হক, এ.কে ফজলুল: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
'''হক, এ.কে ফজলুল '''(১৮৭৩-১৯৬২)'''  '''রাজনীতিবিদ ও জননেতা। তিনি কলকাতার মেয়র (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (১৯৩৭-১৯৪৩) এবং পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী (১৯৫৫) এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের পদ (১৯৫৬-১৯৫৮) সহ বহু উঁচু রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। লোকপ্রিয়ভাবে ‘শেরে বাংলা’ বা হক সাহেব রূপে পরিচিত আবুল কাশেম ফজলুল হক বাকেরগঞ্জ জেলার দক্ষিণাঞ্চলের বর্ধিষ্ণু গ্রাম সাটুরিয়ায় ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল বরিশাল শহর থেকে চৌদ্দ মাইল দূরে চাখার গ্রামে। তিনি ছিলেন মুহম্মদ ওয়াজিদ ও সায়িদুন্নিসা খাতুনের একমাত্র পুত্র। হকের পিতা বরিশাল আদালতের দীউয়ানি ও ফৌজদারি উকিল ছিলেন এবং তাঁর পিতামহ কাজী আকরাম আলী ছিলেন আরবি ও ফারসিতে দক্ষ পন্ডিত ও বরিশালের একজন বিশিষ্ট মোক্তার।
'''হক, এ.কে ফজলুল''' (১৮৭৩-১৯৬২) রাজনীতিবিদ ও জননেতা। তিনি কলকাতার মেয়র (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (১৯৩৭-১৯৪৩) এবং পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী (১৯৫৫) এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের পদ (১৯৫৬-১৯৫৮) সহ বহু উঁচু রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। লোকপ্রিয়ভাবে ‘শেরে বাংলা’ বা হক সাহেব রূপে পরিচিত আবুল কাশেম ফজলুল হক বাকেরগঞ্জ জেলার দক্ষিণাঞ্চলের বর্ধিষ্ণু গ্রাম সাটুরিয়ায় ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল বরিশাল শহর থেকে চৌদ্দ মাইল দূরে চাখার গ্রামে। তিনি ছিলেন মুহম্মদ ওয়াজিদ ও সায়িদুন্নিসা খাতুনের একমাত্র পুত্র। হকের পিতা বরিশাল আদালতের দীউয়ানি ও ফৌজদারি উকিল ছিলেন এবং তাঁর পিতামহ কাজী আকরাম আলী ছিলেন আরবি ও ফারসিতে দক্ষ পন্ডিত ও বরিশালের একজন বিশিষ্ট মোক্তার।


বাড়িতে আরবি ও ফারসিতে সনাতন ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৮৯০ সালে ফজলুল হক বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৯২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ এবং ১৮৯৪ সালে বি.এ. পরীক্ষায় (রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিদ্যা তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ) উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি গণিত শাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
[[Image:HuqAKFazlul.jpg|thumb|400px|এ.কে ফজলুল হক]]
বাড়িতে আরবি ও ফারসিতে সনাতন ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৮৯০ সালে ফজলুল হক বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৯২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ এবং ১৮৯৪ সালে বি.এ পরীক্ষায় (রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিদ্যা তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ) উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি গণিত শাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।


১৮৯৭ সালে কলকাতার ‘ইউনিভার্সিটি ল কলেজ’ থেকে বি.এল ডিগ্রি লাভ করে ফজলুল হক স্যার আশুতোষ মুখার্জীর অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। বহুরূপে ও বিভিন্নভাবে  [[দত্ত, অশ্বিনীকুমার|অশ্বিনীকুমার দত্ত]] এবং  প্রফুল্লচন্দ্র রায় এর স্নেহলাভের সৌভাগ্য হকের হয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পর হক বরিশাল শহরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৩-১৯০৪ সময়কালে তিনি এ শহরের রাজচন্দ্র কলেজে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে হক সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতেও তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯০৮ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত হক ছিলেন সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার। সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি জনসেবামূলক কাজ ও আইন ব্যবসাকে বেছে নেন। স্যার আশুতোষ মুখর্জীর পরামর্শে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
১৮৯৭ সালে কলকাতার ‘ইউনিভার্সিটি ল কলেজ’ থেকে বি.এল ডিগ্রি লাভ করে ফজলুল হক স্যার আশুতোষ মুখার্জীর অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। বহুরূপে ও বিভিন্নভাবে  [[দত্ত, অশ্বিনীকুমার|অশ্বিনীকুমার দত্ত]] এবং  প্রফুল্লচন্দ্র রায় এর স্নেহলাভের সৌভাগ্য হকের হয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পর হক বরিশাল শহরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৩-১৯০৪ সময়কালে তিনি এ শহরের রাজচন্দ্র কলেজে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে হক সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতেও তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯০৮ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত হক ছিলেন সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার। সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি জনসেবামূলক কাজ ও আইন ব্যবসাকে বেছে নেন। স্যার আশুতোষ মুখর্জীর পরামর্শে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
[[Image:HuqAKFazlul.jpg|thumb|400px|এ.কে ফজলুল হক]]


স্যার  [[সলিমুল্লাহ, খাজা|খাজা সলিমুল্লাহ]] ও নওয়াব  নওয়াব আলী চৌধুরীর কাছে রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি হয়। তাঁদের সহযোগিতায় ১৯১৩ সালে তিনি তাঁর শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রায়বাহাদুর কুমার মহেন্দ্রনাথ মিত্রকে পরাজিত করে ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মাঝখানে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে দুবছর সময়কাল (১৯৩৪-১৯৩৬) ছাড়া ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় আইন সভার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯১৩ সালে হক বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক হন এবং ১৯১৬ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। সর্বভারতীয়  মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক রূপেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত হক ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য রূপে তিনি সে সংগঠনের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। হক ছিলেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ১৯১৬ সালে লক্ষ্মৌ চুক্তি প্রণয়নে সহায়কদের অন্যতম। ১৯১৭ সালে হক ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক এবং ১৯১৮-১৯১৯ সালে তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রূপে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৮ সালে ফজলুল হক সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের দিলি­ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯১৯ সালে ফজলুল হক জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য মতিলাল নেহরু,  [[দাশ, চিত্তরঞ্জন|চিত্তরঞ্জন দাস]] ও অন্যান্য বিশিষ্ট নেতাদের নিয়ে  [[ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস|ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস]] কর্তৃক গঠিত পাঞ্জাব তদন্ত কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯২০ সালে হক বাংলা প্রাদেশিক সম্মেলনের মেদিনীপুর অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন।
স্যার  [[সলিমুল্লাহ, খাজা|খাজা সলিমুল্লাহ]] ও নওয়াব  নওয়াব আলী চৌধুরীর কাছে রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি হয়। তাঁদের সহযোগিতায় ১৯১৩ সালে তিনি তাঁর শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রায়বাহাদুর কুমার মহেন্দ্রনাথ মিত্রকে পরাজিত করে ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মাঝখানে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে দুবছর সময়কাল (১৯৩৪-১৯৩৬) ছাড়া ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় আইন সভার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯১৩ সালে হক বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক হন এবং ১৯১৬ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। সর্বভারতীয়  মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক রূপেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত হক ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য রূপে তিনি সে সংগঠনের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। হক ছিলেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ১৯১৬ সালে লক্ষ্মৌ চুক্তি প্রণয়নে সহায়কদের অন্যতম। ১৯১৭ সালে হক ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক এবং ১৯১৮-১৯১৯ সালে তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রূপে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৮ সালে ফজলুল হক সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের দিলি­ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯১৯ সালে ফজলুল হক জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য মতিলাল নেহরু,  [[দাশ, চিত্তরঞ্জন|চিত্তরঞ্জন দাস]] ও অন্যান্য বিশিষ্ট নেতাদের নিয়ে  [[ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস|ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস]] কর্তৃক গঠিত পাঞ্জাব তদন্ত কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯২০ সালে হক বাংলা প্রাদেশিক সম্মেলনের মেদিনীপুর অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন।

০৮:৩৬, ২৫ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

হক, এ.কে ফজলুল (১৮৭৩-১৯৬২) রাজনীতিবিদ ও জননেতা। তিনি কলকাতার মেয়র (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (১৯৩৭-১৯৪৩) এবং পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী (১৯৫৫) এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের পদ (১৯৫৬-১৯৫৮) সহ বহু উঁচু রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। লোকপ্রিয়ভাবে ‘শেরে বাংলা’ বা হক সাহেব রূপে পরিচিত আবুল কাশেম ফজলুল হক বাকেরগঞ্জ জেলার দক্ষিণাঞ্চলের বর্ধিষ্ণু গ্রাম সাটুরিয়ায় ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল বরিশাল শহর থেকে চৌদ্দ মাইল দূরে চাখার গ্রামে। তিনি ছিলেন মুহম্মদ ওয়াজিদ ও সায়িদুন্নিসা খাতুনের একমাত্র পুত্র। হকের পিতা বরিশাল আদালতের দীউয়ানি ও ফৌজদারি উকিল ছিলেন এবং তাঁর পিতামহ কাজী আকরাম আলী ছিলেন আরবি ও ফারসিতে দক্ষ পন্ডিত ও বরিশালের একজন বিশিষ্ট মোক্তার।

এ.কে ফজলুল হক

বাড়িতে আরবি ও ফারসিতে সনাতন ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৮৯০ সালে ফজলুল হক বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৯২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ এবং ১৮৯৪ সালে বি.এ পরীক্ষায় (রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিদ্যা তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ) উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি গণিত শাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৮৯৭ সালে কলকাতার ‘ইউনিভার্সিটি ল কলেজ’ থেকে বি.এল ডিগ্রি লাভ করে ফজলুল হক স্যার আশুতোষ মুখার্জীর অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। বহুরূপে ও বিভিন্নভাবে  অশ্বিনীকুমার দত্ত এবং  প্রফুল্লচন্দ্র রায় এর স্নেহলাভের সৌভাগ্য হকের হয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পর হক বরিশাল শহরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৩-১৯০৪ সময়কালে তিনি এ শহরের রাজচন্দ্র কলেজে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে হক সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতেও তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯০৮ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত হক ছিলেন সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার। সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি জনসেবামূলক কাজ ও আইন ব্যবসাকে বেছে নেন। স্যার আশুতোষ মুখর্জীর পরামর্শে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

স্যার  খাজা সলিমুল্লাহ ও নওয়াব  নওয়াব আলী চৌধুরীর কাছে রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি হয়। তাঁদের সহযোগিতায় ১৯১৩ সালে তিনি তাঁর শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রায়বাহাদুর কুমার মহেন্দ্রনাথ মিত্রকে পরাজিত করে ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মাঝখানে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে দুবছর সময়কাল (১৯৩৪-১৯৩৬) ছাড়া ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় আইন সভার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯১৩ সালে হক বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক হন এবং ১৯১৬ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। সর্বভারতীয়  মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক রূপেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত হক ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য রূপে তিনি সে সংগঠনের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। হক ছিলেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ১৯১৬ সালে লক্ষ্মৌ চুক্তি প্রণয়নে সহায়কদের অন্যতম। ১৯১৭ সালে হক ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক এবং ১৯১৮-১৯১৯ সালে তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রূপে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৮ সালে ফজলুল হক সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের দিলি­ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯১৯ সালে ফজলুল হক জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য মতিলাল নেহরু,  চিত্তরঞ্জন দাস ও অন্যান্য বিশিষ্ট নেতাদের নিয়ে  ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক গঠিত পাঞ্জাব তদন্ত কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯২০ সালে হক বাংলা প্রাদেশিক সম্মেলনের মেদিনীপুর অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন।

১৯১৯ সালে হক খিলাফত আন্দোলনে যোগদান করেন। কিন্তু অসহযোগের প্রশ্নে কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। ১৯২০ সালে কংগ্রেস-গৃহীত অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্রিটিশ পণ্য ও উপাধি বর্জনের তিনি সমর্থন করেন। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের পশ্চাৎপদ অবস্থার কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করে তিনি স্কুল ও কলেজ বর্জনের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন। বর্জনের সিদ্ধান্ত মুসলমান ছেলেমেয়েদের অগ্রগতিতে বাধার সৃষ্টি করবে এটা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। সুতরাং তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন।

