আত্মজীবনী

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৮:০১, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

আত্মজীবনী  স্বরচিত জীবনচরিত। বিশ্বের অন্যান্য সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও আত্মজীবনী একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বাংলা ভাষায় রচিত আত্মজীবনীর সংখ্যা অনেক, যদিও সবগুলি এখন আর পাওয়া যায় না। উনিশ শতকের আগে বাংলা ভাষায় কোনো আত্মজীবনী লেখা হয়নি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের গীতিকবিতায় ভণিতার মাধ্যমে আত্মপরিচয় তুলে ধরার একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে, কাহিনীকাব্যে আত্মপরিচয় অনেকটা বিস্তৃত আকারে লেখা হয়েছে।  চন্ডীমঙ্গল কাব্যে  মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ও  পদ্মাবতী  কাব্যে  আলাওল এরূপ আত্মপরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু আধুনিক ধারার আত্মজীবনী বলতে যা বোঝায়, এগুলি তার মধ্যে পড়ে না।

সাহিত্য হিসেবে আত্মজীবনীর যথার্থ প্রকাশ ঘটে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় এরূপ প্রথম আত্মজীবনী রচনা করেন। উনিশ শতকের মধ্যভাগে কতিপয় সামাজিক-রাজনৈতিক বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবোধ ও স্বাধিকার চেতনা জাগ্রত হলে আত্মচরিত রচনার কৌতূহলও বৃদ্ধি পায়। কারণ নিজের জীবনকথা বর্ণনা করার প্রয়াস ব্যক্তিত্ববোধের একটা অভিব্যক্তি মাত্র। তবে সকল আত্মজীবনী এক মাপের ও এক চরিত্রের নয়। কেউ কেউ আত্মজীবনী রচনার ক্ষেত্রে বাল্যস্মৃতির ওপর অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন, আবার কেউ কেউ গুরুত্ব দিয়েছেন কর্মজীবনের ওপর। কিছু কিছু আত্মজীবনী আছে যেগুলির রচয়িতা সমকালীন আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের ওপর অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন।

আত্মজীবনী রচনা করতে গিয়ে বাল্যস্মৃতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এমন বিশিষ্ট কয়েকজন লেখক ও তাঁদের জীবনীগ্রন্থের নাম হলো:  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছেলেবেলা,  শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাল্যস্মৃতি,  সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার বাল্যকথা, গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন বাল্যজীবন, মন্মথনাথ মজুমদার আদর্শ ছাত্রজীবন ইত্যাদি। এ ছাড়া অনেক পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনীতেও বাল্যস্মৃতিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

কতিপয় আত্মজীবনী প্রবন্ধ বা সাক্ষাৎকাররূপে প্রকাশিত হয়েছে, যেমন: কৃষ্ণকুমারী গুপ্তের মনীষা মন্দিরে, সরলাদেবী চৌধুরানীর জীবনের ঝরাপাতা, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর আত্মজীবনী সম্পর্কিত রচনা, স্বর্ণকুমারী দেবীর আমাদের গৃহে অন্তঃপুর শিক্ষা ও তাহার সংস্কার, অমৃতলাল বসুর সেকালের কথা (স্মৃতিকথা), মানকুমারী বসুর আমার অতীতজীবন, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতিকথা, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের আমার জীবনের আরম্ভ, কেশবচন্দ্র সেনের জীবনবেদ ইত্যাদি। এ ছাড়া তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আত্মজীবনীমূলক যে সব সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে সেগুলির কয়েকটি বিপিনবিহারী গুপ্তের সম্পাদনায় পুরাতন প্রসঙ্গ নামে দু খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন উমেশচন্দ্র দত্ত, ব্রহ্মমোহন মল্লিক, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য,  দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরঅমৃতলাল বসু, রাধামাধব কর, মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

