অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা আন্দোলন

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৭:৫১, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা আন্দোলন  ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের প্রাক্কালে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নজনিত সমস্যার সমাধানে একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল-মে দেশবিভাগের প্রশ্নটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এ সময়ে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আনুষ্ঠানিকভাবে অবিভক্ত বাংলাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র করার এক পরিকল্পনা পেশ করেন। প্রায় যুগপৎ শরৎচন্দ্র বসুও তাঁর সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলা প্রজাতন্ত্রের এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর মধ্যে বাংলার সার্বভৌম মর্যাদা কি হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু তাঁদের উভয়েরই প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বাংলা প্রদেশের বিভক্তি রোধ করা।

সোহরাওয়ার্দী ভারত ইউনিয়নের বাইরে সম্পূর্ণভাবে এক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যুক্ত বাংলাকে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শরৎ বসু অবিভক্ত বাংলাকে কল্পনা করেছিলেন ভারত ইউনিয়নের মধ্যেই এক সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে। তাঁরা উভয়েই বাংলা বিভাগের তীব্র প্রতিবাদ জানান। এ বিভক্তির উদ্যোগ নিয়েছিলেন কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতৃবৃন্দ এবং এ প্রদেশের হিন্দু মহাসভার নেতারা। বাংলার কতিপয় হিন্দু ও মুসলিম নেতা সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর প্রয়াসের সমর্থন জানিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন: কিরণশঙ্কর রায় (বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার কংগ্রেস সংসদীয় দলনেতা), সত্যরঞ্জন বখশী (শরৎ বসুর সচিব), আবুল হাশিম (বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক), ফজলুর রহমান (বাংলা প্রদেশের রাজস্ব মন্ত্রী), মুহম্মদ আলী (সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী) ও আরও অনেকে। প্রস্তাবটি কিছুকাল ধরে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় আলোচিত হয় এবং বাংলার তৎকালীন নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে ঐকমত্যে আসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলে।

প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম স্বাধীন বাংলার ধারণার উৎস নিহিত ছিল আরও অতীতে। ১৯৪০ সালের মার্চে গৃহীত লাহোর প্রস্তাব ভারতের দুটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির দাবি তুলে ধরার পথে এক তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাস অবধি লাহোর প্রস্তাব সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের নিকট পাকিস্তান পরিকল্পনাটি ছিল প্রধানত ভারতের দুটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে দুটি পৃথক সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব। এ বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিমতের প্রতিনিধিত্বকারী সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম গোটা বাংলা ও আসাম এবং সে সঙ্গে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা বিহারের পূর্ণিয়া জেলা নিয়ে বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন।খাজা নাজিমউদ্দীন (বাংলা ও একই সঙ্গে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য) ও মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (বাংলা মুসলিম লীগের সভাপতি) ছিলেন এ ব্যাপারে সংখ্যালঘিষ্ঠ মতের প্রবক্তা। তাঁরা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্ধমান বিভাগ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট বাংলা, গোটা আসাম এবং বিহারের পূর্ণিয়া জেলার কিছু অংশ নিয়ে অধিকতর এক সমশ্রেণীভুক্ত পাকিস্তান আশা করেছিলেন।

জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের ৭-৯ এপ্রিল দিল্লিতে মুসলিম ব্যবস্থাপকদের এক সম্মেলনে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর অভিমত প্রকাশ করেন। এখানে তাঁর পাকিস্তানের সংজ্ঞা বাংলায় তাঁর অনুসারীদেরকে পাকিস্তান প্রশ্নে তাঁদের পূর্বতন অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে প্ররোচিত করে। তাঁরা এখন জিন্নাহর অখন্ড পাকিস্তানের অবস্থাকে সমর্থন করতে থাকেন। প্রস্তাবিত পাকিস্তান গঠিত হবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গোটা বাংলা ও আসাম এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে। তবে এমন সম্ভাবনা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় এ কারণে যে, বাংলা লীগের হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের ধারণা ছিল পূর্ব পাকিস্তান কার্যত হবে বৃহত্তর বাংলা নিয়ে এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। কেননা, এ রকম একটি রাষ্ট্রই লাহোর প্রস্তাবে উল্লিখিত পাকিস্তান পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছিল। এ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সোহরাওয়ার্দী ও হাশিম উভয়ে কিছুকাল পরে শরৎ বসু ও কিরণশঙ্কর রায়ের মতো প্রাদেশিক কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এক স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বাস্তবিকপক্ষে, হিন্দুরা বাংলা বিভক্তির জন্য সংগঠিত আন্দোলন শুরু করার বহু পূর্বে এমনকি, কলকাতার ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার (আগস্ট ১৯৪৬) পূর্বেই এ ধরনের ধ্যানধারণা সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে বিরাজমান ছিল।