১৯২০ সালে হক,  কাজী নজরুল ইসলাম ও  মুজাফ্ফর আহমদ মিলে  নবযুগ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর সরকারবিরোধী নীতির কারণে এ পত্রিকার জামানত বহুবারই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ফলে দীর্ঘদিনব্যাপী এ দৈনিক পত্রিকা চালানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। মুসলমানদের শিক্ষার জন্য তিনি তাঁর যথেষ্ট সময় ব্যয় করেন এবং মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। বাংলায় দ্বৈতশাসনামলে ১৯২৪ সালে প্রায় ছয়মাসের জন্য হক শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দেশে শিক্ষা সংক্রান্ত অবকাঠামো সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। মুসলিম এডুকেশনাল ফান্ড গঠন করে তিনি যোগ্য মুসলমান ছাত্রদের সাহায্য করেন। মুসলমান ছাত্রদের ফারসি ও আরবি শিক্ষাদানের জন্য তিনি বাংলায় একটি পৃথক মুসলমান শিক্ষা পরিদপ্তরও গঠন করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সকল সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলমান ছাত্রদের জন্য আসন সংরক্ষণেরও তিনি ব্যবস্থা করেছিলেন। বাংলায় মাদ্রাসা শিক্ষার নতুন কাঠামো তৈরিতেও তাঁর ভূমিকা ছিল।

গ্রামীণ অভিজাতদের তাঁর শক্তির ভিত্তিরূপে গড়ে তোলা ছিল এ.কে ফজলুল হকের রাজনৈতিক কৌশল। স্বল্পস্থায়ী কলকাতা কৃষি সমিতি (১৯১৭) এবং বেঙ্গল প্রজা পার্টি নামে আরও একটি স্বল্পস্থায়ী সংগঠন প্রতিষ্ঠায় তাঁর উদ্যোগ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এ পার্টিই পরবর্তীকালে  নিখিলবঙ্গ প্রজা সমিতি নামে একটি নিয়মিত আধা-রাজনৈতিক সংগঠনে রূপান্তরিত হয়েছিল। স্যার  আবদুর রহিম এর সভাপতি এবং তিনি নিজে এবং খান বাহাদুর আবদুল মোমিন এর সহসভাপতি হয়েছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই দুনেতার মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিরোধ দেখা দেয়। সমিতিতে হকের উপদল ১৯৩৫ সালে এর নাম পরিবর্তন করে  কৃষক প্রজা পার্টি (কে.পি.পি) রাখে। হকের নেতৃত্বে কেপিপি এক গণ-আন্দোলন শুরু করে। কৃষকদের অধিকার পুনরুদ্ধার,  মহাজন ও  জমিদারদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের মুক্তিদান এবং জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে রায়তদের জমির মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা ছিল এ আন্দোলনের উদ্দেশ্যে। এ সব শ্লোগান ১৯৩৫ সালের আইনের বলে ভোটাধিকার লাভকারী কৃষিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে কে.পি.পি-কে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে হক অংশগ্রহণ করলেও তাঁর মনোযোগ প্রধানত বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৩৪ সালে এম.এ জিন্নাহ্ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি হন। মুসলিম লীগের কর্মসূচিতে হক খুশি ছিলেন না। জিন্নাহ্র সঙ্গে তার পার্থক্য তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৯৩৫ সালের আইনের অধীনে নির্বাচনের সময় এটা বিশেষভাবে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়। ১৯৩৬ সালে ফজলুল হক তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারের খসড়া তৈরি করেন এবং তাঁর নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় তিনি জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের তীব্র বিরোধিতা করেন। হক জনগোষ্ঠীর সকল অংশ নিয়ে এক নতুন বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন বলে তাঁর নির্বাচনী ইশতেহার বাংলার জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মুসলমান জনগোষ্ঠী থেকে মুসলিম লীগকে বিচ্ছিন্ন করে হক তার বিজয়কে সহজতর করেছিলেন। পটুয়াখালী নির্বাচনী এলাকায় তিনি স্যার  খাজা নাজিমউদ্দীনকে পরাজিত করেন।

১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কে.পি.পি আইন সভায় তৃতীয় বৃহত্তম দলরূপে আবির্ভূত হয়। কংগ্রেস প্রথম ও মুসলিম লীগ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল এবং বাংলার রাজনীতিতে হক একজন শক্তিশালী ব্যক্তিরূপে আবির্ভূত হন। তিনি বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে একটি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করতে চেয়েছিলেন। বস্ত্তত, হক-কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ ধরনের মন্ত্রিসভা গঠনে রাজি না হওয়ায় হক অত্যন্ত বিব্রত ও হতাশ হন। এ রকম পরিস্থিতিতে হক মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করতে বাধ্য হন। জিন্নাহ্ আগ্রহের সঙ্গে এ সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলেন। এভাবে ১৯৩৭ সালে বাংলায় হককে মুখ্যমন্ত্রী করে হক-লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টির অভাবে জিন্নাহ্র সমর্থকরা যে বাংলায় তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না।

মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কার্যকর করতে হক সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ মন্ত্রিসভার সুযোগ নিয়ে লীগ নেতাদের একাংশ ধর্মীয় উপদলীয়তাকে উদ্দীপিত করে। ১৯৩৯ সাল নাগাদ তারা বাংলার শহর ও গ্রামাঞ্চলের সর্বত্রই তাদের প্রভাব বিস্তার করে। জিন্নাহ্র সমর্থকদের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মুসলমান জনসাধারণের রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ব্যক্তিগত জীবনে হক ধর্মীয় উপদলীয়তা থেকে মুক্ত হলেও মন্ত্রিসভার কাজ চালাতে তাঁকে লীগের সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়েছিল। মুসলমান সম্প্রদায়ের সদস্যরূপে তাঁর স্বতন্ত্র পরিচয় সম্পর্কে হক অধিকতর সচেতন হয়ে ওঠেন যা মাঝে মাঝে তাঁর বক্তৃতায় প্রকাশ পেত। স্বভাবতই হক ছিলেন তখন লীগের মধ্যে সবচেয়ে অনুগ্রহপুষ্ট ব্যক্তি। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে লোকপ্রিয়ভাবে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে অভিহিত  লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য জিন্নাহ্ তাঁকে নির্বাচিত করেন।