মানুষ আত্মজীবনী রচনা করে জীবদ্দশায়, ফলে রচয়িতার পূর্ণাঙ্গ জীবনের প্রতিফলন তাতে থাকতে পারে না।  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জীবনী রচনার পরও অনেককাল বেঁচেছিলেন; তাই তাঁর আত্মজীবনীতে জীবনের দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত। তবে কোনো কোনো আত্মজীবনীতে রচয়িতার প্রায় সমগ্র জীবনেরই ছায়াপাত ঘটেছে। জীবনের শেষ প্রান্তে রচিত আত্মজীবনী এ পর্যায়ে পড়ে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন রচয়িতা এবং তাঁদের আত্মচরিতের নাম হলো: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর- আত্মচরিত,  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর- জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- জীবনস্মৃতি, প্রমথ চৌধুরী- আত্মকথা, জসীমউদ্দীন- জীবনকথা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর- আপন কথা, আবুল কালাম শামসুদ্দীন- অতীত দিনের স্মৃতি, আবুল মনসুর আহমদ- আত্মকথা, বিনোদিনী দাসী- আমার কথা, রাসসুন্দরী দাসী- আমার জীবন, কামিনীমোহন দেওয়ান- পার্বত্য চট্টলের দীন সেবকের জীবনকাহিনী, মনোদা দেবী- জনৈকা গৃহবধূর ডায়েরী, বিপিনচন্দ্র পাল- চরিতকথা, মনোমোহন বসু- সমাজচিত্র, রাজনারায়ণ বসু- আত্মচরিত, বি.এম আববাস- কিছু স্মৃতি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর- বিদ্যাসাগরচরিত, স্বামী বিবেকানন্দ- স্মৃতিকথা, শিশিরকুমার ভাদুড়ী- আত্মজীবনী, ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ঠাকুরবাড়ীর দপ্তরে, মির্জা যোবায়েদা- আমার নানা রঙের দিনগুলি,  প্রফুল্লচন্দ্র রায় আত্মচরিত,  শিবনাথ শাস্ত্রী আত্মচরিত, সাহানা দেবী- স্মৃতির খেয়া,  দীনেশচন্দ্র সেন ঘরের কথা, সুকুমার সেন- দিনের পরে দিন যে গেল,   মীর মশাররফ হোসেন আমার জীবনী  ইত্যাদি।

আত্মজীবনীর মাধ্যমে কেউ কেউ প্রধানত কর্তব্যকর্মের সফলতা, বিফলতা বা তার পরিবেশ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। এসবের অধিকাংশই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নিকট থেকে পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এ ধরনের আত্মচরিতগুলি বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখে। কতিপয় উদাহরণ, যেমন: সাদত আলী আকন্দ- তের নম্বরে পাঁচ বছর, আজগরউদ্দীন (মেজর অব.)- কারাগারের ডায়েরী, আফসারউদ্দীন (মেজর অব.)- দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও আমার সৈনিকজীবন, এ.এফ.এম আব্দুল জলীল- আমার সাহিত্যজীবন, মুজফ্ফর আহমদ- আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, আবুল মনসুর আহমদ- আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, অনন্ত সিং- কেউ বলে বিপ্লবী কেউ বলে ডাকাত, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়- আমার ভারত উদ্ধার, মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ- জীবন জাগার কাহিনী, প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলী- বিপ্লবীর জীবনদর্শন, মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা- নির্বাসন কাহিনী, জিতেন ঘোষ- জেল থেকে জেলে, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ- দ্বীপান্তরের কথা, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী- জেলে ত্রিশ বছর, উল্লাসকর দত্ত- কারাজীবন, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়- বিদ্রোহে বাঙালী বা আমার জীবন, ধীরাজ ভট্টাচার্য- আমি যখন পুলিশ ছিলাম, এ.আর মল্লিক- জীবনকথা ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম, রাণী চন্দ- জেনানা ফাটক, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত- কল্লোল যুগ, বিধুভূষণ সেনগুপ্ত- সাংবাদিকের স্মৃতিকথা, মণি সিংহ- জীবন সংগ্রাম, আজিজুল হক- কারাগারে ১৮ বছর, মফিজউদ্দিন হক- জীবনের বাঁকে বাঁকে, স্মৃতি কথা  ইত্যাদি।

এসব স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী শুধু এককভাবে লেখকদেরই তুলে ধরেনি, ব্যক্তিগত তত্ত্ব ও তথ্যের আড়ালে জাতীয় জীবনের সুখদুঃখ এবং সংগ্রাম ছাড়াও তার অগ্রগতির ধারাটিও লুকিয়ে রয়েছে। সাহিত্যের গবেষণায় তো বটেই, সমাজবিজ্ঞানীদের জ্ঞান-পিপাসাও এগুলি অনেকখানি পূরণ করতে সক্ষম। সাধারণ পাঠকের দৃষ্টিতে আত্মজীবনীগুলির মূল্য যা-ই হোক, একটি জাতির ইতিহাসে এগুলি  মূল্যবান সম্পদরূপে পরিগণিত। [আবুল কাশেম চৌধুরী]