১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি-র ঘোষণার পর ভারতের স্বাধীনতার বিষয়টি দৃশ্যত নিকটতর হয়ে ওঠায় এবং ওই ঘোষণার পর পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করার পক্ষে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে যুক্তিতর্কের আলোকে সোহরাওয়ার্দীসহ বাংলার অল্পসংখ্যক রাজনীতিক এক সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলা প্রদেশের সংহতি রক্ষার চিন্তা করেন। তারা বাংলাকে তার নিজস্ব সংবিধানসহ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্র গঠন করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রদেশে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের বিষয়েও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি আরও জোর দিয়ে উল্লেখ করেন যে, বাংলা বাঙালিদের ও এ বাংলা অবিভাজ্য। এ প্রদেশের একটি অংশ অন্যটির ওপর নির্ভরশীল, আর তাই এখানকার সকলেই এর প্রশাসনে অংশীদার হওয়ার অধিকারী। তিনি এ আশা পোষণ করেন যে, বাংলাকে এক গৌরবময় দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সেখানকার সকল শ্রেণীর মানুষ সম্প্রীতিতে বাস ও কাজ করতে দৃঢ়সংকল্প। সোহরাওয়ার্দী মনে করেন যে, যখন এ স্বাধীনতা অর্জিত হবে তখন বাংলায় শান্তি ও সমৃদ্ধির এক নবযুগের সূচনা হবে। আবুল হাশিম বাংলার কংগ্রেস ও মুসলিম নেতাদের প্রতি তাঁদের নিজেদের সমস্যা ব্রিটিশ প্রশাসনের আওতার বাইরে শান্তিপূর্ণ ও সুখকরভাবে নিষ্পত্তিতে সম্মিলিতভাবে প্রয়াসী হওয়ার আবেদন জানান। বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে শরৎ বসু অবিভক্ত বাংলার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন।

১৯৪৭ সালের এপ্রিল-মে’র দিনগুলিতে হিন্দু মালিকানাধীন সংবাদপত্র ও রাজনীতিকেরা বাংলা বিভাগের পক্ষে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন শুরু করে দেয়। ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের ঘোষণায় ভারত বিভাগের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশ বিভাগ অনিবার্য- এ বিষয়টি কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা নেতাদের কাছে পরিষ্কার হওয়ার পর তাঁরা বাংলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল এবং পাঞ্জাবের শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ভারত ইউনিয়নের মধ্যে রেখে দেওয়ার ব্যাপারে সঙ্কল্প প্রকাশ করেন। বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা প্রাদেশিক বিভাগ এবং ভারত ইউনিয়নের মধ্যে কলকাতাকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি স্বতন্ত্র হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ (পশ্চিম বঙ্গ) গঠনের পক্ষে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করে।

প্রায় একই সময়ে বাংলার প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভা এ মর্মে দৃঢ় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে যে, বাংলার হিন্দুরা, অন্ততপক্ষে বাংলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ, অবশ্যই ভারত ইউনিয়নের মধ্যে থাকবে এবং উক্ত অঞ্চলসমূহকে ভারতের অবশিষ্ট অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। এ ব্যাপারে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বাংলা কংগ্রেস এবং দেশের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভাগুলির বাঙালি হিন্দু সদস্যদের সমর্থন তাঁর পক্ষে আনতে সমর্থ হন। ঠিক এ পর্যায়ে যখন কংগ্রেস-হিন্দু মহাসভা অাঁতাত সাফল্যের সঙ্গে বাংলা বিভক্তির জন্য তাঁদের অভিযান সফলভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন সোহরাওয়ার্দীও বাংলা সম্পর্কিত তাঁর পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে, ঘোষনা দেন। ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে এক সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী তাঁর স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। এরপর আবুল হাশিম ১৯৪৭-এর ২৯ এপ্রিল কলকাতায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে একই ইস্যুতে তাঁর অভিমত ঘোষণা করেন। এর কয়েকদিন পর শরৎ বসু তাঁর সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলা প্রজাতন্ত্রের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