হক মন্ত্রিসভা (১৯৩৭-১৯৪৩)  ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর আইন সভায় কোনো দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করায় একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। কংগ্রেস কোয়ালিশনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে ৩৫ জন সদস্যের কে.পি.পি সংসদীয় দলের নেতা এ.কে. ফজলুল হক মুসলিম লীগ ও অন্য কয়েকটি সংখ্যালঘু ও তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত গোষ্ঠীকে কোয়ালিশন সরকার গঠনে তাঁর সঙ্গে যোগদানে রাজি করাতে সফল হন। কোয়ালিশন দলের নেতারূপে ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল ফজলুল হক বাংলা সরকারের মুখ্যমন্ত্রী রূপে অধিষ্ঠিত হন। গভর্নর স্যার অ্যান্ডারসন (১৯৩২-১৯৩৭) যে মন্ত্রিসভা নিয়োগ করেন তাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক ছাড়া নিম্নলিখিত পাঁচ জন হিন্দু ও পাঁচ জন মুসলমান মন্ত্রী ছিলেন: নলিনীরঞ্জন সরকার (অর্থ), বিজয়প্রসাদ সিংহ রায় (রাজস্ব), মহারাজা শিরিষচন্দ্র নন্দী (যোগাযোগ ও পূর্ত), প্রসন্নদেব রাইকুত (বন ও অন্তঃশুল্ক), মুকুন্দবিহারী মলি­ক (সমবায় ঋণদান ও গ্রামীণ ঋণবদ্ধতা), স্যার খাজা নাজিমউদ্দীন (স্বরাষ্ট্র), নওয়াব  খাজা হাবিবুল­াহ বাহাদুর (কৃষি ও শিল্প),  হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী (বাণিজ্য ও শ্রম),  নওয়াব মুশাররফ হোসেন (বিচার ও আইন) এবং  সৈয়দ নওশের আলী (জনস্বাস্থ্য ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন)।

যে মন্ত্রিসভা প্রদেশের প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করে তা ছিল বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মিশ্রণ, যাদের আদর্শগত অবস্থান ছিল ভিন্ন। ফজলুল হকের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সুযোগ্য নেতৃত্বের ফলেই এ ঐক্য সম্ভব হয়েছিল, কেননা তিনি ছিলেন উভয় সম্প্রদায়েরই আস্থাভাজন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই কোয়ালিশনে দলগত বিতর্ক ও কলহ শুরু হয় এবং অনেকেই দলত্যাগ করেন। অংশত এটা ঘটেছিল ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আনুগত্য পরিবর্তন, ব্রিটিশ রাজকীয় স্বার্থের পারস্পরিক ক্রিয়া, শাসনতন্ত্রকে কার্যকর করতে কংগ্রেসের অনমনীয়তা এবং প্রদেশের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ লাভে লীগের দৃঢ় সংকল্পের কারণে। কোয়ালিশন দলের মতদ্বৈধতা ও ঝগড়ার অধিকাংশই ঘটেছিল প্রজাস্বত্ব ও ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার, প্রজাস্বত্ব অধিকার, শিক্ষানীতি এবং গ্রামীণ ঋণবদ্ধতার মতো বিষয় নিয়ে। এগুলি সব দলেরই সুবিধাভোগী শ্রেণির স্বার্থের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

কৃষক প্রজা পার্টি ও লীগের নির্বাচনী কর্মসূচির মধ্যে কিছু কিছু সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও প্রথমোক্তটি ভূমি সম্বন্ধীয় মৌলিক সংস্কারের উপর জোর দিয়েছিল; এ ব্যাপারে এবং সম্প্রাদায়িকতার প্রতি ঘৃণায় প্রজা পার্টি কংগ্রেসের কাছাকাছি ছিল। অন্যদিকে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদের কৌশলের প্রতি লীগ ছিল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তারা ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার বিলোপের বিরুদ্ধে। লীগের প্রতিক্রিয়াশীল কর্মসূচি মেনে নিলেও প্রজা পার্টি, বিশেষত এর প্রগতিশীল সদস্যগণ ছিলেন বাংলার কৃষক ও প্রজাদের ভাগ্য পরিবর্তনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান এবং পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা।

কোয়ালিশনের দু বড় শরিক দল লীগ ও কৃষক পার্টির মধ্যে বোঝাপড়ার অভাবে এবং লীগের ও অন্যান্য বিচ্ছিন্ন দলগোষ্ঠীর ভূমি ও বাণিজ্যে কায়েমি স্বার্থ থাকায় নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় প্রতিশ্রুত সংস্কারের বাস্তবায়নের জন্য প্রজা পার্টির প্রগতিবাদীরা চাপ দিলে হক মন্ত্রিসভা শুরু থেকেই দলাদলির শিকার হয়ে পড়ে। গভর্নর তার বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের জন্য অভিযুক্ত ও কারারুদ্ধ হওয়ার কারণে মন্ত্রিসভায় প্রজা পার্টির সম্পাদক শামসুদ্দীনের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করলে কোয়ালিশন দলের সাধারণ স্তরের কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষের প্রথম চিহ্ন দেখা দেয়। গভর্নর মন্ত্রিসভায় প্রজা পার্টির অন্য একজন প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তিরও বিরোধিতা করেছিলেন। এ অবস্থায় মন্ত্রিসভায় হকের পক্ষে নিজের অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি নিজে এবং নওশের আলী ছাড়া মন্ত্রিসভার অন্য সব মুসলিম সদস্যই ছিলেন মুসলিম লীগের। এটা প্রজা পার্টির প্রগতিবাদী কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

হকের সমস্যাবলি সত্ত্বেও প্রজা পার্টি জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, সকল দমনমূলক আইন বাতিল এবং সকল রাজবন্দি ও বিনা বিচারে আটক ব্যক্তিদের মুক্তিসহ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য চাপ দিয়েছিল। ১৯৩৭ সালের ২৯ জুলাই তারিখে অনুষ্ঠিত প্রথম বাজেট অধিবেশনে ভোট গ্রহণের সময় পার্টির বেশ কয়েকজন সদস্য শামসুদ্দীনের নেতৃত্বে কংগ্রেসের পক্ষে ভোট দিলে প্রজা পার্টির অভ্যন্তরীণ ধূমায়িত উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে। কিছুদিন পর ফজলুল হক কর্তৃক নির্বাচনী অঙ্গীকার ভঙ্গের অজুহাতে প্রজা পার্টির প্রগতিবাদী ২১ জন সদস্য কোয়ালিশন ত্যাগ করেন। দলত্যাগের এ নাটকে লীগ সুবিধা লাভ করে এবং আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সমর্থনের জন্য হক লীগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। লীগের প্ররোচনায় হক দলত্যাগীদের ইসলামের স্বার্থের বিরোধী বলে ঘোষণা করেন।

বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হক কিছু যুক্তিসঙ্গত শর্তে জোট গঠনের প্রস্তাব নিয়ে কংগ্রেসের দ্বারস্থ হন। কিন্তু কংগ্রেস কর্তৃক প্রত্যাখাত হলে হক মুসলিম লীগের আরও বেশি নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েন। ১৯৩৭ সালের ১৫ অক্টোবর লক্ষ্ণৌতে হক আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম লীগের মতবাদ গ্রহণ করেন। তিনি বাংলার কোয়ালিশনের সকল মুসলিম সদস্যকে লীগে যোগদানের এবং লীগের পতাকাতলে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান। প্রকাশ্যে প্রজাপার্টির সঙ্গে হক তাঁর সম্পর্ক ছেদ না করলেও তাঁর নেতৃত্ব ছাড়া বস্ত্তত পার্টি মর্যাদা হারিয়ে ফেলে এবং জনসাধারণের মধ্যে হকের জনপ্রিয়তাও হ্রাস পেতে শুরু করে।

দুটি উপদলের পক্ষত্যাগের ফলে কোয়ালিশনের উপর হকের নিয়ন্ত্রণ আরও দ্রুত শিথিল হতে থাকে। ১৯৩৮ সালের ১৫ মার্চ তমিজউদ্দীন খানের নেতৃত্বে প্রজা পার্টির ১৩ সদস্যের একটি দলছুট গোষ্ঠী কোয়ালিশনের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে। তাঁকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত না করায়  তমিজউদ্দীন খান হকের প্রতি বিরূপভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি প্রস্তাবিত ভূমি-রাজস্ব কমিশনের কর্মপরিধি সম্পর্কে আপত্তিকে তাঁর সমর্থন প্রত্যাহারের কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন। গান্ধী ও  শরৎ বসুর প্ররোচনায় তফসিলি সম্প্রদায়ের ১৫ জন সদস্য সরকারি দল ত্যাগ করলে ১৯৩৮ সালের ১৮ মার্চ আরেকটি দলত্যাগের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ দলত্যাগের ঘটনার পর মন্ত্রিসভা আরও বেশি মুসলিম মন্ত্রিসভার চরিত্র পরিগ্রহ করে এবং একতরফাভাবে শুধু মুসলিম স্বার্থের প্রবক্তারূপে আত্মপ্রকাশ করে।

১৯৩৮ সালের ২২ জুন মন্ত্রী এবং আইনসভায় প্রজা পার্টির উপনেতা নওশের আলী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ না করেও কোয়ালিশনের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে লীগের উপর হকের নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে যায়। অভূতপূর্ব এ কর্মপন্থা বেছে নিয়ে নওশের আলী সংসদীয় রীতি অনুসরণ করে গোটা মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগে বাধ্য করে বিস্তৃত ভিত্তির একটি স্থিতিশীল মন্ত্রিসভা গঠনের সুযোগ খুঁজছিলেন। গভর্নর গোটা মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিলে সৃষ্ট অচলাবস্থার অবসান ঘটে, তবে অবিলম্বেই নওশের আলীকে ছাড়া এ মন্ত্রিসভাকে পুনর্বহাল করা হয়। কার্যত একটি নতুন মন্ত্রিসভা দায়িত্ব গ্রহণ করে। তবে এ নাটক চলাকালে আইনসভার অধিবেশন না চলায় মন্ত্রিসভাকে তখনই এর সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হয় নি। কোয়ালিশনের প্রতি তাঁর সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় নওশের আলী প্রকাশ করেন যে, মন্ত্রিসভার রক্ষণশীল সদস্যবৃন্দ কায়েমি স্বার্থবাদীদের সহযোগিতায় বাংলার কৃষকদের বিরুদ্ধে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। তাঁর অভিযোগের পরপরই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আদান-প্রদানকৃত ব্যক্তিগত পত্রাবলির বেশ কয়েকটি একতরফাভাবে প্রকাশ করেন। ভূমির ভোগদখল-স্বত্ব সম্পর্কে তাঁর তীক্ষ্ণ মতামতের জন্য নওশের আলী সুপরিচিত ছিলেন এবং ভবিষ্যতে তিনি যে মৈত্রীর জন্য কংগ্রেসের প্রতি দৃষ্টি রেখেছিলেন তা স্পষ্টত প্রতীয়মান ছিল।

কালক্রমে প্রজা পার্টির অবক্ষয় ঘটলে লীগের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না এবং মন্ত্রিসভার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু আর্থ-সামাজিক সংস্কার থেকে সরে গিয়ে সাম্প্রদায়িক বিষয়ে নিবদ্ধ হয়। বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ১৯৩৮ সালের আগস্ট মাসে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কংগ্রেস-প্রস্তাবিত বেশ কয়েকটি অনাস্থা প্রস্তাব আইনসভায় পেশ করা হয়। অবশ্য ২৫ জন ইউরোপীয় সদস্যের দৃঢ় সমর্থন লাভ করে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিসভা টিকে যায়। বিনিময়ে ইউরোপীয়রা পাটশিল্পে বহু সুবিধা আদায় করে নেয় যা মূল উৎপাদনকারীদের স্বার্থের পরিপন্থি হয়েছিল। ফসল কাটার মৌসুমে মিল মালিকরা আকস্মিকভাবে তাদের উৎপাদন কমিয়ে দেয় যা বিক্রয়যোগ্য একটি প্রধান ফসলের চাষীদের অসাশ্রয়ী মূল্য গ্রহণ করতে বাধ্য করে। তখন মন্ত্রিসভার অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে ইউরোপীয়দের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। নতুন এ অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হক তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রজা পার্টির সহকর্মীদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেন। আলোচনার পর হক ১৯৩৮ সালের ১৭ নভেম্বর শামসুদ্দীন ও তমিজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভায় যোগদানে রাজি করাতে সক্ষম হন। শামসুদ্দীন অবশ্য অতিরক্ষণশীল সদস্যে পূর্ণ মন্ত্রিসভায় দলগত সদস্য হিসেবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৩৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন। অচিরেই হককে আবার সঙ্কটময় অবস্থায় ফেলে তমিজউদ্দীন মুসলিম লীগে যোগদান করেন।

প্রজা পার্টির প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে হকের সমঝোতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি অন্য এক দিকে এক নতুন সঙ্কট মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মন্ত্রিসভার মুসলমান সদস্যদের ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজকীয় যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ভাইসরয়কে মন্ত্রিসভার পূর্ণ সহযোগিতার নিশ্চয়তা প্রদান সম্পর্কে আইনসভায় যুদ্ধপ্রস্তাব নিয়ে বিতর্কের অজুহাতে মন্ত্রিসভার বর্ণ-হিন্দু মন্ত্রী নলিনীরঞ্জন সরকার ১৯৩৯ সালের ২০ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। সরকারের পদত্যাগের তাৎক্ষণিক ফল ছিল সাম্প্রদায়িক বিভক্তির তীব্রতা বৃদ্ধি এবং এটা বিভক্ত দলের মধ্যে ক্ষমতার অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে এক কঠিন সমস্যার সৃষ্টি করে। বৈধানিক রাজনীতির পারস্পরিক ক্রিয়া সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রসারিত করে।

