হক, আমানুল

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৬:৫৭, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)
আমানুল হক

হক, আমানুল (১৯২৫-২০১৩) আলোকচিত্র শিল্পী। যিনি ভাষা আন্দোলনের সময় শহীদ রফিকউদ্দীনের ছবি তুলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আমানুল হক ১৯২৫ সালের ৬ই নভেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার এক অভিজাত ও আলোকিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ডা. আবদুল হক, মাতা হাজেরা খাতুন। আমানুল হক ১৯৪৩ সালে মেট্রিক পাশ করে পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন। নানা কারণে তাঁর পক্ষে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করা হয়নি। শারীরিক সুস্থতার অভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তিনি কখনো স্থির হতে পারেননি। ঢাকার আর্ট কলেজে ভর্তি হলেও অচিরেই পাঠে ছেদ টানতে হয়েছিল তাকে। ছোটবেলা থেকেই বাবার অনুপ্রেরণায় আমানুল হক ছবি আঁকা এবং ক্যামেরার প্রতি আকৃষ্ট হন। অল্প বয়সেই কলকাতার বিভিন্ন সাময়িকপত্রে তাঁর তোলা আলোকচিত্র প্রকাশিত হয় এবং ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন।

আর্ট কলেজের পাঠ শেষ না হলেও আমানুল হক ঢাকা মেডিকেল কলেজে আর্টিস্ট কাম ফটোগ্রাফার পদের চাকরিতে যোগদান করেন। মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের ছবি তিনি একে দিতেন। চাকরিকালীন সময় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি সম্পৃক্ত হন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের সময় প্রখ্যাত সাংবাদিক কাজী মুহাম্মদ ইদ্রিস এবং মেডিকেল শিক্ষার্থী হালিমা খাতুনের সহায়তায় পুলিশের গুলিতে মাথার খুলি উড়ে যাওয়া শহীদ রফিকের একমাত্র প্রামাণ্য চিত্রটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে তুলে রাখেন আলোকচিত্রী আমানুল হক। এ ছবির একটি কপি দৈনিক আজাদ-এ ছাপার জন্য দেয়া হলেও তখন সেটি ছাপা হয়নি। ছাত্ররা ছবিটি ব্যবহার করে লিফলেট ছাপিয়ে বিতরণ করলে পুলিশ ছবিটি বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে এবং আমানুল হককে খুঁজে বেড়ায়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ছবি তুলে আমানুল হক পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে আমানুল হকের তোলা শহীদ রফিকের ছবিটি পোস্টার করে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রচার করা হয়। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর ঢাকায় একটি বড় আকারের সাংস্কৃতিক উৎসব ও সাহিত্য সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এখানে আমানুল হক নিজের তোলা একশ’টি ছবি নিয়ে ‘আমার দেশ’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে ওপার বাংলা থেকে আগত তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মনোজ বসু প্রমুখ আমানুলের ছবি দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। এখানে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমানুল হকের বন্ধুত্ব হয়। ছবির প্রদর্শনী দেখে সুভাষ মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেন ‘একটি ছোট্ট ঘরে দেয়ালের মাত্র কয়েকটি ছবিতে এমনভাবে পূর্ব বাংলা ধরা দিয়েছে, যা না দেখলে বিশ্বাস হয় না।’

এর কিছুদিন পরেই পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে দুর্দিন নেমে আসে এবং পুলিশের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আমানুল হক গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কলকাতা পাড়ি দেন। সেখানে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে সত্যজিৎ রায়ের স্নেহভাজন এবং ফটোগ্রাফার বন্ধু হয়ে ওঠেন আমানুল হক। পথের পাঁচালী, দেবী, তিন কন্যাসহ সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত সিনেমার সৃষ্টিশীল মুহূর্তগুলো স্থির চিত্রে ধারণ করেন আমানুল হক। আমানুল হকের কর্ম সম্পর্কে পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায় লেখেন- ‘এক প্রজন্মেরও বেশি সময় ধরে আমানুল তার নিজের দেশের জীবনধারার প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিত্রিত করে বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতির সামগ্রিক প্রকাশে গভীর ভালোবাসার স্বাক্ষর রেখেছে।’

