হুতোম প্যাঁচার নকশা

হুতোম প্যাঁচার নকশা কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক সামাজিক নকশা জাতীয় রচনা। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে, যাতে ‘চড়ক’ নামে একটিমাত্র নকশা ছিল। পরে আরও নকশা যোগ করে ১৮৬৩ সালে প্রথম ভাগ এবং পরের বছর দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। এতে কলকাতার হঠাৎ ফেঁপেওঠা ঐশ্বর্য-ভারাক্রান্ত নব্য সমাজ এবং তার প্রায় সব ধরনের মানুষের চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে। গ্রন্থে যাদের ব্যঙ্গ করা হয়েছে তারা সবাই লেখকের স্বশ্রেণীর ও তৎকালীন সমাজের অসাধারণ পরিচিত মানুষজন। তারা তিন ভাগে বিভক্ত সাহেবি ওল্ড অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষিত সাহেবি চালচলনের অন্ধ অনুকরণকারী; ইংরেজি শিক্ষিত নব্যপন্থী, যারা অনুকরণকারী নয় এবং ইংরেজি না-জানা গোঁড়া হিন্দু। এরা সকলেই কমবেশি জাল-জুয়াচুরি ফন্দি-ফিকির করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। নকশায় ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকলেও শ্লীলতার মাত্রা অতিক্রম করেনি। গ্রন্থে উল্লিখিত যেসব চরিত্র নিন্দা করার মতো নয়, লেখক তাদেরকে সঙ সাজিয়ে উপস্থাপিত করেছেন। নকশা বুঝতে হলে নকশার চরিত্রদের আসল পরিচয় জানা দরকার, সেসঙ্গে বোঝা প্রয়োজন সেকালের অনুষ্ঠান, প্রথা, স্থাননাম এবং অপ্রচলিত অজস্র শব্দের অর্থ।

গ্রন্থের বিষয়সূচি এরূপ: প্রথম ভাগ কলকাতার চড়কপার্বণ, বারোইয়ারি পূজা, ছেলেধরা, ক্রিশ্চানি হুজুক, মিউটিনি, মড়াফেরা, সাতপেয়ে গরু, দরিয়াই ঘোড়া, লখনৌয়ের বাদশা, ছুঁচোর ছেলে বুঁচো, জাস্টিস ওয়েলস, টেকচাঁদের পিসী, বুজরুকি, হঠাৎ অবতার ইত্যাদি; দ্বিতীয় ভাগ রথ, দুর্গোৎসব, রামলীলা, রেলওয়ে। সমকালের বাস্তব জীবন যেমন, তেমনি জীবনসংলগ্ন ভাষাভঙ্গির জন্য গ্রন্থখানি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।  কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মৌখিক ভাষার প্রথম সুষ্ঠু প্রয়োগ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাংলা গদ্যে এরকম নিরঙ্কুশ কথ্য বুলির যথার্থ প্রয়োগ ইতোপূর্বে আর দেখা যায়নি। লেখক ‘হুতোম’ ছদ্মনামে লিখতেন বলে এর ভাষা ‘হুতোমী বাংলা’ বলে পরিচিত। এ ভাষা প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালী ভাষা’ থেকে মার্জিততর ও বিশুদ্ধতর; এতে কথ্য ও সাধু ক্রিয়াপদের মিশ্রণ নেই।  [নুরুল আমিন]