অনেকগুলি বিভাজক শক্তি ক্রিয়াশীল থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার আইন প্রণয়ন ও প্রশাসনিক কৃতিত্ব ছিল উলে­খযোগ্য। তবে বহু পদক্ষেপই সাধারণ মানুষের জন্য উপকারী হলেও হিন্দুরা সেগুলিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের স্বার্থে করা হয়েছিল বলে মনে করে যা আইনসভার ভিতরে ও বাইরে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে হিন্দু-বিরোধিতাকে যথেষ্ট মদদ যোগায়। হিন্দুদের ক্রমবর্ধমান বিরোধিতা উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার বিরুদ্ধে রক্ষণশীল মুসলমানদের কঠিন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে সাহায্য করেছিল।

দুঃসাধ্য হলেও এ পর্যন্ত ফজলুল হক তাঁর মন্ত্রিসভার বিরোধী পক্ষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন; কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তিনি এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। ১৯৪১ সালের জুলাই মাসে জিন্নাহর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফজলুল হক ভাইসরয়ের প্রতিরক্ষা পরিষদে যোগদান করলে জিন্নাহ্ তাঁকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করে এবং কোয়ালিশন দল থেকে লীগকে প্রত্যাহার করে এর পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এ নাটকীয় পরিস্থিতি অবশ্য হককে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে নতুনভাবে রাজনৈতিক মৈত্রী গঠনের এক অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছিল।

১৯৪১ সালের ২ ডিসেম্বর হক পদত্যাগ করেন, তবে তিনি প্রজা পার্টির প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিবর্গ, কংগ্রেসের বসু গ্রুপ সহ অধিকাংশ হিন্দু সদস্য এবং হিন্দু মহাসভার রক্ষণশীল সংস্কারবাদীদের নিয়ে বিস্তৃত ভিত্তির একটি প্রগতিশীল কোয়ালিশন গঠন করতে সক্ষম হন। গভর্নরের লীগ-প্রধান একটি মন্ত্রিসভাকে অধিষ্ঠিত করার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পরই শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা রূপে পরিচিত এ নতুন মন্ত্রিসভা ১৯৪১ সালের ১২ ডিসেম্বর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।

কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লক কংগ্রেস,  হিন্দু মহাসভা, কৃষক প্রজা পার্টি (শামসুদ্দীন), নির্দলীয়  তফসিলি সম্প্রদায় এবং  কৃষক প্রজা পার্টি (হক) সহ সংসদীয় বিভিন্ন গ্রুপের সমর্থনপুষ্ট হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় আটজন মন্ত্রী ও একজন পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন। এরা হলেন: খাজা হাবিবুল­াহ্, খান বাহাদুর আবদুল করিম, খান বাহাদুর হাশেম আলী খান,  শামসুদ্দীন আহমদশ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, সন্তোষকুমার বসু, প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং উপেন্দ্রনাথ বর্মণ। শুধু লীগ ছাড়া এটা ছিল প্রায় সর্বদলীয় এক মন্ত্রিসভা।

নতুন মন্ত্রিসভায় বিভিন্ন মতের প্রতিনিধিত্ব এবং বেশ কিছু দক্ষ লোকের সমাবেশ ছিল। তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ফজলুল হকের সঙ্গে মুখোপাধ্যায়ের সমঝোতা ও মিলন অনেকের মনে হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক পুনর্মিলনের সম্ভাবনার এক নতুন যুগের আগমন বার্তা ঘোষণা করেছিল। লীগের উপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত হয়ে ফজলুল হক তখন সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য একটি স্থায়ী কর্মসূচি শুরু করার আশা করেন। নতুন কোয়ালিশনের স্থায়িত্বকালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও বজায় ছিল। কিন্তু প্রাদেশিক গভর্নর স্যার জন হার্বাটের (১৯৩৯-১৯৪৩) চক্রান্তে প্রগতিশীল কোয়ালিশনের কর্মসূচি বানচাল হয়ে যায়। লীগনেতা খাজা নাজিমউদ্দীনের তুলনায় ফজলুল হকের উদ্ধত ও কঠোর মনোভাবের কারণে হকের প্রতি গভর্নর বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে থাকেন। ব্যক্তিত্বের বিষয় ছাড়াও ইউরোপীয় সদস্যরা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন একটি মন্ত্রিসভা অধিষ্ঠিত করতে হার্বাটকে বাধ্য করেছিল। ‘‘কলকাতা ত্রয়ী’’ উপনামে পরিচিত এম.এ.এইচ ইস্পাহানি, কে. নূরউদ্দীন এবং এ.আর. সিদ্দিকীদের মধ্যদেশীয় একটি মুসলিম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী জিন্নাহ্র আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ফজলুল হককে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাঁরা আইনসভারও সদস্য ছিলেন।

মুসলিম লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে হক ও তার নতুন কোয়ালিশনের বিরুদ্ধে নিষ্ঠার সঙ্গে এর সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে। মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলিত হয়ে হক মুসলমানদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছেন, এটি ছিল মুসলিম লীগের প্রচারণার মূল বিষয়। হক মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করার জন্য মুসলিম লীগ গভর্ণরের কাছে আবেদন জানায়। মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে লীগের আক্রমণের সঙ্গে আরও কিছু দুর্বিপাক যুক্ত হয়। জাপানি আক্রমণের ভয় এবং সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ১৯৪২ সালে বাস্তবায়িত ‘‘প্রত্যাখ্যান নীতি’’ বদ্বীপ এলাকায় বেশ কষ্টকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ২৬ অক্টোবর এক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলবর্তী এলাকায় আঘাত হানে; কিন্তু আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের কারণে ত্রাণ তৎপরতা ব্যাহত হয়। ৩ আগষ্ট ঢাকা কারাগারে বেশ কয়েকজন কয়েদি গুলিবিদ্ধ হয়, কিন্তু আবারও আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের ফলে কোনো তদন্ত সম্ভব হয় নি। ৯ আগস্ট কংগ্রেস  ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু করলে প্রশাসন আরেকটি প্রচন্ড চাপের সম্মুখীন হয়। এরপরেই ব্যাপক ব্রিটিশ নিপীড়ন শুরু হয়। সমগ্র প্রদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মন্ত্রিসভার কাজে গভর্নরদের হস্তক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদে মুখোপাধ্যায় পদত্যাগ করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।

১৯৪৩ সালের ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী আইনসভায় প্রকাশ করেন যে, অবাধ ক্ষমতার আবরণে গভর্নর বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রিসভা প্রদত্ত পরামর্শ অগ্রাহ্য করেছেন এবং তিনি সে সবের তালিকাও পেশ করেন। গভর্নর এসব অভিযোগ সহজভাবে গ্রহণ করেন নি এবং প্রধানত তাঁর উদ্যোগেই ২৪ ও ২৭ মার্চ আইনসভায় অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করা হয়। দুবারই সামান্য ব্যবধানে হলেও প্রস্তাবগুলি নাকচ হয়ে যায়। তাঁর আদেশ কার্যকর করতে ২৮ মার্চ গভর্নর হককে একটি তৈরি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষরের নির্দেশ দেন এবং শাসনতন্ত্রের ৯৩ ধারা বলে তিনি নিজেই প্রদেশের প্রশাসনিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এক মাস পর নাজিমউদ্দীনকে মুখ্যমন্ত্রী করে লীগের প্রাধান্য বিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা নিয়োগ করা হয়।

প্রথম মন্ত্রিসভার আমলে (১৯৩৭-১৯৪১) হক কৃষকদের দুঃখকষ্ট মোচনের জন্য কিছু প্রশংসনীয় কাজ করেছিলেন। তিনি ‘Bengal Agricultural Debtors' Act’ (১৯৩৮) কার্যকর করে উচ্চহারে সুদ নেয় এমন মহাজনদের কবল থেকে দরিদ্র কৃষকদের রক্ষা করেন। তিনি বাংলার সব এলাকায়  ঋণ সালিশি বোর্ডও স্থাপন করেছিলেন। ‘Money Lenders' Act’ (১৯৩৮) এবং ১৯৩৮ সালের ‘Bengal Tenancy (Amendment) Act’ কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটিয়েছিল। স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডিকে সভাপতি করে ১৯৩৮ সালের ৫ নভেম্বর বাংলা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ‘ল্যান্ড রেভেনিউ কমিশন’ ১৯৪০ সালের ২১ মার্চ চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে। এটি ছিল দেশের ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কিত সবচেয়ে মূল্যবান দলিল। ১৯৩৮ সালের আইন দ্বারা ১৮৮৫ সালের প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন করা হয়েছিল এবং এর দ্বারা খাজনা বৃদ্ধির সকল ধারা দশ বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল। এটি রায়তদের উপর প্রথাগতভাবে জমিদারগণ কর্তৃক ধার্যকৃত সব ধরনের  আবওয়াব ও সেলামির (কর) বিলোপ সাধন করে। জমিদারকে কোনো হস্তান্তর-ফি না দিয়ে রায়তরা তাদের জমি হস্তান্তর করার অধিকার লাভ করে। এ আইন বকেয়া খাজনার সুদের হার ১২.৫০% থেকে ৬.২৫%-এ হ্রাস করে। নদীর ভাঙ্গনে হারানোর ২০ বছরের মধ্যে চারবছরের খাজনা দিয়ে রায়তরা নদী-সিকস্তি (নদীর ভাঙনের ফলে লুপ্ত জমির পুন জেগে ওঠা) জমির মালিকানার অধিকার লাভ করে। হক তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার সময় জনগণকে প্রতিশ্রুত ডাল-ভাতের কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করতে না পারলেও তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদে কার্যকর রক্ষা বহু আইন কৃষকদের বোঝা কিছুটা লাঘব করতে সাহায্য করেছিল।

মুসলমান সম্প্রদায়ের পশ্চাৎপদতা দূর করার উদ্দেশ্যে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী রূপে হক মুসলমানদের জন্য চাকরির ৫০% সংরক্ষিত রাখার নির্দেশ দান করেন এবং বাংলা সরকারের অফিসগুলিতে এ অনুপাত কঠোরভাবে কার্যকর করেন। সরকার এ নীতি মেনে নেয় যে, যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী পাওয়া গেলে সরাসরিভাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৫% চাকরি তফশীলী সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত রাখা হবে, তবে এ সংরক্ষণ সরাসরিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত অমুসলমানদের ৩০% এর বেশি হবে না। অবশ্য অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, ভারতীয় খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধদের জন্য শতাংশের হিসেবে পদের কোনো সংরক্ষণ ছিল না। তবে সরকার যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী পাওয়া গেলে এসব সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ বিবেচনার নিশ্চয়তা দান করেছিল।

তাঁর প্রথম মন্ত্রিত্বের সময়ে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে হক মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের গতি ত্বরান্তিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য প্রদেশে বসবাসকারী সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই শিক্ষার বিস্তার করাকে তিনি তাঁর দায়িত্বরূপে বিবেচনা করেছিলেন। এ লক্ষ্য নিয়ে তিনি বঙ্গীয় আইন সভায় ‘প্রাথমিক শিক্ষা বিল’ পেশ করেন যা প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করে আইন হিসেবে পাস করা হয়েছিল। কিন্তু ফজলুল হক বঙ্গীয় আইন সভায় ‘মাধ্যমিক শিক্ষা বিল’ পেশ করলে এতে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতি সংযুক্ত থাকায় বিরোধী দলীয় সদস্যবৃন্দের মধ্যে ও সংবাদপত্রগুলিতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। হক ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) কলকাতা,  লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ, ওয়াজিদ মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল এবং চাখার কলেজের মতো বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা (১৯৪১-১৯৪৩) মূলত মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি জোটে পরিণত হয়েছিল। অন্ততপক্ষে মুসলিম লীগ বাংলার মুসলমানদের মনে এরকম একটা ধারণাই সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠনের প্রকৃতিই আইন প্রণয়ন ও অন্যান্য কর্মকান্ডের ব্যাপারে এটাকে নিষ্ফলা করে তুলেছিল। দালালি এবং গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে ব্যক্তিগত ঝগড়া ও শত্রুতা ছাড়া তাঁর দ্বিতীয় মন্ত্রিত্বের ১৫ মাসে আর কিছু হয় নি।

