হক, সৈয়দ নজমুল

হক, সৈয়দ নজমুল (১৯৪১-১৯৭১)  সাংবাদিক, শহীদ বুদ্ধিজীবী। জন্ম ১৯৪১ সালের ৫ জুলাই খুলনা জেলার কান্দাপাড়া গ্রামে। তাঁর পৈত্রিক নিবাস একই জেলার পয়গ্রাম কসবা গ্রামে। নজমুল হকের শিক্ষা জীবন শুরু হয় নিজ গ্রামের বিদ্যালয়ে। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৬৪ সালে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা এবং ১৯৭০ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

সৈয়দ নজমুল হক

সৈয়দ নজমুল হক প্রগতিশীল আন্দোলন এবং ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক আইন বিরোধী আন্দোলন এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বরে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ কার্জন হল প্রাঙ্গণে আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আন্দোলনে অংশ নেন। এ সময় তিনি মিছিল থেকে গ্রেফতার হন এবং কনভোকেশন মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে কারারুদ্ধ হন। পরে তিনি উচ্চ আদালতের রায়ে মুক্তি পান। ১৯৬৭ সালে সৈয়দ নজমুল হক পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ইনফরমেশন সার্ভিসের জন্য মনোনীত হন। কিন্তু সমাবর্তন মামলায় তাঁর ভূমিকার জন্য পুলিশের ছাড়পত্র না পাওয়ায় চাকরিতে যোগদানে ব্যর্থ হন। পরে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।

ছাত্রাবস্থা থেকেই সৈয়দ নজমুল হক সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তাঁর সম্পাদনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকদের পত্রিকা Vista প্রকাশিত হয়। একই বছর তিনি পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালে (পিপিআই) সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। তিনি Dawn, Pakistan Observer, Dacca Times, Web Unity প্রভৃতি পত্রিকায় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন। এছাড়া তিনি Dacca Times এর সিটি এডিটর এবং কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের ঢাকা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নজমুল হক ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সম্পূর্ণ প্রসিডিংস-এর রিপোর্ট  করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালে জেল থেকে মুক্ত হয়ে অক্টোবরে ইউরোপ সফরে গেলে একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে সৈয়দ নজমুল হক তাঁর সফরসঙ্গী হন। এ সময় তিনি বিবিসি এবং লন্ডন টেলিভিশনে বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও জাতীয়তাবাদের পক্ষে তাঁর জোরালো মতামত তুলে ধরেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈয়দ নজমুল হক পিপিআই-এর চিফ রিপোর্টার পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতন ও নৃশংসতার সংবাদ বহির্বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁর এ ভূমিকার কারণে ৬ আগস্ট সামরিক সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। পরে ২০ সেপ্টেম্বর তাঁকে ঢাকায় নিয়ে এসে নজরবন্দী রাখা হয়। ১৯ অক্টোবর পুনরায় তাঁকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা সৈয়দ নজমুল হককে তাঁর পুরানা পল্টনের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি।

সৈয়দ নজমুল হক ছাত্রাবস্থা থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’ পরিচালনা করেন। তাঁর পরিচালনায় ‘চন্ডালিকা’ নৃত্যনাট্য ১৯৬৭ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলে এবং ১৯৭০ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে মঞ্চস্থ হয়। এছাড়া তিনি নিয়মিত ঢাকা বেতার ও টেলিভিশনে নাটক, কথিকা ও একাঙ্কিকায় অংশগ্রহণ করেন। নজমুল হক ১৯৬০-৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ ১৯৯৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সৈয়দ নজমুল হকের নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।  [এ.টি.এম যায়েদ হোসেন]