অাঁতুড়

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৭:৫৬, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

অাঁতুড়  প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত একটি আচার বা সংস্কার বিশেষ। এটি সন্তান জন্মের পর প্রসূতির জন্য একটি অশুচি বা অস্পৃশ্যকালীন অবস্থা। এ সময় তাকে সব কাজকর্ম থেকে বিরত থাকতে হয় এবং পৃথক একটি ঘরে কিংবা কক্ষে বসবাস করতে হয়, যাকে বলা হয় অাঁতুড় ঘর। এ সময় পরিবারের দুএকজন বাদে অন্যদেরও ওই ঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। প্রসূতির আহার-নিদ্রা সবই ওই ঘরে সম্পন্ন হয়।

এই অশুচি অবস্থা লিঙ্গভেদ ও বর্ণভেদ অনুসারে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। পুত্রসন্তান হলে অশুচির মেয়াদ হয় বিশ দিন আর কন্যা হলে ত্রিশ দিন; তবে শূদ্রদের জন্য উভয় ক্ষেত্রেই ত্রিশ দিন। সন্তান জন্মের দশদিন পরে প্রসূতি প্রয়োজনে গৃহকর্ম করতে পারে, কিন্তু কোনোরূপ ধর্মকর্ম নয়। শূদ্রদের ক্ষেত্রে এ অধিকার জন্মে তেরোদিন পরে।

অশুচিকালীন সময়ে বিভিন্ন রকম ধর্মীয় ও সামাজিক আচার পালন করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রসবের পঞ্চম দিনে বাড়ির উঠানে নির্মিত অস্থায়ী অাঁতুড় ঘর থেকে প্রসূতিকে মূল বসতঘরে আনা হয়। এ সময়  নাপিত প্রসূতি ও নবজাতকের নখ কেটে দেয় এবং ধোপাবউ ক্ষার দিয়ে স্নান করিয়ে দেয়। এ অনুষ্ঠানকে বলা হয় ‘পাঁচটি’ বা ‘পাঁচ উঠানি’। এর পরের দিন অর্থাৎ ষষ্ঠদিন সন্ধ্যায় হয় সূতিকাষষ্ঠী বা ষেটের পূজা। এদিন গান-বাজনা হয় এবং আমন্ত্রিতদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। অঞ্চলভেদে একে ছয়ষষ্ঠীও বলা হয়। এদিন বিধাতা কর্তৃক নবজাতকের ভাগ্য লিখিত হয় বলে অভিভাবকদের বিশ্বাস; তাই তার শিয়রে দোয়াত-কলম প্রভৃতি রাখা হয়। কোথাও কোথাও অষ্টম দিন সন্ধ্যায় ছেলেরা কুলা বাজিয়ে এবং ছড়া গেয়ে নবজাতকের মঙ্গল কামনা করে। এ সময় তাদের এবং প্রতিবেশীদের আটকড়াই বা আটকলাই (মুগ কলাই ছোলা মটর খেসারি ভাজা ও চিড়া-মুড়ি-খই) এবং মিষ্টি খাওয়ানো হয়। আট প্রকার ভাজা খাওয়ানো হয় বলে এ অনুষ্ঠানের নাম হয়েছে আটকড়াই, আটকলাই বা আটকৌড়ে। কেউ কেউ জন্মের নবম দিনেও একটি অনুষ্ঠান করে, যার নাম নন্তা। প্রসূতির পরিপূর্ণ শুদ্ধিলাভ হয় একুশ বা ত্রিশ দিনে। এদিন পুনরায় তাদের নখ কাটা হয় এবং স্নান করানো হয়। এ সময় কেউ কেউ ষষ্ঠীপূজাও করে থাকে। অশুচিকালীন এসব কৃত্যকর্মের বিধি-বিধান রঘুনন্দনের শুদ্ধিতত্ত্ব, কৃত্তিবাসের  রামায়ণ, মুকুন্দরামের  চন্ডীমঙ্গল  প্রভৃতি গ্রন্থে পাওয়া যায়।

সন্তান জন্মের পর এ অাঁতুড় ব্যবস্থার পশ্চাতে রয়েছে মূলত কিছু সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক কারণ। সাধারণত প্রসবের পর প্রসূতির শরীর থাকে দুর্বল। এ সময় তার পক্ষে স্বাভাবিক কাজকর্ম করা কষ্টকর, এমনকি বিপজ্জনকও হতে পারে। তাছাড়া যত্রতত্র চলাফেরার কারণে প্রসূতি এবং নবজাতকের সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। এ কারণে যে-কাউকে অাঁতুড় ঘরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। প্রসূতির স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা, নবজাতকের সেবা-শুশ্রূষা করা এবং রোগাক্রমণ প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যেই এ অাঁতুড় ব্যবস্থার প্রচলন হয়। রোগাক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে অাঁতুড়ঘরে সব সময় আগুন রাখারও ব্যবস্থা করা হয়।

বর্তমানে বিশেষত শহরাঞ্চলে এ অাঁতুড় ব্যবস্থার প্রচলন না থাকলেও তার উদ্দেশ্যগুলি আধুনিক পদ্ধতিতে বাস্তবায়িত করা হয়। চাকরিজীবী প্রসূতিরা তিন মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করে এবং উভয়ের রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য প্রসবের আগে-পরে বিভিন্ন রকম চিকিৎসা-ব্যবস্থা গ্রহণ করে। গ্রামাঞ্চলেও এখন আর আগের মতো এ সব নিয়ম অনুসরণ করা হয় না।  [দুলাল ভৌমিক]