এসব পরিকল্পনা সাধারণভাবে ভারতের এবং বিশেষ করে, বাংলার দুটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের পরিবেশে উত্থাপিত হয়। লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরবর্তীকালে জিন্নাহর নেতৃত্বে পরিচালিত পাকিস্তান আন্দোলন বাংলার মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবির সমর্থনে মুসলিম জনসাধারণের অভিমত সংগঠিত করতে শুরু করে। বাংলার কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ সারা বাংলার পাকিস্তানিকরণের সম্ভাবনায় দারুণ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে এ প্রদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন কঠিন হয়ে ওঠে। পাকিস্তান অর্জনের জন্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কর্মসূচিতে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। অন্যান্য প্রদেশে এ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হলেও কলকাতায় এ দিবস সহিংসতায় রূপ নেয়। এখানে সরকার ছিল মুসলিম লীগের নিয়ন্ত্রণাধীনে। ফলে বাংলা প্রাদেশিক বিভাগের দাবির অনুকূলে হিন্দু জনমত গঠনে এর প্রচন্ড প্রভাব পড়ে।

বাংলা প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভা ও এ প্রদেশের কংগ্রেস নেতারা সার্বভৌম বাংলা পরিকল্পনা উপেক্ষা করেন। তাঁরা সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগের বিরুদ্ধে বাঙালি হিন্দুদের একটি বিরাট অংশকে সংগঠিত করেন। তাঁদের মতে, সোহরাওয়ার্দীর এ উদ্যোগ সারা বাংলায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একটি রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। হিন্দু সংবাদপত্রগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে অবিভক্ত বাংলা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে হিন্দু জনমত গড়ে তোলার কোনো চেষ্টাই বাদ রাখে নি। হিন্দু মহাসভা বাংলার কংগ্রেস সদস্যদের ওপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করে।

বাংলার কংগ্রেস সদস্যদের অধিকাংশ যখন স্বাধীন বাংলার জন্য সোহরাওয়ার্দীর পরিকল্পনার বিরোধিতা করে, তখন প্রদেশের মুসলিম লীগ মহলগুলির মনোভাবও বিভক্তির পক্ষে চলে আসে। বাংলা মুসলিম লীগের বৃহত্তর অংশ তথা জিন্নাহর অনুসারীরা খাজা নাজিমউদ্দীন ও মওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে দাবি করতে থাকে যে, বাংলা একক পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে, কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়। জিন্নাহ যেমন পাকিস্তান সম্পর্কে অনমনীয় ছিলেন, নাজিমউদ্দীন, আকরাম খান ও তাঁদের অনুসারীরাও ঠিক তেমন অনড় ছিলেন। তাঁরা জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন।

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম তাঁদের পরিকল্পনার ভিত্তিতে প্রদেশের হিন্দু নেতাদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর প্রয়াস অব্যাহত রাখেন। সোহরাওয়ার্দী নানা সময়ে বিষয়টি নিয়ে ফ্রেডারিক বারোজ, জিন্নাহ ও মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তাঁদের সঙ্গে তাঁর সন্তোষজনক আলোচনাও হয়। শরৎ বসু মার্চে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি (AICC) কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিরণশঙ্করের বিশ্বাস ছিল যে, যদি মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ হিন্দুদের জন্য এমন কিছু প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসেন, তাহলে প্রদেশটির অখন্ডতা রক্ষা পেতে পারে। ১৯৪৭-এর মে মাসের গোড়ার দিক থেকে অবিভক্ত বাংলার পক্ষপাতীরা একে অন্যের কাছাকাছি আসেন। কলকাতায় গান্ধীর সফরকালে তাঁরা তাদের প্রস্তাব নিয়ে গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁর পরামর্শ কামনা করেন। তাঁরা তাঁদের অভিমত সম্পর্কে কংগ্রেস ও লীগ শীর্ষ নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। পরিশেষে ১৯৪৭-এর ২০ মে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার পক্ষপাতী নেতাদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপ:

১.     বাংলা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্ধারণ করবে।

২.     স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের সংবিধানে যুক্ত নির্বাচন ও বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকবে আর সে সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান জনসমষ্টির সংখ্যানুপাতে আসন সংরক্ষিত থাকারও ব্যবস্থা থাকবে। হিন্দু ও তফশিলি হিন্দুদের আসনগুলি তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের জনসমষ্টির অনুপাতে তাঁদের জন্য বণ্টনের ব্যবস্থা থাকবে কিংবা এমন ভাবে সে ব্যবস্থা করা হবে যাতে উভয় সম্প্রদায়ের সম্মতি থাকবে। নির্বাচনী এলাকাগুলি হবে কার্যত বহু নির্বাচনী এলাকা এবং ভোট হবে বণ্টন অনুসারে, সামগ্রিক নয়। নির্বাচন চলাকালে কোনো প্রার্থী তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেলে এবং একইভাবে প্রদত্ত অন্য সম্প্রদায়গুলির ২৫ শতাংশ ভোট পেলে তাঁকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। যদি কোনো প্রার্থী এ শর্তাবলি পূরণ না করতে পারেন তাহলে যিনি তাঁর সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট পাবেন তিনিই নির্বাচিত হবেন।

