সিলেটি নাগরী: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
'''সিলেটি নাগরী''' বাংলা লিপির বিকল্প এক প্রকার লিপি। এক সময় প্রধানত''' '''সিলেট অঞ্চলে এটি প্রচলিত ছিল। তবে সিলেটের বাইরে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা এবং আসামের কাছার ও করিমগঞ্জেও এর ব্যবহার ছিল। আরবি, কাইথি, বাংলা ও দেবনাগরী লিপির সংমিশ্রণে চতুর্দশ শতকের প্রথম দশকে এ লিপির উদ্ভব ঘটে। আরবি ও ফারসি''' '''ভাষার সঙ্গে সিলেটের স্থানীয় ভাষার সংমিশ্রণে যে মুসলমানি বাংলা ভাষার প্রচলন হয়, তার বাহন হিসেবে সিলেটি নাগরী ব্যবহূত হতো। সিলেটের তৎকালীন মুসলমান লেখকগণ বাংলার পরিবর্তে এই লিপিতেই ধর্মীয় বিষয়সমূহ চর্চায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। হযরত শাহ জালালের (রা.) সমসাময়িক মুসলমান ধর্মপ্রচারকগণ এই লিপিতে ধর্মমত লিপিবদ্ধ করতেন বলেও জানা যায়। আহমদ হাসান দানীর মতে সিলেটে মুসলমান শাসনের শুরু থেকেই সিলেটি নাগরীর ব্যবহার চলে আসছে এবং আফগান মুদ্রায় এ লিপিমালার কয়েকটি লিপির ব্যবহার আছে। সিলেটি নাগরী ‘জালালাবাদী নাগরী’, ‘মুসলমানি নাগরী’ বা ‘ফুল নাগরী’ নামেও পরিচিত।
'''সিলেটি নাগরী''' বাংলা লিপির বিকল্প এক প্রকার লিপি। এক সময় প্রধানত সিলেট অঞ্চলে এটি প্রচলিত ছিল। তবে সিলেটের বাইরে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা এবং আসামের কাছার ও করিমগঞ্জেও এর ব্যবহার ছিল। আরবি, কাইথি, বাংলা ও দেবনাগরী লিপির সংমিশ্রণে চতুর্দশ শতকের প্রথম দশকে এ লিপির উদ্ভব ঘটে। আরবি ও ফারসি ভাষার সঙ্গে সিলেটের স্থানীয় ভাষার সংমিশ্রণে যে মুসলমানি বাংলা ভাষার প্রচলন হয়, তার বাহন হিসেবে সিলেটি নাগরী ব্যবহূত হতো। সিলেটের তৎকালীন মুসলমান লেখকগণ বাংলার পরিবর্তে এই লিপিতেই ধর্মীয় বিষয়সমূহ চর্চায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। হযরত শাহ জালালের (রা.) সমসাময়িক মুসলমান ধর্মপ্রচারকগণ এই লিপিতে ধর্মমত লিপিবদ্ধ করতেন বলেও জানা যায়। আহমদ হাসান দানীর মতে সিলেটে মুসলমান শাসনের শুরু থেকেই সিলেটি নাগরীর ব্যবহার চলে আসছে এবং আফগান মুদ্রায় এ লিপিমালার কয়েকটি লিপির ব্যবহার আছে। সিলেটি নাগরী ‘জালালাবাদী নাগরী’, ‘মুসলমানি নাগরী’ বা ‘ফুল নাগরী’ নামেও পরিচিত।


স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ মিলিয়ে সিলেটি নাগরীর বর্ণ মোট ৩২টি। স্বরবর্ণ ৫টি, যথা: A (আ), B (ই), C (উ), D (এ), E (ও)। ব্যঞ্জনবর্ণ ২৭টি, যথা: F (ক), G (খ), H (গ), I (ঘ), K (চ), L (ছ), M (জ), N (ঝ), O (ট), P (ঠ), Q (ড), R (ঢ), S (ত), T (থ), U (দ), V (ধ), W (ন), X (প), Y (ফ), Z (ব), a (ভ), b (ম), c (র), d (ল), e (ড়), f (শ), g (হ)। স্বরচিহ্ন ৬টি যথা: h (া-কার), i (--কার),  k (ু-কার), ` (--কার), ``(--কার)  এবং `h (vা-কার)। è (ল্ল), î (স্ত)  ও WU (ন্দ) এই তিনটি যুক্তবর্ণের বহুল ব্যবহার হলেও আরও ১৭টি যুক্তবর্ণ রয়েছে।
স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ মিলিয়ে সিলেটি নাগরীর বর্ণ মোট ৩২টি। স্বরবর্ণ ৫টি, যথা: A (আ), B (ই), C (উ), D (এ), E (ও)। ব্যঞ্জনবর্ণ ২৭টি, যথা: F (ক), G (খ), H (গ), I (ঘ), K (চ), L (ছ), M (জ), N (ঝ), O (ট), P (ঠ), Q (ড), R (ঢ), S (ত), T (থ), U (দ), V (ধ), W (ন), X (প), Y (ফ), Z (ব), a (ভ), b (ম), c (র), d (ল), e (ড়), f (শ), g (হ)। স্বরচিহ্ন ৬টি যথা: h (া-কার), i (--কার),  k (ু-কার), ` (--কার), ``(--কার)  এবং `h (vা-কার)। è (ল্ল), î (স্ত)  ও WU (ন্দ) এই তিনটি যুক্তবর্ণের বহুল ব্যবহার হলেও আরও ১৭টি যুক্তবর্ণ রয়েছে।
৮ নং লাইন: ৮ নং লাইন:
সিলেটি নাগরীতে দেবনাগরী ও আরবি প্রভাবজাত একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো স্বরবর্ণের চিহ্নগুলি ব্যঞ্জনবর্ণের পরে বসে। --কার ও  ী-কারের জন্য একটি মাত্র চিহ্ন সংশ্লিষ্ট বর্ণের ডানদিকে লেখা হয়, যা দেখতে অনেকটা উল্টা --কারের মতো। --কারের জন্য আরবি যবর ও দেবনাগরী --কারের ন্যায় অক্ষরের মাত্রার ওপর ডান থেকে বামে হেলানো একটি চিহ্ন (`) এবং  --কারের জন্য দুটি চিহ্ন (``) ব্যবহূত হয়। সিলেটি নাগরীরত্যে-ফলা,  ্র-ফলা ও রেফ (র্)-এর ব্যবহার না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে বর্ণের দ্বিত্ব প্রয়োগ লক্ষ করা যায়।
সিলেটি নাগরীতে দেবনাগরী ও আরবি প্রভাবজাত একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো স্বরবর্ণের চিহ্নগুলি ব্যঞ্জনবর্ণের পরে বসে। --কার ও  ী-কারের জন্য একটি মাত্র চিহ্ন সংশ্লিষ্ট বর্ণের ডানদিকে লেখা হয়, যা দেখতে অনেকটা উল্টা --কারের মতো। --কারের জন্য আরবি যবর ও দেবনাগরী --কারের ন্যায় অক্ষরের মাত্রার ওপর ডান থেকে বামে হেলানো একটি চিহ্ন (`) এবং  --কারের জন্য দুটি চিহ্ন (``) ব্যবহূত হয়। সিলেটি নাগরীরত্যে-ফলা,  ্র-ফলা ও রেফ (র্)-এর ব্যবহার না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে বর্ণের দ্বিত্ব প্রয়োগ লক্ষ করা যায়।


সিলেটে  [[চৈতন্য, শ্রী|শ্রীচৈতন্য]]''' '''(১৪৮৬-১৫৩৩) কর্তৃক হিন্দু নবজাগরণের সময় ব্যাপকভাবে দেবনাগরী লিপিতে সংস্কৃত চর্চা শুরু হলে মুসলমানরাও তাদের নবোদ্ভাবিত সিলেটি নাগরীতে পুস্তক রচনা শুরু করে। ১৮৬০-৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে সিলেটি নাগরী ছাপাখানা স্থাপনের পর থেকে এর প্রসার শুরু হয়। ‘সিলেট ইসলামিয়া ছাপাখানা’ এরূপ প্রথম প্রেস এবং মৌলবি  [[করিম, আব্দুল|আবদুল করিম]] টাইপ নির্মাণ ও প্রেস স্থাপনের প্রথম উদ্যোক্তা। পরে প্রতিষ্ঠিত ‘সিলেট শারদা প্রিন্টিং প্রেস’, কলকাতার ‘শিয়ালদহ হামিদী প্রেস’ ও গার্ডেনার লেনস্থ ‘জেনারেল প্রিন্টিং ওয়ার্কস’ থেকেও এ লিপিতে পুথিপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। সিলেটী নাগরীর পহেলা কেতাব এবং সিলেটী নাগরী লিখা নামক দুটি গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে এ লিপির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।
সিলেটে  [[চৈতন্য, শ্রী|শ্রীচৈতন্য]] (১৪৮৬-১৫৩৩) কর্তৃক হিন্দু নবজাগরণের সময় ব্যাপকভাবে দেবনাগরী লিপিতে সংস্কৃত চর্চা শুরু হলে মুসলমানরাও তাদের নবোদ্ভাবিত সিলেটি নাগরীতে পুস্তক রচনা শুরু করে। ১৮৬০-৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে সিলেটি নাগরী ছাপাখানা স্থাপনের পর থেকে এর প্রসার শুরু হয়। ‘সিলেট ইসলামিয়া ছাপাখানা’ এরূপ প্রথম প্রেস এবং মৌলবি  [[করিম, আব্দুল|আবদুল করিম]] টাইপ নির্মাণ ও প্রেস স্থাপনের প্রথম উদ্যোক্তা। পরে প্রতিষ্ঠিত ‘সিলেট শারদা প্রিন্টিং প্রেস’, কলকাতার ‘শিয়ালদহ হামিদী প্রেস’ ও গার্ডেনার লেনস্থ ‘জেনারেল প্রিন্টিং ওয়ার্কস’ থেকেও এ লিপিতে পুথিপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। সিলেটী নাগরীর পহেলা কেতাব এবং সিলেটী নাগরী লিখা নামক দুটি গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে এ লিপির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।


সিলেটি নাগরীতে রচিত পুথির ভাষা এবং দোভাষী পুথির ভাষা অভিন্ন। এতে  [[তৎসম|তৎসম]] শব্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে; যুক্তবর্ণের ব্যবহারও কম। আরবি-ফারসি ও হিন্দি-উর্দুর প্রচুর শব্দ সিলেটি নাগরীতে লিখিত পুথিতে প্রবেশ করেছে। দোভাষী পুথির অনুকরণে সিলেটি নাগরীর পুথির পত্রবিন্যাসও ডান থেকে বামে খরোষ্ঠি পদ্ধতিতে করা হতো।
সিলেটি নাগরীতে রচিত পুথির ভাষা এবং দোভাষী পুথির ভাষা অভিন্ন। এতে  [[তৎসম|তৎসম]] শব্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে; যুক্তবর্ণের ব্যবহারও কম। আরবি-ফারসি ও হিন্দি-উর্দুর প্রচুর শব্দ সিলেটি নাগরীতে লিখিত পুথিতে প্রবেশ করেছে। দোভাষী পুথির অনুকরণে সিলেটি নাগরীর পুথির পত্রবিন্যাসও ডান থেকে বামে খরোষ্ঠি পদ্ধতিতে করা হতো।
১৪ নং লাইন: ১৪ নং লাইন:
সিলেটি নাগরীতে লিখিত এযাবৎ প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ হচ্ছে সাধক কবি গোলাম হুছনের তালিব হুছন (১৫৪৯)। পরে ফাজিল নাসির মোহাম্মদ রাগনামা (১৭২৭), সৈয়দ শাহ নূর (১৭৩০-১৮৫৪) নূর নছিহত (১৮১৯), রাগনূর, সাতকন্যার বাখান, শাহ হুছন আলম (১৭৫০-১৮৫০) ভেদসার, শীতালাং শাহ (মৃত্যু. ১৮০০) মুশকিল তরান, হাসর তরান, রাগবাউল, কেয়ামতনামা, শীতালাঙ্গী রাগ, নছিম আলী (১৮১৩-১৯২০) হরুফুল খাছলাত (১৮৭৫), মুন্সী মোহাম্মদ সাদেক আলী হালতুন্নবী (১৮৫৫), মহববতনামা, হাসর মিছিল, রদ্দেকুফুর ইত্যাতি গ্রন্থ রচনা করেন। আবদুল করিম রচিত কড়িনামা, ছদছী মছলা, সোনাভানের পুঁথি খুবই জনপ্রিয় ছিল। এযাবৎ প্রাপ্ত তথ্যে ষাটজন লেখকের মুদ্রিত ও পান্ডুলিপি মিলিয়ে ১৫০খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। লেখকের নামবিহীন জনপ্রিয় পুথিগুলির মধ্যে হরিণনামা, হুশিয়ারনামা, সফাতুন্নবী, আবু সামা, নূর নাজাত, পেঁচার গল্প  ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সিলেটি নাগরীতে লিখিত এযাবৎ প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ হচ্ছে সাধক কবি গোলাম হুছনের তালিব হুছন (১৫৪৯)। পরে ফাজিল নাসির মোহাম্মদ রাগনামা (১৭২৭), সৈয়দ শাহ নূর (১৭৩০-১৮৫৪) নূর নছিহত (১৮১৯), রাগনূর, সাতকন্যার বাখান, শাহ হুছন আলম (১৭৫০-১৮৫০) ভেদসার, শীতালাং শাহ (মৃত্যু. ১৮০০) মুশকিল তরান, হাসর তরান, রাগবাউল, কেয়ামতনামা, শীতালাঙ্গী রাগ, নছিম আলী (১৮১৩-১৯২০) হরুফুল খাছলাত (১৮৭৫), মুন্সী মোহাম্মদ সাদেক আলী হালতুন্নবী (১৮৫৫), মহববতনামা, হাসর মিছিল, রদ্দেকুফুর ইত্যাতি গ্রন্থ রচনা করেন। আবদুল করিম রচিত কড়িনামা, ছদছী মছলা, সোনাভানের পুঁথি খুবই জনপ্রিয় ছিল। এযাবৎ প্রাপ্ত তথ্যে ষাটজন লেখকের মুদ্রিত ও পান্ডুলিপি মিলিয়ে ১৫০খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। লেখকের নামবিহীন জনপ্রিয় পুথিগুলির মধ্যে হরিণনামা, হুশিয়ারনামা, সফাতুন্নবী, আবু সামা, নূর নাজাত, পেঁচার গল্প  ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।


