সুফি সাহিত্য

সুফি সাহিত্য মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা, যা সুফিতত্ত্বকে আশ্রয় করে উদ্ভূত ও বিকশিত হয়েছিল। এ ধারা সৃষ্টির প্রেরণা এসেছিল বহিরাগত সুফি সাধকদের কাছ থেকে। তাঁরা মুসলিম বিজয়ের পূর্ব থেকেই আরব-ইরান হতে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছিলেন। তেরো শতকে তুর্কি সুলতান  বখতিয়ার খলজী কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের পর রাজপুরুষ, বণিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে ধর্মজ্ঞানী আলেম ও পীর-দরবেশদেরও আগমন বৃদ্ধি পায়। তাঁরা ঢাকা, বগুড়া, পাবনা, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা ইত্যাদি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন এবং  খানকাহ, মসজিদ, মকবেরা,  মাদ্রাসা ইত্যাদি নির্মাণ করে  ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সাধারণভাবে ইসলামের সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব এবং বিশেষভাবে সুফিদের উদারনীতি, মানবপ্রেম ও সেবার আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। এভাবে বাংলাদেশে বহিরাগত মুসলিম শাসক, আলেম, সুফি ও ধর্মান্তরিত স্থানীয় জনগণের সমন্বয়ে একটি নব্য মুসলিম সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। তাদের মানসিক চাহিদা নিবৃত্তির জন্য সুফি ভাবধারার কবিগণ বাংলা ভাষায় যে সাহিত্যকর্ম নির্মাণ করেন তাই কালক্রমে সুফিসাহিত্য নামে আখ্যাত হয়।

সুফিতত্ত্ব নিয়ে প্রথম এক বিশাল সাহিত্য সৃষ্টি হয় ইরানে। সেখানকার বিখ্যাত কবি আবদুর রহমান জামী, নিজামী গঞ্জভী, ওমর খইয়াম, হাফিজ এবং ভারতবর্ষের আমীর খসরু প্রমুখ ফারসি ভাষায় দিওয়ান, মসনভি,  গজল, রুবাইয়াৎ, খমসা প্রভৃতি আঙ্গিকে বহু কাব্য রচনা করেন। তারই অনুসরণে বাংলা সুফিসাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।

ভারতে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার অল্পকাল পরেই রাজধানী লখনৌতিতে সংস্কৃত ভাষায় রচিত অমৃতকুন্ড নামক গ্রন্থখানি আরবি ও ফারসি ভাষায় অনূদিত হয়। এটি সুফিদের নিকট খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল, কারণ এটি ছিল একটি যোগতত্ত্বের গ্রন্থ; আর হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের নিকট এরূপ মিশ্রধারার গ্রন্থই অধিক গ্রহণযোগ্য ছিল। বাংলার কবিরা প্রধানত ফারসি ও হিন্দি ভাষায় রচিত সুফিসাহিত্যের গ্রন্থসমূহ বাংলায় অনুবাদ করেন। সেসব গ্রন্থের মধ্যে শাহ মোহাম্মদ সগীরের  ইউসুফ-জুলেখা, দৌলত উজির বাহরাম খাঁনের  লায়লী-মজনু, কাজী দৌলতের সতীময়না-লোরচন্দ্রানী, আলাওলের  পদ্মাবতী, নওয়াজিস খানের  গুলে বকাওলী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এগুলি মূল কাব্যের অনুরূপ রূপক-প্রতীকধর্মী রচনায় পরিণত হতে পারেনি। মূলের তাত্ত্বিক রহস্য ও শৈল্পিক মাধুর্য এগুলিতে রক্ষিত হয়নি। এগুলি মূলত মানব প্রণয়কাব্যে পরিণত হয়েছে। তবে কোনো কোনো কাব্যে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু যোগসাধনা ও তত্ত্বের বিবরণ আছে।

মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় সুফিতত্ত্ব বিষয়ে দুধরণের কাব্য রচিত হয়েছে শাস্ত্রকাব্য ও পদাবলি। শাস্ত্রকাব্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: শেখ জাহিদের আদ্য পরিচয় (১৪৯৮), সৈয়দ সুলতানের জ্ঞানপ্রদীপ ও জ্ঞানচৌতিশা  (১৬ শতক), যোগকলন্দর (১৬ শতক), শেখ চাঁদের হরগৌরী-সম্বাদ ও তালিবনামা (১৭ শতক), আবদুল হাকিমের চারি-মাকাম-ভেদ  (১৭ শতক), হাজী মহম্মদের সুরতনামা (১৭ শতক), মীর মহম্মদ শফির নূরনামা  (১৭ শতক), শেখ মনসুরের সির্নামা (১৮ শতক) এবং আলী রজার আগম ও জ্ঞানসাগর (১৮ শতক)। এ গ্রন্থসমূহে প্রধানত সুফি সাধনপ্রক্রিয়াই বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া সৃষ্টিতত্ত্ব, যোগতত্ত্ব, ধর্ম ও নীতিবিষয়ক উপদেশেরও বর্ণনা আছে। শেখ জাহিদের আদ্য পরিচয়ের শুরুতে আছে সৃষ্টিতত্ত্ব। সৃষ্টির আদিতে সবকিছু ছিল শূন্য; শূন্য থেকে স্রষ্টা, স্রষ্টার অঙ্গ থেকে বিশ্বের সৃষ্টি  ইত্যাদির বর্ণনা আছে। এছাড়া দেহতত্ত্ব, জন্ম-মৃত্যুর রহস্য, সুফিভাব মিশ্রিত যোগতত্ত্ব ইত্যাদিরও বর্ণনা আছে।

সৈয়দ সুলতানের জ্ঞানপ্রদীপ ও জ্ঞানচৌতিশা কাব্যের বক্তব্য প্রায় অভিন্ন। জ্ঞানপ্রদীপের দশটি অধ্যায়ে দরবেশতত্ত্ব, এবাদত, তনের বিচার, আত্মতত্ত্ব, দীন, জিকির, ব্রহ্মতত্ত্ব ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (স.) ও হযরত আলীর (র.) প্রশ্নোত্তরে এসব তত্ত্ব ব্যাখ্যাত হয়েছে। তাঁর দেহতত্ত্বের বর্ণনায় সুফি ভাবনার সঙ্গে হিন্দু যোগসাধনার মিশ্রণ ঘটেছে। তাঁর মতে সৃষ্টিকর্তা নিরঞ্জন এবং শূন্যাকার; তিনি মানবদেহেই বিরাজ করেন। তাই দেহকে জানলে স্রষ্টাকেও জানা হয়।

ভারতের সুফিসাধক শাহ বু-আলি কলন্দর ইরানীয় ও ভারতীয় অধ্যাত্ম ভাবধারার মিশ্রণে ‘যোগকলন্দর’ নামে একটি নতুন সাধনপদ্ধতি প্রবর্তন করেন। বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়ে এবং যোগকলন্দর কাব্যে এ মতেরই সাধনপদ্ধতি আলোচিত হয়েছে। কাব্যখানি কে রচনা করেছেন তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না, তবে সতেরো শতকের কবি সৈয়দ মর্তুজাকে এর রচয়িতা বলে মনে করা হয়। কাব্যের শুরুতে নাসুত, মলকুত, জবরুত ও লাহুত দেহতত্ত্বভুক্ত এ চার মোকামের ব্যাখ্যা আছে। সুফির নাসুতে মূলাধার, মলকুতে মণিপুর, জবরুতে কলিজা এবং লাহুতে অনাহত চক্র সম্পর্কিত যোগসাধন প্রক্রিয়ার কথা আছে। মূলাধারে ধাতুর ঊর্ধ্বায়ন দ্বারা শক্তির উন্মেষ, মণিপুরে বায়ুর নিরোধ দ্বারা আত্মদর্শন, কলিজায় জ্যোতি ও আত্মার মিলন এবং অনাহতে জ্যোতির্ময় আল্লাহর উপলব্ধি হয়। কবির মতে মানবদেহেই পরমাত্মার অধিবাস এবং যোগসাধনার দ্বারা জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন সাধিত হয়।

শেখ চাঁদের দুখানি কাব্যই প্রশ্নোত্তরের আঙ্গিকে রচিত। হরগৌরী-সম্বাদ কাব্যে হর ও গৌরীর প্রশ্নোত্তরে যে তত্ত্বালোচনা আছে, তালিবনামায় কবি স্বয়ং এবং তাঁর পীর শাহ দৌলার প্রশ্নোত্তরে তাই আলোচিত হয়েছে। গুরুতত্ত্ব, স্রষ্টাতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব ও যোগতত্ত্ব এ কাব্যের প্রধান বিষয়বস্ত্ত। এছাড়াও  শিব কর্তৃক গৌরীকে মহাজ্ঞান ‘গুপ্তবিদ্যা’ দানের বিবরণ আছে। এক্ষেত্রে নাথধর্মের প্রভাব লক্ষ করা যায়।

হাজী মহম্মদের সুরতনামা কাব্যে ধর্মকর্ম ও বৈষয়িক উপদেশ-নির্দেশ ছাড়াও যোগভিত্তিক দেহতত্ত্ব ও সৃষ্টিতত্ত্বের বর্ণনা আছে। এ  গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে যে, শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারিফত এই চার আধ্যাত্মিক পন্থায় সিদ্ধি লাভ করা যায়।

শেখ মনসুর সির্নামা এবং  আলী রজা আগম ও জ্ঞানসাগর কাব্যে ইসলামি পরিভাষায় সুফিশাস্ত্রের বিবিধ তত্ত্ব ও উপদেশ বর্ণনা করেছেন। প্রথম গ্রন্থটি দরবেশি হকিকত ও কথন, তন ও দিলের বিচার, আরোহা তত্ত্ব, নিরঞ্জন তত্ত্ব ইত্যাদি দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত।

আলী রজা ছিলেন একজন পীর ও শক্তিমান কবি। সাধারণের নিকট তিনি কানু ফকির নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর কাব্যের ভাষা বেশ উন্নত ও মার্জিত। তাঁর প্রথম কাব্য আগমের বিষয়বস্ত্ত সৃষ্টিতত্ত্বব, চার মঞ্জিল, জলবায়ুতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব ও আল্লাহতত্ত্ব। জ্ঞানসাগর কাব্যে এই একই বিষয় বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। ফকির হলেই আল­াহকে পাওয়া যায় এরূপ বিশ্বাস এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আলী রজা ফকিরিপন্থা তথা সুফিসাধনার ওপর এভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন।

পদাবলি শ্রেণীর সুফি সাহিত্যে সুফিতত্ত্বের আধ্যাত্মিক ভাবের প্রকাশ ঘটেছে। মধ্যযুগে ছন্দোবদ্ধ ও গীতোপযোগী ছোট ছোট পদ্য রচনা ‘পদ’ নামে পরিচিত ছিল। বৈষ্ণব ধর্মমত অবলম্বনে এরূপ শত-সহস্র পদ রচিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন  চর্যাপদ এবং পরবর্তীকালে রচিত শাক্তপদ, বাউলপদ বা গান একই জাতীয় রচনা। সুফি ভাবধারায় রচিত অনুরূপ পদগুলিকে ‘সুফিপদ’ বলা যায়। সুফির পরিভাষায় একে ‘গজলিয়াৎ’  বা গীতপদ বলে।