৩.     স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে ও বাংলা বিভক্ত করা হবে না এ মর্মে ব্রিটিশ রাজকীয় সরকারের ঘোষণার পর বাংলার বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেওয়া হবে। তদস্থলে একটি নতুন অন্তবর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। এ মন্ত্রিসভায় মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের (তফশিলি হিন্দু ও হিন্দুসহ) সমান সংখ্যক সদস্য থাকবেন। তবে মুখ্যমন্ত্রী এ হিসেবের বাইরে থাকবেন। এ মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন মুসলিম ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হবেন একজন হিন্দু।

৪.     নতুন সংবিধানের আওতায় একটি আইন পরিষদ ও একটি মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত পর্যায়ে গঠিত হওয়া সাপেক্ষে ইত্যবসরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন (তফশিলি হিন্দুসহ) ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন চাকরিতে সমান অংশের অধিকারী হবেন। আর এসব চাকরি-বাকরি করবেন বাঙালিরা।

৫.     গণপরিষদ ত্রিশ বাক্তিকে নিয়ে গঠিত হবে। এদের মধ্যে ১৬ জন হবেন মুসলিম ও ১৪ জন অমুসলিম। ইউরোপীয়রা ছাড়া ব্যবস্থাপক পরিষদের মুসলিম ও অমুসলিম সদস্যরা তাদেরকে নির্বাচিত করবেন।

নিজেদের মধ্যে এক সমঝোতায় উপনীত হওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী, কিরণশঙ্কর রায় ও শরৎচন্দ্র বসু তাঁদের এ পরিকল্পনার পরীক্ষামূলক চুক্তির শর্তগুলির ব্যাপারে কংগ্রেস ও লীগ হাই কমান্ডের অনুমোদন আদায়ের চেষ্টা করেন। তবে কংগ্রেস ও লীগ নেতাদের মধ্যে তৎকালে বিরাজমান ভুল বোঝাবুঝি ও পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে এ সমঝোতার প্রণেতারা দারুণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কংগ্রেস ও লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতারা চুক্তির শর্তগুলির সরাসরি নিন্দা করেন। কলকাতার প্রভাবশালী দৈনিক সংবাদপত্র এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের খাজা গ্রুপের সংবাদপত্রগুলি চুক্তির শর্তগুলির বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান শুরু করে। খাজা গ্রুপের এ ধারণা হয় যে, এ চুক্তির অর্থ হবে হিন্দুদের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ, আর কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা নেতাদের মতে, এ চুক্তিটি পাকিস্তানের সীমানা সম্প্রসারণের একান্ত লক্ষ্যেই করা হয়েছে।

বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ১৯৪৭-এর ২৮ মে আকরাম খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ নিরীক্ষামূলক চুক্তির শর্তগুলির নিন্দা করে এবং লীগের পাকিস্তান দাবির প্রতি অবিচল ও জিন্নাহর নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা রাখার কথা পুনর্ব্যক্ত করে। এরপর ১৯৪৭ সালের ২৮ মে তারিখে প্রদত্ত ভারতীয় কংগ্রেসের নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদকের এক বিবৃতি অবিভক্ত বাংলার ফর্মুলাকে আরও একদফা বিপর্যস্ত করে। ভারতীয় কংগ্রেসের পথ ধরে বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্পাদক কালীপদ মুখার্জি এ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে ১৯৪৭ সালের ১ জুন এক বিবৃতি প্রদান করেন।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধিতা আসে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। কংগ্রেস হাইকমান্ড অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানদের স্থায়ী আধিপত্যের সম্ভাবনায় শঙ্কিত হন। জওহরলাল নেহরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল সার্বভৌম বাংলার ধারণার ব্যাপারে ঘোর বিরোধী ছিলেন। নেহরুর ধারণা ছিল যে, এ পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলার মুসলিম লীগ কার্যত গোটা বাংলাকে পাকিস্তানে যোগ দিতে বাধ্য করবে। তিনি আরও মনে করতেন যে, যদি বাংলা অবিভক্ত থাকে তবে তা ভারতীয় ইউনিয়নের একটি অংশ হওয়া উচিত। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন যে, কংগ্রেস স্বতন্ত্র বাংলা রাষ্ট্রকে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনা হিসেবে গণ্য করবে।

