সোমপুর মহাবিহার

ভূমি নকশা, সোমপুর মহাবিহার

সোমপুর মহাবিহার প্রাচীন বাংলার একটি বৌদ্ধ বিহার।  পাহাড়পুরএর উৎখননকৃত বিহার কমপ্লেক্সের সঙ্গে সোমপুর মহাবিহারকে অভিন্ন মনে করা হয়। পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা  ধর্মপাল (আনু. ৭৮১-৮২১ খ্রি) এ বিহার স্থাপন করেন। ধ্বংসাবশেষ হতে কিছু মাটির সিল পাওয়া গেছে, যেখানে উৎকীর্ণ রয়েছে ‘শ্রী-সোমপুরে-শ্রী-ধর্মপালদেব-মহাবিহারিয়ার্য-ভিক্ষু-সংঘস্য’।  লামা তারনাথ এবং অন্যান্য তিববতীয় উৎস থেকে জানা যায় যে,  বরেন্দ্র জয়ের পর  দেবপাল এটি নির্মাণ করেন। সম্ভবত ধর্মপালের অসমাপ্ত কাজগুলিই তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি দেবপালের সময়ে শেষ হয়। পাল শাসকগণ ছিলেন বৌদ্ধধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী। ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই তারা বেশ কিছু সংখ্যক বিহার স্থাপন করেন। এগুলির মধ্যে কয়েকটি ছিল বিখ্যাত শিক্ষা কেন্দ্র। এশিয়ার প্রায় সর্বত্রই অতি দ্রুত এগুলির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। শাসক বংশের সঙ্গে সোমপুর মহাবিহারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ইঙ্গিত করে যে, দাতাগোষ্ঠীর রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সঙ্গে এরও উত্থান-পতন জড়িত ছিল।

মূল মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত মহেন্দ্রপালের ৫ম রাজ্যাংকের পাহাড়পুর স্তম্ভলিপিতে ভিক্ষু অজয়গর্ভের নাম উল্লিখিত আছে। এ লিপির মহেন্দ্রপালকে একই নামের একজন রাজার সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয়। মহেন্দ্রপালের সদ্য আবিষ্কৃত  জগজ্জীবনপুর তাম্রশাসন থেকে এ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া গেছে যে, তিনি  পাল বংশের একজন রাজা এবং দেবপালের পুত্র ও উত্তরাধিকারী ছিলেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মহেন্দ্রপাল এই বিহারের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান অব্যাহত রেখেছিলেন। প্রথম মহীপালের রাজত্বকালে (আনু. ৯৯৫-১০৪৩ খ্রি) এ বিহারের মেরামত ও সংস্কার করা হয়। তিববতীয় গ্রন্থ Pag-Sam-Jon-Zang-এ উল্লেখ আছে যে, উক্ত রাজা নিয়মিতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সোমপুর মহাবিহার পরিদর্শন করতেন।

সোমপুর মহাবিহার, নওগাঁ

এগারো শতকে  বঙ্গালএর সেনাবাহিনীর, সম্ভবত বঙ্গের বর্মন শাসকগণের সেনাবাহিনীর, অভিযানের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সোমপুর মহাবিহার সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান ছিল। বিপুলশ্রীমিত্রের নালন্দা তাম্রশাসনে উল্লিখিত আছে যে, তাঁর পূর্বপুরুষ করুণাশ্রীমিত্র সোমপুর মহাবিহার ত্যাগে রাজী না হওয়ায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার একশ বছর পরে বিপুলশ্রীমিত্র সংস্কার কাজের মাধ্যমে এই বিহারের হূতগৌরব পুনরুদ্ধার করেন। তিনি এখানে একটি তারা মন্দিরও নির্মাণ করেন। সংস্কারের পর এ মন্দিরের জাঁক-জমকের দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে,‘জগতাম্ নেত্রৈকবিশ্রামভূঃ’ (জগতে চোখের একমাত্র তৃপ্তিদায়ক স্থান)।

অনুমিত হয় যে, বারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ‘কর্ণাটদেশাত আগত-ব্রহ্মক্ষত্রিয়’ অর্থাৎ কর্ণাট থেকে আগত ব্রহ্মক্ষত্রিয় সেনাদের আগমন বৌদ্ধ বিহারের পতনের সূচনার ইঙ্গিতবহ। সোমপুর মহাবিহারের ধীরে ধীরে পতন হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তেরো শতকে এ এলাকা মুসলমানদের অধিকারে এলে এটি চূড়ান্তভাবে পরিত্যক্ত হয়।

তিববতীয় উৎসে (‘ধর্মকায়বিধি’ এবং ‘মাধ্যমকরত্নপ্রদীপ’-এর তিববতী অনুবাদ, তারনাথের বর্ণনা, এবং Pag-Sam-Jon-Zang) সোমপুর মহাবিহারের গৌরবের উল্লেখ রয়েছে। নয় থেকে বারো শতকের মধ্যে অনেক তিববতী ভিক্ষু এ বিহার ভ্রমণ করেছেন।  অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বেশ কয়েক বছর এখানে অতিবাহিত করেন। এখানে বসে তিনি তিববতী ভাষায় ‘মাধ্যমক রত্নপ্রদীপ’ অনুবাদ করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক দীক্ষাগুরু রত্নাকর শান্তি ছিলেন এ বিহারের ‘স্থবির’। মহাপন্ডিতাচার্য বোধিভদ্র এ বিহারের একজন আবাসিক ভিক্ষু ছিলেন। কালমহাপদ, বীরেন্দ্র এবং করুণাশ্রীমিত্রসহ আরও বেশ কয়েকজন পন্ডিত তাঁদের জীবনের বেশ কিছু সময় এ বিহারে অতিবাহিত করেন।  [আবদুল মমিন চৌধুরী]