আল্লাহ্ প্রেমময় ও সৌন্দর্যময়। তিনি অনন্ত, অবিনশ্বর ও সর্বত্র বিরাজমান। তিনিই সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা। জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ জীবনান্তে আল্লাহ্র নিকট ফিরে যায়। প্রেম ও ভক্তির পথে আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায়। আল্লাহ্তে অনুগত বা লীন হওয়া সুফি সাধকের চরম লক্ষ্য। গুরু বা মুর্শিদ সাধককে সেই পথ দেখিয়ে দেন। তিনি গুরুর নির্দেশমতো ইন্দ্রিয়মুক্তি ও চিত্তশুদ্ধির সাধনা করেন। সর্বপ্রকার জাগতিক মোহ ও আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহ্র নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের সাধনাই সুফির আধ্যাত্মিক সাধনা। এই সাধনার পথ নিষ্কণ্টক নয়। এজন্য সাধকের মনে নানারকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে। গুরুর চরণাশ্রয়, খোদার নিকট আত্মসমর্পণ, সাধক-চিত্তের নানা আশঙ্কা, অক্ষমতা, অপ্রাপ্তির বেদনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সুফিপদ রচিত হয়েছে। সুফি কবিরা আবেগ, উপলব্ধি, আবেদন, নিবেদন ইত্যাদি সরাসরি বা রূপক-প্রতীকের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে প্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার কথাই অধিক ব্যবহূত হয়েছে। রূপকার্থে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা পদাবলিতে এত বেশি ব্যবহূত হয়েছে যে, এ যুগের সমালোচকগণ এ ধারার কবিদের ‘মুসলমান বৈষ্ণব কবি’, ‘বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবি’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন। এছাড়াও সমাজ, ব্যক্তি, স্থান, প্রকৃতি প্রভৃতির প্রতীক এবং দেহতত্ত্বের পরিভাষা অবলম্বনেও সুফিপদ রচিত হয়েছে।

এযাবৎ প্রায় শতাধিক মুসলমান পদকর্তার নাম জানা গেছে। তাঁদের রচিত পদের সংখ্যাও কয়েক শত। প্রথম শ্রেণীর পদকর্তা হিসেবে আইনুদ্দীন, আফজল,  আলাওল, আলী রজা, নাসির মাহমুদ, মীর ফয়জুল­াহ, শেখ কবির,  শেখ চাঁদসৈয়দ মর্তুজাসৈয়দ সুলতান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের অনেকে আবার তত্ত্বপ্রধান শাস্ত্রকাব্যও রচনা করেছেন। সৈয়দ মর্তুজা ষাটের অধিক সুফিপদ রচনা করেছেন। কবির ভণিতাযুক্ত এসব পদের শীর্ষে রাগতালেরও উল্লেL আছে। সুতরাং পদগুলি যে গীতোদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল, তা সুনিশ্চিত। তবে মুসলিম সমাজে কোন উপলক্ষে এবং কীভাবে এগুলি গীত হতো, তা জানা যায় না। কবির ব্যক্তিগত আবেগ, অনুভূতি, ভাব, রস ও ভাষা সমন্বয়ে অনেক পদে কাব্যসৌন্দর্যও ফুটে উঠেছে। শাস্ত্রকাব্যে বাংলার মুসলমানদের সুফি ধর্মসাধনা ও তত্ত্বচিন্তা এবং পদাবলিতে তার অন্তর্মুখী ভাবনার পরিচয় নিহিত আছে। [ওয়াকিল আহমদ]

গ্রন্থপঞ্জি  মুহম্মদ এনামুল হক, মুসলিম বাংলা সাহিত্য, ২য় সংস্করণ, ঢাকা ১৯৬৫; আহমদ শরীফ সম্পাদিত, বাঙলার সুফী সাহিত্য, ঢাকা, ১৯৬৯; মুহম্মদ আবদুল হাই ও আহমদ শরীফ সম্পাদিত, মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা, ঢাকা, ১৯৬৮।