হোটেল-রেস্তোরাঁ

হোটেল-রেস্তোরাঁ  ক্ষণকালীন বসবাস ও আহারের কিংবা শুধুই আহারের জন্য নির্ধারিত স্থান। এটি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ব্যক্তি মালিকানায় বা সরকারিভাবে পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে পূর্বে এ ব্যবসার বিশেষ প্রচলন ছিল না। ঐতিহ্যগতভাবে এদেশের জনসাধারণ তাদের অতিথিদের নিজ বাড়িতে রাখে এবং বাড়িতেই তাদের খানাপিনার ব্যবস্থা করে থাকে। অতিথি বা আত্মীয়-স্বজনদের হোটেলে রাখা বা তাদের রেস্তোরাঁয় আপ্যায়ন করার প্রস্তাব একটি নিন্দনীয় বিষয় বলে গণ্য হতো। হিন্দুরা মনে করে অতিথি ভগবান এবং তারা অনেক কল্যাণ বয়ে আনে। মুসলমানদের দৃষ্টিতে সাধ্যমতো অতিথিদের সেবাযত্ন করা পুণ্যের কাজ। তাই অতীত বা মধ্যযুগে হোটেল-রেস্তোরাঁর কোন কদর ছিল না। তখন হোটেল-রেস্তোরাঁ পথিমধ্যে যাত্রীনিবাস হিসেবেই গড়ে ওঠেছিল। দূরপাল্লার যাত্রীরা এসব নিবাসে রাত্রিযাপন করত এবং তাদের ঘোড়া রাখত। সাধারণভাবে যাত্রীরা আশ্রয় এবং আহারের জন্য আশ্রম, মন্দির বা মসজিদে যেত।

রূপসী বাংলা হোটেল (সাবেক শেরাটন), ঢাকা

ব্রিটিশ শাসনামলে সরকারি কর্মচারী ও তাদের অতিথিরা ডাক বাংলো বা সার্কিট হাউজে রাত্রিবাস বা আহারের জন্য যেত। বিশ শতকের পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে বাংলাদেশে জেলা পর্যায়ে ওয়াপদা (পানি ও বিদ্যৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) তাদের দেশি ও বিদেশি প্রকল্প বিশেষজ্ঞদের জন্য বেশকিছু রেস্ট হাউজ তৈরি করে। জেলা পর্যায়েও সরকার তাদের নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের জন্য অনেক রেস্ট হাউজ তৈরি করে। ষাটের দশক থেকে পর্যটন শিল্পকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য পর্যটন কর্পোরেশন দেশের বিভিন্ন জায়গায় হোটেল ও মোটেল তৈরি করতে শুরু করে। এসব হোটেল বা মোটেলে আবাস ও আহারের সুব্যবস্থা করা হয় যাতে বিদেশিরাও এখানে থাকতে পারে। এ ধরনের বড় আবাস-স্থান তৈরি করা হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে। এসব হোটেল এবং মোটেলে আরামদায়ক বাস, দেশি-বিদেশি নানা প্রকার আহারের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও সেখানে আছে পর্যটকদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন আকর্ষণীয় জায়গা দেখার ব্যবস্থা, গাড়িভাড়ার ব্যবস্থা এবং খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধা। এর ফলে দেশের অনেক ঐতিহাসিক স্থান, কৃষ্টি, উপজাতীয় জীবন এবং প্রকৃতিভিত্তিক স্থান পরিচিতি লাভ করে, যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট, উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী এলাকা এবং পটুয়াখালীর কুয়াকাটা। ঢাকর মহাখালীতে পর্যটনের হোটেল-রেস্তোরাঁ ‘অবকাশ’কে দেশের উচ্চমানের হোটেল, রেস্তোরাঁ পরিচালনার জন্য জনশক্তির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ঢাকার ২০ কিমি পশ্চিমে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের কাছেই গড়ে তোলা হয় ‘জয়’ নামের আরও একটি সুন্দর রেস্তোরাঁ।

দেশের শহর বন্দরে ব্যক্তিমালিকানায় ছোট ছোট বহু হোটেল-রেস্তোরাঁ রয়েছে। এসব জায়গা ব্যবসায়ী এবং যারা মামলা-মোকদ্দমা করতে আসে তাদের থাকা-খাওয়ার সুবিধার জন্য। দেশের প্রথম উচ্চমানের হোটেল গড়ে ওঠে ঢাকার শাহবাগে। এটি পঞ্চাশের দশকে সরকারি পর্যায়ে তৈরি হয়, উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি অতিথিদের আবাস ও আহারের ব্যবস্থা করা এবং বড় আকারের অভ্যর্থনা, লাঞ্চ ও ডিনারের ব্যবস্থা করা। ষাটের দশকে ঢাকায় সরকারি পর্যায়ে ৩০০ কামরার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল তৈরি করা হয় এবং শাহবাগ হোটেলটিকে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল কলেজে রূপান্তর করা হয়। এই কলেজকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বর্তমানের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলটি এখন রূপসী বাংলা নামে পরিচিত। এ হোটেলে দেশবিদেশের অতিথি, বিভিন্ন এয়ার লাইনের অতিথিরা আরাম আয়েশে থাকতে পারে। এখানে বড় আকারের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর্যাপ্ত সুবিধা রয়েছে। এর কিছুদিন পরেই ঢাকার ব্যবসা কেন্দ্র মতিঝিলে একটি তিন তারকা বেসরকারি হোটেল পূর্বাণী তৈরি করা হয়। এ হোটেলের থাকা-খাওয়ার খরচ বেশ কম, তাই দেশীয় অতিথিরাই এখানে বেশি থাকেন। এর পরপরই গড়ে ওঠে সরকারি পর্যায়ে ৩০০ কামরার পাঁচ তারকা হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও। এটি জাপানি সরকারের অর্থ সাহায্যে তৈরি করা হয় এবং এখন এটি বিদেশি অতিথিদের আবাসের সবচেয়ে সুন্দর স্থান। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং আরও অনেক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এখানে অতিথি হিসেবে থেকেছেন। রূপসী বাংলা ও সোনারগাঁ হোটেল প্রতিষ্ঠার ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং ব্যবসায়ীদের এদেশে আসা যাওয়ায় সুযোগ-সুবিধা প্রসারিত হয়েছে। এ দুটি হোটেলেই অনেক উচ্চমানের দেশি-বিদেশি আহার ও পানীয়ের ব্যবস্থা আছে। চট্টগ্রামে আগ্রাবাদে একটি উন্নতমানের হোটেল তৈরি হয়েছে ব্যক্তি মালিকানায়। স্বল্পখরচে ঢাকায় থাকা-খাওয়ার জন্য আরও তিনটি ছোট হোটেল, যথা সুন্দরবন, জাকারিয়া এবং রাজমণি-ঈশাখাঁ গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত তিন দশকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেসরকারি উদ্যোগে অনেক নতুন হোটেল এবং রেস্তোরাঁ তৈরি করা হয়। অনেকগুলি হোটেল-রেস্তোরাঁ অপেক্ষাকৃত কম খরচে ভাল আবাস ও আহারের ব্যবস্থা করে থাকে। ঢাকার উচ্চমর্যাদার আবাসিক এলাকা গুলশান, বারিধারা, বনানী, ধানমন্ডি ও উত্তরায় এ ধরনের কয়েক ডজন অতিথি ভবন গড়ে উঠেছে এবং এগুলি বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। যেসব বিদেশি ব্যবসায়ী এদেশে বেশিদিন থাকে তারা এসব অতিথি ভবন পছন্দ করে। কারণ এখানে খরচ অনেক কম। ঢাকা, চট্টগ্রামে এবং অন্যান্য শহরেও শত শত নতুন নতুন রেস্তোরাঁ তৈরি হয়। এসব রেস্তোরাঁয় চাইনিজ, থাই, কোরিয়ান, জাপানিজ, ইন্দোনেশিয়ান এবং দক্ষিণ ভারতীয় খাবার পাওয়া যায়। খুলনাতেও সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ভাল হোটেল এবং রেস্তোরাঁ গড়ে ওঠেছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে বেশ কতগুলি ক্লাব তাদের সদস্যদের জন্য ভাল থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে। প্রতিনিয়ত অনেক ফাস্টফুড রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠছে যেখানে স্যান্ডউইচ, পিৎজা, কাবাব, হটডগ, বার্গার, ফ্রায়েড চিকেন এবং কোলড্রিং পাওয়া যায়।

হোটেল-রেস্তোরাঁয় বিয়ে-শাদি, সম্মেলন ইত্যাদিতে ৫০ থেকে ৫০,০০০ লোকের খানাপিনার ব্যবস্থা করার সুব্যবস্থা এখন সারা দেশে গড়ে উঠেছে। এদের দক্ষ জনশক্তি দিয়ে রাতারাতি বিরাট আকারের প্যান্ডেল তৈরি করা যায়, টেবিল চেয়ারের ব্যবস্থা এবং সুশিক্ষিত বাবুর্চি কর্তৃক উঁচুমানের খাবার, যেমন কাবব, রোস্টচিকেন, রেজালা, কোর্মা, বিরিয়ানি, পোলাও এবং ফির্নি পরিবেশন করা যায়। তারা এসব খাবরের সাথে মানানসই বোরহানি এবং সালাদও পরিবেশন করে। শহর এলাকায় এসব ভোজের জন্য বড় কমিউনিটি সেন্টার গড়ে উঠেছে। রেস্তোরাঁয়ও এসব ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। অতিথির সংখ্যা বেশি হলে ফাঁকা জায়গায় প্যান্ডেল তৈরি করা হয়। ধনী ব্যাক্তিরা সাধারণত বড় হোটেলে বড় বড় ভোজের ব্যবস্থা করে থাকে। ক্যাটারিং শিল্পের লোকেরা বাড়িতেও জন্মদিন, পানচিনি এবং গায়ে হলুদে ছোট ছোট ভোজের ব্যবস্থা করে থাকে। কখনও কখনও সরকারি প্রতিষ্ঠান, বড় হোটেল, রাজনৈতিক দল, এনজিও এসব ক্যাটারার এবং ডেকোরেটরদের সাহায্য নিয়ে বাইরে বড় বড় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে।  [এনামুল হক]