অভিবাসন

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৭:৫১, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

অভিবাসন  এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে মানুষের স্থানান্তর। বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠী বা মানুষের গ্রাম থেকে শহরে আগমন, স্থান বদল, কয়েকদিন কিংবা বহু বছর নিজের আদি বা স্থায়ী বাড়ি থেকে অনুপস্থিতি, সাময়িক অভিবাসন বা স্থায়ী আবাস পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলি এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। তথ্য প্রযুক্তির প্রসার এবং যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে অস্থায়ী প্রকৃতির স্থানান্তর ক্রমশ গুরুত্ব পাচ্ছে। অভিবাসন দ্রুত নগরায়ণের একটি মূল চালিকাশক্তি যা শ্রমশক্তির ভৌগোলিক পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে অধিক মাত্রায় উৎপাদন এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।

অভিবাসনের মাধ্যমে মানুষ ভাগ্যান্বেষণে স্বল্প সম্ভাবনাময় স্থান থেকে অধিক সম্ভাবনাময় স্থানে যেতে চায়। দেশের অভ্যন্তরে এক স্থান থেকে যেমন অন্যত্র, তেমনি এক দেশ থেকে ভিন্ন দেশেও অভিবাসন ঘটে। বিদেশে বাংলাদেশের অস্থায়ী অভিবাসীদের উপার্জিত অর্থ দেশের বাৎসরিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ায় এবং বাণিজ্য ঘাটতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পূরণ করে। বাংলাদেশ বিশ্বের সেই স্বল্প সংখ্যক দেশের একটি যেখানে অস্থায়ী অভিবাসীদের পাঠানো অর্থ জিডিপি’র ১০% এর সমান। প্রবাসীদের প্রেরিত এ অর্থ দেশে তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দের আয়ের একটি উৎস, যা শুধু মধ্যবিত্ত বা বিত্তবান পরিবারেরই অর্থনৈতিক ভিত্তি দৃঢ় করে তা নয়, অনেক দরিদ্র পরিবারকেও তাদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা মোকাবেলায় সাহায্য করে।

১৯০১ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ৯০ বছরে বাংলাদেশে শহরের জনসংখ্যা ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের  জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কেবল ৩ গুণ। ব্রিটিশ আমলে শহরের লোকসংখ্যা ১-২% হারে এবং পাকিস্তান আমলে ৪% হারে বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ আমলে অপেক্ষাকৃত শ্লথ নগরায়ণের কারণ ছিল শিল্পায়নের অভাব। ১৯৫১-১৯৬১ সালে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে  পাটবস্ত্রশিল্প কারখানা গড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে নগরায়ণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। স্বাধীনতার পর অতিদ্রুত নগরায়ণ ঘটে এবং পরবর্তী পর্যায়ে নগরকেন্দ্রগুলিতে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মকান্ড ব্যাপকতা লাভ করে। নগরকেন্দ্রগুলির সংখ্যা অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে যায়, যা ১৯৬১ সালে ছিল ৭৮, ১৯৭৪ সালে হয় ১৯৮ এবং ১৯৯১ সালে ৫২২।

১৯৭৪ পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের কোনো শহরের জনসংখ্যা ১ মিলিয়ন ছিল না। কিন্তু বর্তমানে রাজধানী ঢাকা ১০ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি মহানগরীতে পরিণত হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে নগর জনসংখ্যার অবস্থান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, চারটি প্রধান শহরের (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা) আয়তন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে এ নগরগুলি দেশের মোট শহরবাসীর এক-তৃতীয়াংশ ধারণ করত। ১৯৯১ সালে এ হার দাঁড়ায় ৫০%-এ। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মাত্র ৭.৬% লোক শহরে বাস করত, ১৯৯০-এর দশকে এ হার ২০%-এ উন্নীত হয়। ১৯৭৫-১৯৯০ সালে বাংলাদেশে শহরের জনসংখ্যার বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল ৩.৪% যা প্রতিবেশী অনেক রাষ্ট্র এবং এশিয়ার জনবহুল রাষ্ট্রগুলির তুলনায় অধিক।

নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ৬০% ঘটে থাকে পুনঃবিভাজন সহকারে গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরের মাধ্যমে। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল বছরে ৬% এবং গ্রামে তা ছিল ১.৫%। স্বাধীনতার পর থেকে প্রধান শহরগুলির সীমিত শিল্পায়ন অথচ বাণিজ্যের দ্রুত প্রসারভিত্তিক একটি বিশেষ ধরনের বিন্যাসকাঠামোয় জনসংখ্যার গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর ঘটে। প্রামাণ্য গবেষণা থেকে জানা যায় যে, সড়ক অবকাঠামো ও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি এবং উৎপাদন, ব্যবসা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, গৃহায়ণসহ বিভিন্ন ধরনের নির্মাণের বিকাশ শহরগুলিতে অদক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধি করেছে। তাই জীবিকার প্রয়োজনে এবং অধিকতর সম্ভাবনাময় চাকরির জন্য গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তদুপরি, অসম ভূমিব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভূমিহীনতা জনসংখ্যার এ স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে, গ্রামের উচ্চশ্রেণীর ১০% গৃহস্থ সেখানকার ৫১% জমির অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে এবং তারাই গ্রামের মোট উপার্জনের ৩২% অংশীদার। নিম্নশ্রেণীর ৪০% জনগণের ভূমির ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং আয়ের অংশীদারিত্বের ভাগ যথাক্রমে ২% এবং ১৬%। এর ফলে বাকি তিন-চতুর্থাংশ ভূমিহীন জনগোষ্ঠী গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যায়। এ ছাড়া অনেক ভূমিমালিক গ্রামবাসীও বিভিন্ন উৎস থেকে উপার্জন বৃদ্ধির প্রত্যাশায় গ্রাম থেকে শহরে যায়। তবে এ ধরনের স্থানান্তরের অধিকাংশই অস্থায়ী প্রকৃতির।

গ্রাম থেকে শহরে আসা পুরুষ অভিবাসীদের বেশিরভাগই পূর্বে ছিল কৃষিশ্রমিক। এ ছাড়া কৃষিপ্রধান এলাকা থেকেই মূলত স্থানান্তর ঘটে এবং ঢাকা শহরেই অভিবাসীদের আগমন অধিক লক্ষণীয়। পরিবারের অস্তিত্ব রক্ষার্থে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্থানে নতুন উপায়ে উপার্জনের মাধ্যমে পারিবারিক আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ আবর্তন ঘটে। ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে  পোশাক শিল্প কারখানা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের শহরে অভিবাসন বেড়ে যায়। ১৯৭০-এর দশকে শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রাধিকার এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব মানুষের গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে পরিসংখ্যানের দিক থেকে এ দুটি বিষয়ই ছিল নিতান্ত গুরুত্বহীন। অন্যদিকে ক্ষুদ্র পর্যায়ের জরিপে দেখা গেছে উচ্চশিক্ষিত ও অশিক্ষিত- এ দু মেরুর পরিবারের শিক্ষার অগ্রাধিকারে এবং ঝুঁকি গ্রহণের সামর্থ্যে প্রভেদ ব্যাপক হলেও উভয় শ্রেণির পরিবার থেকেই নগরে অভিবাসনের মাত্রা প্রায় সমান।

শিক্ষার পাশাপাশি অভিবাসীদের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য, যেমন- বয়স, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা, পরিবারে তার দায়িত্ব ও ভূমিকা এবং পারিবারিক সম্পদের উৎস (বিশেষত জমিজমা) থেকে আয় প্রভৃতি অভিবাসন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সামাজিক সংযোগ এবং গন্তব্যস্থলের সুবিধা ও সেখানে প্রাপ্তব্য সম্ভাব্য সাহায্য অভিবাসনের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচ্য। অনুরূপ, পল্লী অঞ্চলে খামার কার্যক্রম হ্রাস এবং শহরাঞ্চলে এর ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ থেকে প্রতিভাত হয় যে, ‘জনসংখ্যার অধিক মাত্রার ঘনত্বই বাংলাদেশের অভিবাসনের ধারা নির্ধারণ করে না’। বরং অভিবাসীর প্রাপ্ত কাজ ও কাজের বৈচিত্র্যের সুযোগ, মাথাপিছু আয়, ক্ষয়িষ্ণু উপার্জন ব্যবস্থার ঝুঁকি, প্রাকৃতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের স্তর এবং কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ ইত্যাদি নিয়ামকের দ্বারাও অভিবাসন প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়।

জনসংখ্যার গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন প্রায়শ বড় ধরনের দ্বিমুখী পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয় যা একদিকে সুবিধাজনক এবং অন্যদিকে ক্ষতিকর। এ ছাড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর শহরাঞ্চলে আগমন ও শহর থেকে গ্রামে প্রত্যাবর্তনের মিশ্র ফলাফল লক্ষ্য করা যায়। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, কর্মসংস্থান এবং অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে অভিবাসনের ইতিবাচক প্রভাবই বেশি। সাময়িক অভিবাসীদের প্রেরিত অর্থ তাদের গ্রামে অবস্থানরত স্বজনদের কল্যাণার্থে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। বর্তমানে ঢাকা শহরের বস্তি এলাকায় বসবাসরত অভিবাসীরা তাদের উপার্জনের বেশিরভাগই ব্যয় করে পরিবারের খাবার এবং সন্তানের শিক্ষার জন্য। তথাপি বস্তির শিশুদের স্কুলে ভর্তির হার (প্রায় ৩৫%) গ্রামে বসবাসরত ভূমিহীনদের (প্রায় ৫০%) তুলনায় অনেক কম। একইভাবে, বস্তিতে শিশুমৃত্যুর হারও গ্রামেরই অনুরূপ।

শহরাঞ্চলে মৌলিক সামাজিক সুবিধা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের অভাবে এবং এনজিওসমূহের অপ্রতুল সহায়তার কারণে দরিদ্র শহরবাসী, বিশেষ করে মহিলারা স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত ঝুঁকির দিক থেকে বিত্তবানদের তুলনায় অধিকতর ভুক্তভোগী। গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনকারী দরিদ্র গৃহস্থরাও উচ্ছেদ, পেশিশক্তির অত্যাচার, ক্রমাগত অসুস্থতা, মহিলাদের ওপর যৌন হয়রানি ইত্যাদি কঠিন হুমকির সম্মুখীন হয়। অবশ্য শহরের দরিদ্র ঘিঞ্জি এলাকায় বসবাসরত অভিবাসীরা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মতো নাগরিক সুবিধাগুলি বিধিবহির্ভূত উপায়ে ভোগের ব্যবস্থা করে নেয়।

কিছু বড় শহরে গ্রাম থেকে ক্রমাগত অভিবাসনের ফলে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির পরিবর্তে তা দারুণভাবে বিঘ্নিত হয় এবং সামগ্রিকভাবে শহরের অবকাঠামোগত অবস্থা ও পরিবেশের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। নগরের জনসংখ্যার দ্রুত ও ব্যাপক বৃদ্ধি উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করে। তদুপরি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুবিধা সৃষ্টিতে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা, নাগরিক সুবিধা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাসমূহের অদক্ষ ও অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিবেশগত সমস্যার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।  [রীতা আফসার]

আরও দেখুন  দেশান্তরগমন