সেরাজ, তৌফিক এম

সেরাজ, তৌফিক এম (১৯৫৬-২০১৯) একজন নগর পরিকল্পনাবিদ এবং ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব। তিনি রিয়েল এস্টেট শিল্প এবং ঢাকার নগর জীবনকে উন্নত করার জন্য কাজ করেছেন। তৌফিক এম. সেরাজ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৬ সালে, পিতা মো. সেরাজ উদ্দিন, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং মাতা ফাতেমা খাতুন, অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ। সেরাজ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পুরকৌশলে স্নাতক এবং নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কমনওয়েলথ বৃত্তিসহ যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিক ডিজাইনে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর চিন্তাধারা ছিল সবসময় দেশকে নিয়ে, তাই তিনি বিদেশে পড়াশুনা শেষ করে, বুয়েটের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগে শিক্ষকতায় কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি শীঘ্রই বুঝতে পেরেছিলেন যে, নগর সম্পর্কে তার ধারণাগুলি বাস্তবায়নের জন্য তার একটি বড় এবং আরও কার্যকর প্ল্যাটফর্ম দরকার। তাই, তার ধারণাগুলি কাজে লাগানোর জন্য রিয়েল এস্টেট সেক্টরে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

তৌফিক এম সেরাজ

তৌফিক এম. সেরাজ ঢাকা শহরে আবাসন জগতে নতুনত্ব প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৮৮ সালে শেলটেক (প্রা.) লি. প্রতিষ্ঠা করেন। ‘শেলটেক মনিহার’ এবং ‘শেলটেক বীথিকা’ প্রকল্পগুলোতে আধুনিক সব সুবিধাসহ একটি গেটেড কমিউনিটিতে বসবাসের সুযোগ তৈরি করেছে। এই ধরনের প্রচেষ্টা ধীরে ধীরে শেলটেককে ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের একটি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। শেলটেকের আধুনিক আবাসন ধারণাগুলি মানুষের আরামদায়ক অ্যাপার্টমেন্ট লিভিং সম্পর্কে সবার ধারণা পাল্টে দিয়েছে।

সেরাজ আবাসন শিল্পের সমন্বয় সাধন ও বিকাশের জন্য ১৯৯১ সালে আরো ৯ জন সুপ্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তার সাথে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) প্রতিষ্ঠা করেন। সেরাজ তিন মেয়াদে ২০০০-২০০৬ পর্যন্ত মোট ছয় বছর রিহ্যাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সভাপতি হিসেবে তিনি অন্যান্য রিয়েল এস্টেট উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা নিয়ে, ঢাকার শহুরে জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য কাজ করেন। তিনি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সদস্যপদকে এমনভাবে জনপ্রিয় করেছেন যে, সকল রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান রিহ্যাবে যোগ দিতে আগ্রহী হয়। একসময় ক্রেতা সাধারণ রিহ্যাবের সদস্য প্রতিষ্ঠান থেকে অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে আস্থাশীল হয়ে উঠেন। একই সাথে, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারদের জন্য জবাবদিহিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়, ফলে ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্ট লিভিং-এর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।

সেরাজ ২০০৬-৮ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং পরিকল্পনা পেশার আগ্রগতির জন্য কাজ করেন। তিনি ঢাকার ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (উঅচ), ১৯৯৫-২০১৫ প্রণয়ন প্রকল্পের টিম লিডার ছিলেন। তার কোম্পানি, ‘শেলটেক কনসালটেন্টস (প্রা.) লি.’ আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ২০১৬-২০৩৫ এর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে এবং বর্তমানে ঢাকার নতুন ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (উঅচ), ২০১৬-২০৩৫ প্রণয়ন প্রকল্পের কাজ করছে।

ফোরাম ফর ফিজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট (এফপিডি), বাংলাদেশের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকম্প, অগ্নি নিরাপত্তা, গ্রামীণ বসতি, নির্মাণ শিল্পে নিরাপত্তা ইত্যাদি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা সভা, মতবিনিময়, সংবাদ সম্মেলন এবং কর্মশালার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা তথ্য উপস্থাপন করা হয়। তার মেয়ে, সামিয়া সেরাজ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং মেটারিয়াল সাইন্টিস্ট এবং অন্যান্য অনেকই তার এই সামাজিক সচেতনতা এবং গবেষণা কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলেন। যেকোনো কঠিন কাজকে আন্তরিকতার সাথে সহজ করার ব্যাপারে সেরাজ ছিলেন অনন্য সাধারণ। তার এই বিশেষ গুণ, তার সাথে কাজ করা সকলকে আরো অনুপ্রাণিত করত।

তৌফিক এম. সেরাজ একজন প্রকৌশলী, পরিকল্পনাবিদ এবং উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার ব্যস্তজীবন সত্ত্বেও, তিনি একজন অত্যন্ত সামাজিক ব্যক্তি ছিলেন এবং তার চারপাশের সকলের সাথে যোগাযোগ এবং সম্পর্ক রক্ষায় উৎসাহী ছিলেন। তিনি একজন আগ্রহী পাঠক এবং লেখকও ছিলেন। তিনি বিকেন্দ্রীকরণ, রিয়েল এস্টেট সেক্টর এবং বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনা বিষয়ে পাঁচটি গবেষণা বই প্রকাশ করেন। ব্যবসা এবং একাডেমিক জগতে তার সমস্ত সাধনায়, তার স্ত্রী জেবা ইসলাম সেরাজ, অধ্যাপক, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় তার পাশে ছিলেন। অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি অর্জন করে তার কন্যা সামিয়া সেরাজ এবং সারাহ সেরাজ পিতার উদ্যোগে সহযোগিতা করেছে।

তৌফিক এম. সেরাজ একজন সফল উদ্যোক্তা ছিলেন, তিনি প্রচেষ্টা এবং জ্ঞান দিয়ে শেলটেক তৈরি করেছিলেন। তিনি রিয়েল এস্টেট সেক্টরকে আলোকিত করেছেন এবং পেশাদারিত্বের সাথে যুক্ত করেছেন। এভাবেই তিনি ঢাকা শহরবাসীর জীবনধারাকে উন্নত করেছিলেন। [মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম]