সুরমা-মেঘনা নদীপ্রণালী

সুরমা-মেঘনা নদীপ্রণালী (Surma-Meghna River System)  বাংলাদেশের প্রধান নদীপ্রণালীগুলির অন্যতম। এটি দেশের দীর্ঘতম (৬৬৯ কিমি) নদীপ্রণালী। বিশ্বের অন্যতম বৃষ্টিবহুল এলাকা (ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে প্রায় ১,০০০ সেমি) এই নদীপ্রণালীর মাধ্যমে নিষ্কাশিত হয়। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীপ্রণালীর পূর্বে সুরমা-মেঘনা নদীপ্রণালীর অবস্থান। ভারতের মেঘালয় ও শিলং-এ অবস্থিত পাহাড়সমূহ থেকে বহু উপনদী সুরমা নদীতে এসে মিলিত হয়েছে। সুরমা নদীর আদি উৎস বরাক নদী। মায়ানমার সীমান্তে নাগা-মণিপুর পাহাড়শ্রেণীর  শৈলশিরা ও উপত্যকা ভূখন্ডময় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বরাক নদীর জলনিষ্কাশন অঞ্চল অবস্থিত। বরাক-মেঘনার দৈর্ঘ্য ৯৫০ কিমি, যার মধ্যে ৩৪০ কিমি বাংলাদেশে অবস্থিত। বাংলাদেশের সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী অমলশিদ নামক স্থানে বরাক নদী সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুটি খরস্রোতা ধারায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উত্তরপশ্চিমের ধারাটি সুরমা এবং দক্ষিণপশ্চিমের ধারাটি কুশিয়ারা নামে পরিচিত।

সুরমা নদী প্রথমে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে পরে সিলেট শহরের দক্ষিণপশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর এটি উত্তরপশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে সুনামগঞ্জ শহরের পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে। অতঃপর নদীটি দক্ষিণপশ্চিম ও দক্ষিণ অভিমুখী প্রবাহিত হয়ে মারকুলী নামক স্থানে পুনরায় কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মিলিত প্রবাহ কালনী নামে ভৈরববাজার পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। সিলেট অববাহিকার উত্তরাংশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় সুরমা খাসিয়া ও জৈন্তা পাহাড়সারি থেকে আগত বিভিন্ন উপনদী গ্রহণ করেছে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে এসকল উপনদীগুলি হচ্ছে লুভা, হারি, গোয়াইন গাঙ, পিয়াইন, বোগাপানি, যাদুকাটা, সোমেশ্বরী, কংস এবং মোগরা। মোহনগঞ্জের দক্ষিণে কংস নদীকে এবং আরও দক্ষিণে মোগরা নদীকে গ্রহণ করার পর সুরমা দুটি ধারায় বিভক্ত হয়েছে। পশ্চিমের ধারাটি উজানে ধনু, মধ্যপ্রবাহে বোউলাই এবং নিম্নপ্রবাহে ঘোরাউত্রা নামে প্রবাহিত। কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরববাজারের কাছে সুরমা কালনী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। ভৈরববাজারের কাছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র মেঘনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। প্রবাহপথে চাঁদপুরে পদ্মা মেঘনায় এসে পতিত হয়েছে।

ত্রিপুরা পাহাড়সারি থেকে আগত কতগুলি পাহাড়ী নদীকে কুশিয়ারা উপনদী হিসেবে গ্রহণ করেছে। এসকল উপনদীর মধ্যে প্রধান মনু মৌলভীবাজার শহরের উত্তরে কুশিয়ারার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মনুমুখের কাছে কুশিয়ারা দুটি চ্যানেলে বিভক্ত হওয়ার পর উত্তরের ধারাটি বিবিয়ানা নামে এবং দক্ষিণের ধারাটি বরাক নামে প্রবাহিত হয়েছে। নিম্নপ্রবাহে বিবিয়ানা কালনি নাম ধারণ করেছে এবং আজমিরিগঞ্জের কাছে সুরমা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ত্রিপুরা পাহাড় থেকে আগত  গোপলা ও খোয়াই নদীদুটিকে উপনদী হিসেবে গ্রহণ করার পর মদন নামক স্থানে বরাক সুরমা নদীতে পতিত হয়েছে। সুরমা ও কুশিয়ারার প্রবাহপথের মাঝখানে অবস্থিত রয়েছে সুবিশাল হাওর এলাকা। সুরমা নদীপ্রণালীর বেশিরভাগই হাওর অববাহিকায় পতিত হয়েছে।

মেঘনা নদীর গতিপ্রবাহকে সুস্পষ্টভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়- ভৈরববাজার থেকে ষাটনল পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত স্বল্প দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট প্রবাহকে আপার মেঘনা এবং ষাটনল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্রবাহপথকে লোয়ার মেঘনা নামে অভিহিত করা হয়। লোয়ার মেঘনা পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ ও প্রশস্ততম নদী, কারণ এটি গঙ্গা-পদ্মা এবং ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীসমূহের মোহনা। জোয়ারভাটা প্রভাবিত মেঘনার এই অংশ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং আপার মেঘনার প্রায় সমগ্র প্রবাহ বহন করে সাগরে মিলিত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এই অংশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানির নীট পরিমাণ প্রায় ১০,০০০ কিউমেক এবং বর্ষা মৌসুমে প্রায় ১,৬০,০০০ কিউমেক। পদ্মা নদীর সঙ্গে মিলনস্থলের সামান্য উজানে ভৈরবে মেঘনা নদীর উপর একটি রেলসেতু রয়েছে। এই স্থানে মেঘনার প্রশস্ততা প্রায় পৌণে এক কিলোমিটার।