ষোড়শ শতকের শেষ এবং সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকের আফগান মুদ্রায় সিলেটি নাগরীর ব্যবহার দেখা যায়। সিলেট ডিস্ট্রিক্ট মহাফেজখানা এবং মৌলভীবাজার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সিলেটি নাগরীতে লিখিত কয়েকটি দলিল সংরক্ষিত আছে।
ষোড়শ শতকের শেষ এবং সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকের আফগান মুদ্রায় সিলেটি নাগরীর ব্যবহার দেখা যায়। সিলেট ডিস্ট্রিক্ট মহাফেজখানা এবং মৌলভীবাজার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সিলেটি নাগরীতে লিখিত কয়েকটি দলিল সংরক্ষিত আছে। [মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম]
 
[মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম]


'''গ্রন্থপঞ্জি'''  শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী, সিলেটী ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, ঢাকা, ১৯৬১; সৈয়দ মোর্তজা আলী, ‘সিলেটের নাগরীলিপি ও বাংলা সাহিত্য’, সাহিত্য পত্রিকা, ঢাকা, ১৯৬১; গোলাম আকবর চৌধুরী, সিলেটী নাগরী পরিক্রমা, ১৯৭৮; ডক্টর গোলাম কাদির, ‘সিলেটী নাগরী: পঠন-পাঠন’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, জুন ১৯৮২; দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা: উত্তরাধিকার ও মুসলমানী নাগরী, ঢাকা, ২০০১।
'''গ্রন্থপঞ্জি'''  শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী, সিলেটী ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, ঢাকা, ১৯৬১; সৈয়দ মোর্তজা আলী, ‘সিলেটের নাগরীলিপি ও বাংলা সাহিত্য’, সাহিত্য পত্রিকা, ঢাকা, ১৯৬১; গোলাম আকবর চৌধুরী, সিলেটী নাগরী পরিক্রমা, ১৯৭৮; ডক্টর গোলাম কাদির, ‘সিলেটী নাগরী: পঠন-পাঠন’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, জুন ১৯৮২; দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা: উত্তরাধিকার ও মুসলমানী নাগরী, ঢাকা, ২০০১।