সর্দার প্যাটেল অবিভক্ত বাংলার উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত করার প্রস্তাব দেন। ১৯৪৭-এর এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে বাংলার প্রভাবশালী হিন্দু নেতাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থেকে বোঝা যায়, হিন্দুদের বাংলা বিভক্তির দাবির নেপথ্যে তাঁর নির্দেশক ভূমিকা ছিল এবং সেসঙ্গে সার্বভৌম বাংলা ধারণার বিপক্ষে তার উগ্র মনোভাবের কথাও জানা যায়। বাংলার যেসব হিন্দু নেতা ওই প্রদেশের মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন প্যাটেল তাঁদের নিন্দা করেন। উল্লিখিত নিরীক্ষামূলক চুক্তির শর্তগুলির ব্যাপারে মুসলিম লীগ হাই কমান্ডের দৃষ্টিভঙ্গিও খুব একটা অনুকূল ছিল না। এ বিষয়ে প্রথম দিকে জিন্নাহ কংগ্রেস হাইকমান্ডের মতো ঘোর বিরোধী ছিলেন না। এর থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, তিনি এ পরিকল্পনাকে উৎসাহিত করেছিলেন।

মাউন্টব্যাটেনের মতে, ভারতকে বিভক্ত করতে হলে পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করতে হবে। তিনি এর পক্ষে যুক্তিও দেখিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে, জিন্নাহ গোড়ার দিকে স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাবে সম্মতি দিতেও আগ্রহী ছিলেন। তাঁর প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল বাংলার বিভক্তি এড়ানো। তাতে করে স্বাধীন বাংলা ও পাকিস্তানের মধ্যে ভবিষ্যতে একটা মৈত্রী গড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বিধায় তাঁর এ সম্মতি ছিল গৌণ বিকল্প। তবুও শেষাবধি তিনি এ ইস্যুর অনুকূলে মনস্থির করতে পারেন নি। সম্ভবত তিনি এ ধারণার আলোকেই উল্লিখিত উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যে, এটি পাকিস্তান সম্পর্কিত বিশ্বাস থেকে বিচ্যুতি। তিনি উল্লিখিত পরীক্ষামূলক চুক্তিতে যে যুক্ত নির্বাচনের বিষয় সন্নিবেশিত রয়েছে সে বিষয়ে কোনো রেয়াত দিতে তৈরি ছিলেন না। বাংলার প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকভাবে মনে করেছিলেন, বাংলা প্রদেশে একটি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হলে তা হবে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদেরকে আরও ঘনিষ্ঠতর করার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আর তাতে একই সঙ্গে এ প্রদেশের বিভক্তিও রোধ করা যাবে। কিন্তু জিন্নাহ কখনও বিষয়টিকে ততখানি জরুরি বলে বিবেচনা করেন নি। বাংলায় কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা প্রশ্নে তাঁর ভেটো সোহরাওয়ার্দী-বসু ফর্মুলার জন্য অতীব গুরুতর বলেই প্রমাণিত হয়।

ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সার্বভৌম স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা ধারণার প্রতি সর্বাত্মকভাবে বৈরী ছিলেন এমন নয়। বাংলার তৎকালীন গভর্নর ফ্রেডারিক বারোজ প্রদেশটির আদৌ বিভক্তির পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি বরং সোহরাওয়ার্দী-বসু ফর্মুলার পক্ষপাতী ছিলেন এবং তা যাতে বাস্তবায়িত হয় সে জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টাও করেন। ভাইসরয়ও ভারত ও পাকিস্তানের ডোমিনিয়ন মর্যাদার সঙ্গে অবিভক্ত বাংলাকেও ওই একই মর্যাদা দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন না। তিনি সোহরাওয়ার্দীকে এ মর্মে আশ্বাস দেন যে, লীগ ও কংগ্রেস হাইকমান্ড অনুমোদন করলে বাংলা নিয়ে যেকোনো নিস্পত্তি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মেনে নেবে। তবে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ প্রশ্ন বিবেচনা করতে হবে। তাঁরা মাত্র একটি প্রদেশের স্বার্থের জন্য গোটা ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্নে রফা করতে আগ্রহী ছিলেন না। তাই এ পরিকল্পনা যে ব্যর্থ হবে তা ছিল প্রায় পূর্বনির্ধারিত। এরপর কংগ্রেস ও লীগ হাইকমান্ড ভারত বিভক্তি এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি ডোমিনিয়নের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা (১৯৪৭ সালের ৩ জুন) গ্রহণ করায় অবিভক্ত বাংলা ধারণার ওপর চূড়ান্ত আঘাত আসে।  [চিত্তরঞ্জন মিশ্র]