তিতাস নদী মেঘনার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখানদী। চাতালপুর নামক স্থানে মেঘনা থেকে উৎপন্ন হয়ে তিতাস অাঁকাবাঁকা পথে প্রায় ২৪০ কিমি পথ পরিক্রম করে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলায় দুটি চ্যানেলের মাধ্যমে পুনরায় মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। আখাউড়ার কাছে তিতাস হাওড়া নামক একটি পাহাড়ি স্রোতধারাকে উপনদী হিসেবে গ্রহণ করেছে। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া শহর ও আখাউড়া তিতাস নদীর তীরে অবস্থিত। মেঘনার অন্যান্য শাখানদীগুলি হচ্ছে পাগলী, কাটালিয়া, ধনাগোদা, মতলব এবং উদামদি। মেঘনা ও এর শাখানদীগুলি ত্রিপুরার পাহাড়ি এলাকার গোমতী, হাওড়া, কাগনী, সিনাই, বুড়ি, হরি, মঙ্গল, কাকরী, পাগলী, কুরুলিয়া, বালুজুড়ি, সোনাইছড়ি, হান্দাছোড়া, জাঙ্গালিয়া ও দুরদুরিয়াসহ অসংখ্য স্রোতধারার জলরাশি লাভ করে থাকে। এই পাহাড়ি নদীগুলির মাধ্যমে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে প্রায়ই আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়। পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে আসা প্রচুর পরিমাণে পলি দ্বারা নদীগুলির তলদেশ অনেক ভরাট হয়ে যাওয়ায় এগুলি বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি বহন করতে ব্যর্থ হয়। পাহাড়ি ঢলসৃষ্ট বন্যা প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে মেঘনা-ধনাগোদা, গোমতী বাঁধসহ একাধিক বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায়ই এসকল বাঁধ ভেঙ্গে শস্য ও জানমালের ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে।

বদ্বীপের শুরুতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ মেঘনার প্রবাহখাতকে দুটি মূল চ্যানেলে বিভক্ত করেছে। বৃহত্তর পূর্বের চ্যানেল ও ক্ষুদ্রতর পশ্চিমের চ্যানেলদ্বয় পাঁচ থেকে আট কিলোমিটার দীর্ঘ এবং প্রায় দুই কিলোমিটার প্রশস্ত। মুলাদির নিকটে মেঘনার পশ্চিম তীর থেকে শফিপুর নামে একটি শাখা বের হয়েছে।

আরও দক্ষিণে, মেঘনা তিনটি চ্যানেলে বিভক্ত হয়েছে। পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে এই চ্যানেলগুলি হচ্ছে ইলশা, শাহবাজপুর ও বারুনী। ইলশা চ্যানেল ভোলাকে বরিশালের মূল ভূখন্ড থেকে পৃথক করেছে এবং এটি ৫ থেকে ৬.৫ কিলোমিটার প্রশস্ত। ভোলা ও রামগতি-হাতিয়া দ্বীপের মধ্যে প্রবাহিত শাহবাজপুর চ্যানেল ৫ থেকে ৮ কিলোমিটার প্রশস্ত। রামগতি, চর লক্ষ্মী ও নোয়াখালীর মূল ভূখন্ডের মধ্য দিয়ে একসময় প্রবাহিত বারুণীর বর্তমানে অস্তিত্ব নেই। ইলশা ও শাহবাজপুর চ্যানেল সমন্বয়ে গঠিত মেঘনা মোহনার প্রশস্ততা সাগরের মুখে প্রায় ৩২কিমি।

দাউদকান্দিতে গোমতী নদী মেঘনা নদীতে পতিত হয়েছে। ত্রিপুরা পৃষ্ঠ থেকে আগত মেঘনার অন্য একটি উপনদী হচ্ছে ডাকাতিয়া। ডাকাতিয়ার প্রধান উৎস ছিল কাকরাই নদী, কিন্তু ছোট ফেনী নদী এই অংশকে গ্রাস করে নেওয়ায় ডাকাতিয়া নদী বর্তমানে চৌদ্দগ্রাম খালের মাধ্যমে ছোট ফেনী নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার প্রবাহ লাভ করে থাকে। ডাকাতিয়া থেকে দক্ষিণমুখী বের হয়েছে নোয়াখালী খাল। এটি পশ্চিমদিকে শাখেরহাট পর্যন্ত সর্পিল পথে প্রবাহিত হয়েছে।  [মাসুদ হাসান চৌধুরী]

গ্রন্থপঞ্জি  আবদুল ওয়াজেদ, বাংলাদেশের নদীমালা, ঢাকা, ১৯৯১; FH Khan, Geology of Bangladesh, University Press Limited, Dhaka, 1991; Haroun Er Rashid, Geography of Bangladesh, University Press Limited, Dhaka, 1991; Hugh Brammer, The Geography of the Soils of Bangladesh, University Press Limited, Dhaka, 1996; Bangladesh Bureau of Statistics (BBS), 1998 Statistical Year Book of Bangladesh, BBS, Dhaka, 1999