করে রামদুলাল দে প্রথম বাঙালি লক্ষপতি হয়েছিলেন বলে জানা যায়। পরবর্তী সময়ে তিনি আমেরিকানদের প্রধান বানিয়া হয়েছিলেন। তিনি এত প্রভাবশালী এবং তাদের কাছে শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ওঠেন যে আমেরিকানেরা রামদুলালের নামে একটি জাহাজের নামকরণ করে।

আমেরিকান বণিকেরা তাদের বাঙালি প্রতিপক্ষের সঙ্গে মেলামেশা করতে গিয়ে ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি বেশ আগ্রহ প্রকাশ করে। নতুন ভাবে তৈরি তাদের অনেক জাহাজের নাম ভারতের বিভিন্ন প্রতীক অনুসারে রাখা হয় যেমন The Ganges, The Hindoo, The Devi, The Hindustan, The Indus, The Laskar, The Sultana এবং অন্যান্য। ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি আমেরিকান বণিকেরা চারু ও কারু শিল্পদ্রব্য, টেরাকোটা, মূর্তি হস্তজাত দ্রব্য, ধর্মীয় এবং সাহিত্য গ্রন্থ, পান্ডুলিপি, সামরিক হাতিয়ার ও অন্যান্য নিদর্শন সংগ্রহ করার প্রকল্প প্রহণ করে। সালেম ভিত্তিক বণিকেরা ১৭৯৯ সালে সালেম-এ ইস্ট-ইন্ডিয়া মেরিন সোসাইটি অ্যান্ড মিউজিয়াম নামে একটি জাদুঘর স্থাপন করে। প্রাচ্য দেশিয় নিদর্শন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এটি স্থাপিত হয়। বর্তমানে জাদুঘরটি পি.বডি জাদুঘর (সালেম শহরের পূর্ব ভারতীয় বিশিষ্ট বণিক জোসেফ পি. বডির (১৭৫৭-১৮৪৪) নামে) হিসেবে পরিচিত যা প্রাচ্য বিষয়ক সংগ্রহের জন্য আমেরিকার সবচেয়ে উত্তম সংগ্রহ শালা হিসেবে পরিগণিত। আমেরিকান বণিকদের বুদ্ধিজীবীক কর্মকান্ডের প্রতি উৎসাহের ফলে বেশ কিছু বণিককে পরবর্তীসময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিত্যাগ করতে দেখা যায় এবং এদের দুএকজন খ্যাতনামা প্রাচ্যতত্ত্ববিদ হিসেবে পরিচিত হন। উদাহরণ স্বরূপ জ্যকব বিগ্লো’র কথা বলা যায়। তিনি বণিক হিসেবে ১৮১২ সালে কলকাতা পৌঁছেন এবং এখানে তিনি ভারতীয় ভাষা শিক্ষা করেন, হিন্দুস্থানীয় ভাষার ব্যকরণ রচনা করেন এবং ভারতের উদ্ভিদ ও প্রাণিজগত সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন। আমেরিকায় ফেরার পর তিনি দেশের প্রথম প্রাচ্যতত্ত্ববিদের সম্মান লাভ করেন। তিনি হার্ভার্ড চিকিৎসা অনুষদে প্রাচ্য দেশিয় ঔষধ বিষয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। সংবিধান সংস্কারক এবং আমেরিকার অর্থনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর একজন প্রসিদ্ধ লেখক সিনেটর হেনরী লী একজন বণিক হিসেবে কলকাতায় পাঁচ বছর (১৮১১-১৬) অবস্থান করেন এবং নিজেকে ভারতীয় বিদ্যায় শিক্ষিত করেন। প্রভাবশালী সাময়িকী নর্থ আমেরিকান রিভিউর সম্পাদক (১৮৬৩-১৮৬৮) এবং হার্ভার্ড এর চারুকলার অধ্যাপক (১৮৭৪-১৮৯৮) চালর্স এলিয়ট নর্টন একজন তরুণ বণিক হিসেবে কলকাতায় (১৮৪৩-১৮৪৯) বাস করছিলেন। স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য করার পাশাপাশি তিনি হিন্দু মূর্তিতত্তব এবং প্রাচ্য দেশিয় সভ্যতা সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন যা তাকে হার্ভার্ডে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। কলকাতায় তাঁর বেনিয়া ছিলেন রাজেন্দ্র দত্ত যিনি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলার একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও পন্ডিত ছিলেন। অপর একজন আমেরিকান বণিক ডেভিড হাল হিন্দু পবিত্র গ্রন্থ থেকে জ্ঞান আহরণের জন্য তাঁর বানিয়া রাজেন্দ্র দত্তের কাছ থেকে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন।  [সিরাজুল ইসলাম]