০৬:৪৬, ২২ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

সিলেটি নাগরী বাংলা লিপির বিকল্প এক প্রকার লিপি। এক সময় প্রধানত সিলেট অঞ্চলে এটি প্রচলিত ছিল। তবে সিলেটের বাইরে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা এবং আসামের কাছার ও করিমগঞ্জেও এর ব্যবহার ছিল। আরবি, কাইথি, বাংলা ও দেবনাগরী লিপির সংমিশ্রণে চতুর্দশ শতকের প্রথম দশকে এ লিপির উদ্ভব ঘটে। আরবি ও ফারসি ভাষার সঙ্গে সিলেটের স্থানীয় ভাষার সংমিশ্রণে যে মুসলমানি বাংলা ভাষার প্রচলন হয়, তার বাহন হিসেবে সিলেটি নাগরী ব্যবহূত হতো। সিলেটের তৎকালীন মুসলমান লেখকগণ বাংলার পরিবর্তে এই লিপিতেই ধর্মীয় বিষয়সমূহ চর্চায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। হযরত শাহ জালালের (রা.) সমসাময়িক মুসলমান ধর্মপ্রচারকগণ এই লিপিতে ধর্মমত লিপিবদ্ধ করতেন বলেও জানা যায়। আহমদ হাসান দানীর মতে সিলেটে মুসলমান শাসনের শুরু থেকেই সিলেটি নাগরীর ব্যবহার চলে আসছে এবং আফগান মুদ্রায় এ লিপিমালার কয়েকটি লিপির ব্যবহার আছে। সিলেটি নাগরী ‘জালালাবাদী নাগরী’, ‘মুসলমানি নাগরী’ বা ‘ফুল নাগরী’ নামেও পরিচিত।

স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ মিলিয়ে সিলেটি নাগরীর বর্ণ মোট ৩২টি। স্বরবর্ণ ৫টি, যথা: A (আ), B (ই), C (উ), D (এ), E (ও)। ব্যঞ্জনবর্ণ ২৭টি, যথা: F (ক), G (খ), H (গ), I (ঘ), K (চ), L (ছ), M (জ), N (ঝ), O (ট), P (ঠ), Q (ড), R (ঢ), S (ত), T (থ), U (দ), V (ধ), W (ন), X (প), Y (ফ), Z (ব), a (ভ), b (ম), c (র), d (ল), e (ড়), f (শ), g (হ)। স্বরচিহ্ন ৬টি যথা: h (া-কার), i (--কার),  k (ু-কার), ` (--কার), ``(--কার)  এবং `h (vা-কার)। è (ল্ল), î (স্ত)  ও WU (ন্দ) এই তিনটি যুক্তবর্ণের বহুল ব্যবহার হলেও আরও ১৭টি যুক্তবর্ণ রয়েছে।

সিলেটি নাগরী বর্ণমালার ৩২টি বর্ণের মধ্যে ই, ঘ, জ, ঠ, ড, ঢ, দ, ড় এই আটটি বাংলা বর্ণমালা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। আ, ঝ, ধ, র, ল, হ এ ছয়টি সিলেটি নাগরীর নিজস্ব বর্ণ। উ, ব, ম, শ এই চারটি বর্ণ আফগান মুদ্রায় ব্যবহূত হয়। ক, খ, ফ, ও অক্ষরের ওপর আরবির প্রভাব আছে। উ, এ, গ, ঘ, চ, ট, ত, থ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম এই চৌদ্দটি বর্ণের সঙ্গে দেবনাগরী ও কাইথি বর্ণের সাদৃশ্য আছে। আরবি-ফারসির অনুকরণে সিলেটি নাগরীতে অ-বর্ণ নেই। আরবি   (ওয়াও) বর্ণের অনুকরণে ব-এর নিচে বিন্দু দিয়ে  ও-কে গ্রহণ করা হয়েছে। সিলেটি নাগরীর ক, খ ও ফ-এর উচ্চারণ আরবি   (কাফ),   (খে) ও    (ফে)-এর মতো। এগুলি সিলেটের আঞ্চলিক উচ্চারণের সমতা রক্ষা করছে।

সিলেটি নাগরীতে দেবনাগরী ও আরবি প্রভাবজাত একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো স্বরবর্ণের চিহ্নগুলি ব্যঞ্জনবর্ণের পরে বসে। --কার ও  ী-কারের জন্য একটি মাত্র চিহ্ন সংশ্লিষ্ট বর্ণের ডানদিকে লেখা হয়, যা দেখতে অনেকটা উল্টা --কারের মতো। --কারের জন্য আরবি যবর ও দেবনাগরী --কারের ন্যায় অক্ষরের মাত্রার ওপর ডান থেকে বামে হেলানো একটি চিহ্ন (`) এবং  --কারের জন্য দুটি চিহ্ন (``) ব্যবহূত হয়। সিলেটি নাগরীরত্যে-ফলা,  ্র-ফলা ও রেফ (র্)-এর ব্যবহার না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে বর্ণের দ্বিত্ব প্রয়োগ লক্ষ করা যায়।

