হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম

হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম শিল্পকর্মে হাতির দাঁতের ব্যবহার খ্রিস্টজন্মের বহু পূর্ব থেকেই শুরু হয়েছে। প্রাচীন ভারতের সিন্ধু সভ্যতায় (খ্রি.পূ ২৩০০-১৭৫০) হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম জনপ্রিয় ছিল। ১৯২০ সালে খননকার্যের ফলে সেখানে হাতির দাঁতের তৈরি বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু, খোঁপার কাটা, চিরুণি, বোতাম ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়। সিন্ধু এলাকায় হাতির বসতি না থাকলেও হাতির দাঁতের এক বিশাল বাজার গড়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়। বিহারের চম্পানগরে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত হাতির দাঁতের নারীমূর্তি ও খেলনা পাওয়া গেছে। নাগড়া ও মহেশ্বরে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০-২০০ সময়কালের হাড়ের ও হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের বহু নিদর্শন বর্তমান। ইরানের রাজা ১ম দারাউস (খ্রি.পূ ৫২২-৪৮৬) তাঁর সুসা প্রাসাদ সাজাতে হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম ব্যবহার করেছিলেন। গুজরাটে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-২০০ সময়কালের হাতির দাঁতের তৈরি একটি মূর্তি পাওয়া গেছে। পাঞ্জাবের রূপায় প্রায় ৬০০-২০০ খ্রিস্টপূর্বের হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের সন্ধান পাওয়া গেছে। সাঁচীস্তূপে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে বিদিশায় হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের ব্যবসা ছিল। খ্রিস্টীয় ১০ম শতাব্দীর কলিঙ্গ তাম্রলিপিতে হাতির দাঁতের উল্লেখ আছে।

শূঙ্গযুগে (খ্রি.পূ প্রথম শতক) ভারহূত, বোধগয়া ও সাঁচীস্তূপের তোরণের বিভিন্ন অংশ ও বেষ্টনীর ভাস্কর্যকর্মে হাতির দাঁতের শিল্পীদের নিয়োগ করা হয়েছিল। কুষাণ যুগেও হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম বেশ জনপ্রিয় ছিল। তক্ষশীলা ও বেগ্রামে প্রাপ্ত প্রচুর হাতির দাঁতের নিদর্শন তার প্রমাণ। পশ্চিমবঙ্গের চন্দ্রকেতু গড়ে প্রসাধনী কাজে ব্যবহূত শূঙ্গযুগীয় হাতির দাঁতের তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম আবিষ্কৃত হয়েছে।

বাংলাদেশে হাতির দাঁতের তৈরি শিল্পকর্ম ব্যবহারের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় সিলেট অঞ্চলে। সিলেটের ভাটেরা গ্রামে প্রাপ্ত এগারো শতকের ভাটেরা তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, সিলেটের শাসক নারায়ণপুত্র গোবিন্দ কেশবদেবের অনুদানে যে ভাটেরা শিলামন্দির নির্মিত হয়েছিল, তাতে তিনি কারুকার্যের জন্য একজন হাতির দাঁতের শিল্পীকে নিয়োগ করেছিলেন। তাঁর সময়কালে প্রাপ্ত তাম্রলিপিতেও হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের উল্লেখ আছে। ভারতবর্ষের বাইরে গ্রিক, ল্যাটিন, আরব ও চীনা সাহিত্যেও হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের উল্লেখ আছে।

হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের ইংরেজি পারিভাষিক নাম ‘আইভরি’ হওয়ার পেছনে কেউ কেউ বেদের সূত্র উল্লেখ করেন। বেদে  ব্যবহূত ‘হস্তী’ শব্দের প্রতিশব্দগুলির মধ্যে একটি হলো ‘ইভ’। তাই কেউ কেউ মনে করেন এই ’ইভ‘ শব্দ থেকেই ‘আইভরি’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।

হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম

মধ্যযুগের প্রথম দিকে উড়িষ্যা এ শিল্পের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। সেখানে হাতির দাঁত দিয়ে প্রধানত সিংহাসনের পায়া ও আসবাবপত্র তৈরি হলেও মন্দিরের কারুকার্যেও হাতির দাঁত ব্যবহূত হতো। উড়িষ্যার পার্শ্ববর্তী বিহার ও বাংলা অঞ্চলেও এ শিল্পের বেশ প্রভাব ছিল। বাংলাদেশের সিলেট, পশ্চিমবঙ্গের ইদিলপুর ইত্যাদি স্থানে হাতির দাঁতের দক্ষ কারিগরদের বাস ছিল। বোম্বের প্রিন্স অব ওয়েলস মিউজিয়ামে রক্ষিত একটি হাতির দাঁতের নারীমূর্তির সঙ্গে রাজশাহীর  বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর-এর একটি পাথরের মূর্তির সাদৃশ্য লক্ষ করে কেউ কেউ এটাকে দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্ববাংলার শিল্পকর্ম বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা সে সময় পূর্ববাংলা এ শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল।

মুসলমানদের আগমনের পর হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের প্রকৃতিগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। তখন থেকে হাতির দাঁতের তৈরি পায়া, কলমদান, পিঠ চুলকানি, হুক্কার নলের অংশ, তরবারি ও ছোরার হাতল ইত্যাদি শিল্পকর্ম ব্যাপকতা লাভ করে। মুগল আমলে এ শিল্প বেশ সমাদর পায়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের  আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে, কয়েকজন হাতির দাঁতের শিল্পী তাঁদের স্থায়ী কর্মচারী ছিল। ষোলশ শতকে বিদেশী বণিকদের আগমনের পর ভারতবর্ষে এ শিল্পের ওপর বিদেশী শিল্পশৈলীর প্রভাব পড়ে।

ব্রিটিশ ভারতে হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের প্রধান বাজার ছিল ইউরোপ। ব্রিটিশরা আফ্রিকা থেকে হাতির দাঁত আনিয়ে ভারতীয় কারিগরদের দ্বারা শিল্পকর্ম তৈরি করিয়ে সেগুলি ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করত। ভারতীয় জঙ্গলে এবং রাজা-মহারাজাদের পোষা মৃত হাতি থেকেও হাতির দাঁত সংগৃহীত হতো। এ সময় ভারতের লুধিয়াল, পালি, জয়পুর, কেরালা, মহীশূর, আসাম ও বাংলাসহ এ শিল্পকর্মের কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। এ শিল্পকর্মে কোনো বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠী বা শ্রেণী নিয়োজিত ছিল না। ব্রাহ্মণসহ সব বর্ণের হিন্দু এবং মুসলমানরা এ কাজে নিয়োজিত ছিল। উল্লেখ্য, এই শিল্পে উপাদান হিসেবে শুধু হাতির দাঁতই নয়, অন্যান্য প্রাণীর দাঁত ও হাড় ব্যবহূত হতো এবং এখনও হচ্ছে, যেমন: ম্যামথের দাঁত, জলহস্তীর দাঁত, সিন্ধুঘোটকের দাঁত (Walrus ivory), নরহোয়ালের দাঁত (Narwhal ivory), দুগং-এর দাঁত (Dugong ivory), ধনেশ পাখির দাঁত (Hornbill ivory), তিমির দাঁত (Whale’s ivory) ইত্যাদি। বর্তমানে বাংলাদেশে হাতির দাঁতের বদলে বিভিন্ন মাছ ও প্রাণীর হাড় থেকেও নানা ধরনের শিল্পকর্ম তৈরি হচ্ছে, যা দেখতে অনেকটা হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের মতোই।

হাতির দাঁতের শিল্পকর্মে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি সবই প্রায় কাঠের শিল্পকর্মে ব্যবহূত যন্ত্রপাতির অনুরূপ। যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে করাত, ধারালো ছুরি, উখা (মসৃণ করার যন্ত্র), বাইস (চেপে ধরার যন্ত্র), স্ক্র্যাপার, বাটালি, ছোট কাঠের মুগুর, হাতুড়ি, কম্পাস, তুরপুন, লেদ, লোহার কলম ও লেন্স (সূক্ষ্ম কারুকাজ করার সময় এটি চোখে ব্যবহূত হয়)।