১৯৪৩ এর পরবর্তী সময়   ১৯৪২ সাল থেকে হক প্রবলভাবে  দ্বিজাতিতত্ত্ব-এর বিরোধিতা করতে থাকেন এবং মুসলিম লীগের প্রভাব হ্রাস করার জন্য তার সম্পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করেন। এ লক্ষ্যে হক মুসলিম লীগের বাইরের মুসলমান সদস্যদের সমবেত করতে চেষ্টা করেন। সাময়িকভাবে তিনি সফল হন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ডা: খান সাহেব, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক এবং সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী আল­াহ্ বখ্শ ভারতীয়দের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে যুক্তভাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য হক প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ত্রুটিপূর্ণ লাহোর প্রস্তাবের প্রতি বাঙালি মুসলমানদের মনোযোগ আকর্ষণ করে তিনি জোরালোভাবে এর বিরুদ্ধে তাঁর মতামত প্রকাশ করেন। হক ও মুসলিম লীগের মধ্যে তিক্ততা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে এবং ১৯৪৩ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৪৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত ফজলুল হক অবিশ্রান্তভাবে লীগের বিরোধিতা করেন। এর ফলে তিনি বাংলার রাজনীতির মূলধারা থেকে উত্তরোত্তর ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ১১৭টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ ১১০টি আসন লাভ করে এবং হকের কে.পি.পি মাত্র চারটি আসন পায়। এ চার আসনের মধ্যে তিনি নিজে দুটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দুটি আসনেই জয়লাভ করেন।  হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন। তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা তখনও শীর্ষে থাকলেও রাজনৈতিকভাবে হক একাকী হয়ে পড়েন।

১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সে সময় হক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করতে এবং কলকাতার পার্ক সার্কাসে তাঁর হিন্দু প্রতিবেশীদের রক্ষা করতে চেষ্টা করেন। নগরীতে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি দেখে তিনি অত্যন্ত হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলেন। লীগ-নেতৃবৃন্দের অনুরোধে হক ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে মুসলিম লীগে যোগদান করেন।

১৯৪৭ সালে দেশ-বিভক্তির ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি লক্ষ করে হক অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন এবং ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫২ সালে পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী ছাত্রদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করলে ফজলুল হক আহত হন। হক মুসলিম লীগবিরোধী আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতারূপে আবির্ভুত হন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি  ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গণ অভ্যুত্থান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকে এক নতুন দিকনির্দেশনা দান করে। ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই ফজলুল হক ‘শ্রমিক-কৃষক দল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য হক, মওলানা  আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সোহ্রাওয়ার্দী  যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। হক এ জোটের নেতা নির্বাচিত হন। তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণার পক্ষে জনগণকে সমবেত করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। শেরে বাংলার ভক্তি ও উৎসাহ সঞ্চয়ের ক্ষমতা বিপুল ভোটে ফ্রন্টের জয়লাভের একটি প্রধান কারণ ছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর এ.কে ফজলুল হক পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন যদিও আইনসভায় তাঁর দল আওয়ামী মুসলিম লীগের চেয়ে অনেক কম আসন লাভ করেছিল। রাজনৈতিকভাবে এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে, আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা না হয়েও হক দুবার বাংলার এবং আরও একবার পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। এটা তাঁর রাষ্ট্রপরিচালনায় দক্ষতা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার নির্দেশক। তিনি সব সময়ই আন্তঃদলীয় আচার-আচরণ বজায় রাখতে পারতেন। অবশ্য হকের মন্ত্রিসভা ছিল স্বল্পস্থায়ী।

পাকিস্তানে সদ্য গঠিত গণ-পরিষদে হকের যথেষ্ট সমর্থক ছিলেন। তাঁরা চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করতেন যার ফলে ১৯৫৫ সালের আগস্টে হককে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৫৬ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হন এবং ১৯৫৮ সালে সে পদ থেকে অপসারিত হন। তারপর থেকেই তিনি রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। কাজী নজরুল ইসলাম এভেনিউর দক্ষিণপ্রান্তে শিশু একাডেমীর পশ্চিম পাশে তিন নেতার মাযারের মধ্যে একটি হল তাঁর সমাধি।

প্রায় অর্ধশতক ধরে ফজলুল হক ছিলেন উপমহাদেশের এক বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন এক অসাধারণ বাগ্মী। ইংরেজি, বাংলা ও উর্দুতে তিনি অনর্গল বক্তৃতা করতে পারতেন। একই সাথে ইসলামি, বাঙালি ও ভারতীয় পরিচয় তাঁর মানসকে প্রভাবিত করায় তাঁর চিন্তা ও কর্মে পরস্পরবিরোধী উপাদান প্রকাশ পায়। পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়ের উন্নয়নের কথা তাঁকে ভাবতে হতো, সমগ্র বাঙালি জাতির অগ্রগতির চিন্তায় তিনি ছিলেন মগ্ন এবং একই সঙ্গে যুক্ত স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন তিনি সযত্নে লালন করতেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একটি সঙ্গতিপূর্ণ নীতি অনুসরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে তিনি বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক ব্যক্তি হয়েই রইলেন।

ব্যক্তিগত ও জনজীবনে হক ছিলেন অত্যন্ত সরল। তাঁর জীবদ্দশায়ই জাতিধর্ম নির্বিশেষে জনসাধারণ তাঁর উদার ও পরোপকারী স্বভাবের জন্য তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসত ও শ্রদ্ধা করত। দুর্দশাগ্রস্ত ও অতি দরিদ্রদের সাহায্য করতে গিয়ে তিনি নিজেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। বাংলার মানুষ হককে তাঁর চাতুর্য বা তাঁর অস্থির রাজনৈতিক আচরণের জন্য স্মরণ করে না, তারা তাঁকে স্মরণ করে পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়ের উন্নতি সাধনের জন্য তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা, বিপুল সংখ্যক কৃষকের দারিদ্র্য বিমোচন ও তাঁর উদার প্রকৃতির জন্য। [অমলেন্দু দে ও এনায়েতুর রহিম]

গ্রন্থপঞ্জি  AK Fazlul Huq, Bengal Today, Calcutta, 1944; ASM Abdur Rab, AK Fazlul Huq (Life and Achievements), Barisal, 1966; Amalendu De, Pakistan Prastab O Fajlul Hak, Calcutta, 1972; N Mansergh (ed), The Transfer of Power (1942 - 47), several vols.