সিলেটে  শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩) কর্তৃক হিন্দু নবজাগরণের সময় ব্যাপকভাবে দেবনাগরী লিপিতে সংস্কৃত চর্চা শুরু হলে মুসলমানরাও তাদের নবোদ্ভাবিত সিলেটি নাগরীতে পুস্তক রচনা শুরু করে। ১৮৬০-৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে সিলেটি নাগরী ছাপাখানা স্থাপনের পর থেকে এর প্রসার শুরু হয়। ‘সিলেট ইসলামিয়া ছাপাখানা’ এরূপ প্রথম প্রেস এবং মৌলবি  আবদুল করিম টাইপ নির্মাণ ও প্রেস স্থাপনের প্রথম উদ্যোক্তা। পরে প্রতিষ্ঠিত ‘সিলেট শারদা প্রিন্টিং প্রেস’, কলকাতার ‘শিয়ালদহ হামিদী প্রেস’ ও গার্ডেনার লেনস্থ ‘জেনারেল প্রিন্টিং ওয়ার্কস’ থেকেও এ লিপিতে পুথিপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। সিলেটী নাগরীর পহেলা কেতাব এবং সিলেটী নাগরী লিখা নামক দুটি গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে এ লিপির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।

সিলেটি নাগরীতে রচিত পুথির ভাষা এবং দোভাষী পুথির ভাষা অভিন্ন। এতে  তৎসম শব্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে; যুক্তবর্ণের ব্যবহারও কম। আরবি-ফারসি ও হিন্দি-উর্দুর প্রচুর শব্দ সিলেটি নাগরীতে লিখিত পুথিতে প্রবেশ করেছে। দোভাষী পুথির অনুকরণে সিলেটি নাগরীর পুথির পত্রবিন্যাসও ডান থেকে বামে খরোষ্ঠি পদ্ধতিতে করা হতো।

সিলেটি নাগরীতে লিখিত এযাবৎ প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ হচ্ছে সাধক কবি গোলাম হুছনের তালিব হুছন (১৫৪৯)। পরে ফাজিল নাসির মোহাম্মদ রাগনামা (১৭২৭), সৈয়দ শাহ নূর (১৭৩০-১৮৫৪) নূর নছিহত (১৮১৯), রাগনূর, সাতকন্যার বাখান, শাহ হুছন আলম (১৭৫০-১৮৫০) ভেদসার, শীতালাং শাহ (মৃত্যু. ১৮০০) মুশকিল তরান, হাসর তরান, রাগবাউল, কেয়ামতনামা, শীতালাঙ্গী রাগ, নছিম আলী (১৮১৩-১৯২০) হরুফুল খাছলাত (১৮৭৫), মুন্সী মোহাম্মদ সাদেক আলী হালতুন্নবী (১৮৫৫), মহববতনামা, হাসর মিছিল, রদ্দেকুফুর ইত্যাতি গ্রন্থ রচনা করেন। আবদুল করিম রচিত কড়িনামা, ছদছী মছলা, সোনাভানের পুঁথি খুবই জনপ্রিয় ছিল। এযাবৎ প্রাপ্ত তথ্যে ষাটজন লেখকের মুদ্রিত ও পান্ডুলিপি মিলিয়ে ১৫০খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। লেখকের নামবিহীন জনপ্রিয় পুথিগুলির মধ্যে হরিণনামা, হুশিয়ারনামা, সফাতুন্নবী, আবু সামা, নূর নাজাত, পেঁচার গল্প  ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

ষোড়শ শতকের শেষ এবং সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকের আফগান মুদ্রায় সিলেটি নাগরীর ব্যবহার দেখা যায়। সিলেট ডিস্ট্রিক্ট মহাফেজখানা এবং মৌলভীবাজার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সিলেটি নাগরীতে লিখিত কয়েকটি দলিল সংরক্ষিত আছে। [মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম]

গ্রন্থপঞ্জি  শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী, সিলেটী ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা, ঢাকা, ১৯৬১; সৈয়দ মোর্তজা আলী, ‘সিলেটের নাগরীলিপি ও বাংলা সাহিত্য’, সাহিত্য পত্রিকা, ঢাকা, ১৯৬১; গোলাম আকবর চৌধুরী, সিলেটী নাগরী পরিক্রমা, ১৯৭৮; ডক্টর গোলাম কাদির, ‘সিলেটী নাগরী: পঠন-পাঠন’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, জুন ১৯৮২; দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা: উত্তরাধিকার ও মুসলমানী নাগরী, ঢাকা, ২০০১।