এ শিল্পকর্মের নির্মাণপদ্ধতি এখনও অনেকটাই সনাতনী। প্রথমে দাঁতের ফাঁকা অংশ (যা হাতির মুখের ভেতর থাকে) সোডা ও ক্যালসিয়ামসহ সিদ্ধ করে বা কয়েকদিন মাটির নিচে পুঁতে রেখে ভেতরকার মজ্জা পরিষ্কার করা হয়। পরে দাঁতকে শক্ত ও আর্দ্রতামুক্ত করার জন্য দাঁতের সূক্ষ্ম ছিদ্রগুলি গলিত মোম দিয়ে বন্ধ করা হয়। পরে সেগুলি শিল্পকর্মে ব্যবহূত হয়।

হাতির দাঁত দুই ধরনের শক্ত ও নরম। শক্ত দাঁত উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ হয়, কিন্তু তা কাটা কঠিন। অন্যদিকে নরম দাঁত দিয়ে কাজ করা সহজ এবং তাতে ফাটল ধরে না। কাজ শুরুর আগে কল্পিত শিল্পের পরিমাপ অনুযায়ী দাঁত কেটে নেওয়া হয় এবং তার ওপর পেন্সিল দিয়ে নকশাটি অাঁকা হয়। এরপর হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে খোদাইয়ের কাজ শুরু হয়। সূক্ষ্ম কাজগুলি করা হয় লোহার কলম দিয়ে এবং ছিদ্রযুক্ত কাজগুলি করা হয় ড্রিল মেশিনের সাহায্যে। কারিগরের কাজ হয়ে গেলে তা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। এরপর শিল্পকর্মটিকে মসৃণ করার জন্য ব্যবহূত হয় সিরিশ কাগজ, হাতির দাঁতের গুঁড়ো, মাছের  অাঁশ, চীনামাটি ও চক পাউডার। দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যে রুটিফল নামক গাছের পাতার সাহায্যেও এই শিল্পকর্মকে মসৃণ করা হয়। এতে শিল্পকর্ম উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

হাতির দাঁতের নিজস্ব আকর্ষণীয় রঙ থাকতেও কারিগররা শিল্পকর্মকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য কখনো কখনো রং ব্যবহার করে। হরপ্পার শিল্পীরা এতে কালো ও লাল রং মেশাত। মিশরীয়রা লাল, হলুদ, খয়েরি, সবুজ বা কাল রঙে দাঁত ডুবিয়ে রাখে।  বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরএ হাতির দাঁতের যেসব শিল্পকর্ম রয়েছে সেগুলির কোনো কোনোটিতে কালো রঙের সূক্ষ্ম কাজ রয়েছে। এখানে সংগৃহীত শিল্পকর্মের মধ্যে আকর্ষণীয় ও মূল্যবান নিদর্শনটি হচ্ছে হাতির দাঁতের তৈরি পাটি। এর বুননপদ্ধতি শীতলপাটির অনুরূপ। চতুর্দিকে রয়েছে রূপার পাতের চওড়া জ্যামিতিক নকশার সূক্ষ্ম কারুকাজ। পাটিটি সিলেটে তৈরি হয়েছিল। ঢাকার নবাব পরিবার পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য সিলেট থেকে এটি তৈরি করিয়ে এনেছিল। পাটিটির পরিমাপ ২৩০১২৯ সেমি, সময় ঊনিশ শতক। হাতির দাঁতের সূক্ষ্ম অাঁশ তুলে এটি বোনা হয়েছে।

জাতীয় জাদুঘরে বলধা জমিদারের উপহার হিসেবে প্রদত্ত হাতির দাঁতের যেসব শিল্পকর্ম সংরক্ষিত আছে, সেগুলিও সিলেটের তৈরি বলে অনুমান করা হয়। সেগুলির মধ্যে রয়েছে ছোট  পালকি, খড়ম, চিরুণি, জীবজন্তু, সিংহাসন, সিংহাসনের পায়া, দাবার ঘুঁটি, হাওদাসহ হাতি ইত্যাদি। বর্তমানে চট্টগ্রামে মাছ ও পশুর হাড় দিয়ে গলার মালা, খোপার কাঁটা, আংটি, চিরুণি, জীব-জন্তুর প্রতিকৃতি, হাতের চুড়ি ইত্যাদি শৌখিন দ্রব্য তৈরি হচ্ছে। এগুলি দেখতে হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের অনুরূপ। ভারতে বর্তমানে হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হওয়ায় বিভিন্ন পশুপাখির হাড় দিয়ে হাতির দাঁতের অনুরূপ সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম তৈরি হচ্ছে।  [জিনাত মাহরুখ বানু]