একযুগ পর আমানুল হক দেশ মাতৃকার টানে দেশে ফিরে আসেন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে। বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, হাটে-মাঠে ঘুরে ছবি তুলতে থাকেন। ক্যামেরার ফ্রেমে আসতে থাকল তাঁর প্রিয় স্বদেশ। এসবের মধ্যে ছিল গণঅভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি বিষয়গুলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাজউদ্দীন আহমদের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন আমানুল হক। তাঁদের অনেক ছবি তিনি ক্যামেরা বন্দী করেন। মওলানা ভাসানী তাকে শিল্পী বলে ডাকতেন।

একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভের পর প্রবাসী বাঙালি পরিবার এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষা, ঐতিহ্য ও একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস জানার জন্য রচনা করেন একুশের তমসুক (২০০৩) এবং Bangla Souvenir (2004), যা তার শ্রমশীল চিন্তার ফসল। সত্যজিৎ রায়ের ওপর তিনি রচনা করেন প্রসঙ্গ সত্যজিৎ (২০১০)। এছাড়া তিনি প্রকাশ করেন ক্যামেরায় স্বদেশের মুখ (২০১৩), স্মৃতিচিত্র (২০১৬), আমার দেশ (চিত্রমালা) সুবৃহৎ অ্যালবাম। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার ম্যারি সিটান রচিত Portrait of a Director-Satyajit Ray জীবনী গ্রন্থে আমানুল হকের তোলা তাৎপর্যপূর্ণ বহু আলোকচিত্র স্থান পায়। এ গ্রন্থে তিনি লেখেন 'Amanul Huq: an East Pakistan (East Bengal) Photographer of great talent creator of great Photographs and a devoted friend of Ray'। বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে আমানুল হকের তোলা ছবি UNESCO World Exhibition of Photography খ্যাতি লাভ করে এবং একটি ছবি World’s Best Photography সংকলনে স্থান পায়। জার্মানির PHOTOKONA উৎসব উপলক্ষে Royal Photographic Society আয়োজিত আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে আমানুলের ছবি প্রদর্শিত ও বিদেশি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়।

১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গণচীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই বাংলাদেশে সফরে আসলে সরকার প্রধান আতাউর রহমান আমানুল হকের ‘আমার দেশ চিত্রমালা’র অ্যালবাম উপহার দেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘আমার দেশ চিত্রমালা’র একটি অ্যালবাম সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ব্যক্তিগত উপহার হিসেবে প্রদান করেন। প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ভাষা আন্দোলনের সামগ্রিক অবদানের জন্য ‘আমার দেশ চিত্রমালা’র আলোচিত্রী আমানুল হককে জাতীয় জাদুঘরের পক্ষ থেকে ভাষা সৈনিক সংবর্ধনা ও স্মারক ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। আলোকচিত্র সংস্কৃতি ও আলোকচিত্রভিত্তিক ফটোসাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য আমানুল হক জনকণ্ঠ প্রতিভা সম্মাননা লাভ করেন। বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সর্বোচ্চ সম্মানসূচক ফেলো আমানুল হককে পৃথিবীর বহু খ্যাতিমান চিত্রগ্রাহকের উপস্থিতিতে Prince Claus of the Netherlands Foundation-এর পক্ষ থেকে দৃক আয়োজিত ছবি মেলায় সংবর্ধনা ও Life Time Achievement Award-এ ভূষিত করা হয়। ২০০৯ সালে ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উৎসব নাগরিক কমিটি আমানুল হককে ভাষা সৈনিক হিসেবে সম্মাননা প্রদান করে। একই বছর তিনি বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলোশিপ লাভ করেন।

খ্যাতিমান চিত্রগ্রাহক ভাষা সৈনিক আমানুল হককে বাংলাদেশে সরকার ২০১১ সালে একুশে পদক প্রদান করে। একুশের পদক হিসেবে প্রাপ্ত সোনার মেডেল এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত সম্মাননাপত্র তিনি দান করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে। চিরকুমার আমানুল হক ৮৮ বছর বয়সে ২০১৩ সালের ৩রা এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। [মনিরুজ্জামান শাহীন]