সারস

সারস (Crane)  Gruiformes বর্গের Gruidae গোত্রের বড়, লম্বা পা বিশিষ্ট, জলাশয়ে বিচরণকারী পাখি। এদের গলা আর ঠোঁট সরু ও লম্বা, ডানা শক্তিশালী। উত্তর আমেরিকা, পূর্ব গোলার্ধ ও অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা এই আকর্ষণীয় পাখিরা স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে উজ্জ্বল রঙের। এদের বক বলে ভুল করা হয়, তবে সাধারণত সারস পাখি আকারে বড়, মাথার একাংশ পালকহীন, ঠোঁট ভারি, পালক ঘনবদ্ধ এবং পিছনের আঙুল উঁচানো। ওড়ার সময় লম্বা গলা সামনে প্রসারিত থাকে, পিছনে থাকে সম্প্রসারিত লম্বা পা। এরা রেইল (rail) পাখিদের খুব ঘনিষ্ঠ। সারস জলাভূমি ও মাঠের বাসিন্দা, সাধারণত শস্য ও উদ্ভিজ্জ এদের খাদ্য; কখনও কীটপতঙ্গ এবং অন্যান্য ছোট প্রাণী শিকার করে খায়। সারাবিশ্বে সারস প্রজাতির সংখ্যা ১৫, তন্মধ্যে বাংলাদেশে ২, একটি পরিযায়ী ও একটি স্থায়ী বাসিন্দা। আফ্রিকার ঝুঁটিদার সারস Balearica pavonina আদি সারসদের নিকটতম উত্তরসূরি; তা থেকেই অবশিষ্ট ১৪ প্রজাতির সারসের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। এ দলের সাইবেরীয় সারস Grus leucogeranus দেখতে চমৎকার। সারস দীর্ঘজীবী পাখি। জানা যায় একটি খাঁচার সারস ৭৮ বছর বয়সেও বাচ্চাদের লালন-পালন করেছে এবং ৮৩ বছর বয়সে মারা গেছে।

সারস পাখি

সারসেরা উচ্চকণ্ঠ, প্রণয় আচরণ, একগামিতা ও বাচ্চার প্রতি যত্নের জন্য প্রসিদ্ধ। একটি সারস দম্পতি কয়েক একর জলাভূমি ও তৃণভূমি প্রজননক্ষেত্র হিসেবে দখলে রাখে। তারা বিরান এলাকায় অগভীর পানিতে মাচানের মতো বাসা বানায় এবং দুটি ডিম পাড়ে। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি পর্যায়ক্রমে ডিমে তা দেয় ও বাচ্চাদের লালন-পালন করে। পরবর্তী প্রজনন মৌসুমের পূর্ব পর্যন্ত বাচ্চারা স্ত্রী ও পুরুষ সারসের সঙ্গে থাকে। উত্তর মহাদেশের সারসরা প্রজননক্ষেত্র ও শীত কাটানোর জায়গার সন্ধানে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। অল্পবয়সী সারসরা স্ত্রী ও পুরুষ পাখির সঙ্গে হৈমন্তিক পরিযানে যোগ দিয়ে পথগুলি চিনে নেয়।

জলাভূমি ও তৃণভূমির আবাস ধ্বংস, উত্তর গোলার্ধে ব্যাপক শিকার এবং অতি সম্প্রতি আফ্রিকায় বিষ প্রয়োগে নিধনের দরুন বিস্তৃত স্থানে বসবাসে অভ্যস্ত এই পাখিদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বিপন্ন ৭ প্রজাতির সারস শনাক্ত করা গেছে। অতিবিপন্ন উত্তর আমেরিকার হুপিং ক্রেইন (Grus americana), ১৯৪১ সালে প্রাকৃতিক পরিবেশে ছিল এক ডজনের কিছু বেশি। কানাডা (যেখানে এগুলির প্রজননক্ষেত্র) ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (যেখানে শীত কাটায়)  এই দুটি দেশের যৌথ সংরক্ষণ প্রচেষ্টার ফলে মূল পরিযান দলে এদের সংখ্যা এখন প্রায় ২০০। সংরক্ষণ করলে সারসেরা জনবসতির আশেপাশের পরিবেশে ভালই খাপ-খাওয়াতে পারে। ভারতীয় সারস হিন্দুদের কাছে পবিত্র বিধায় এগুলি সেখানকার ঘনবসতি এলাকায়ও টিকে আছে, গ্রামের জলাশয়ের কিনারে বাসা বানায় ও ডিম পাড়ে, ক্ষেতে-খামারে ঘুরে বেড়ায়। এদের বাংলাদেশেও দেখা যায়। মঙ্গোলীয়রা ডেমোওজেল ক্রেন (Demoiselle Crane, Grus virgo) শিকার করে না। সেখানকার সারসরা বিশাল তৃণক্ষেত্রে বাসা বানায় ও বসতির আশেপাশে খাবার খুঁজে বেড়ায়। এই জাতের সারসদের শীতকালে বাংলাদেশ এবং সংলগ্ন অঞ্চলেও দেখা যায়। তদ্রূপ আফ্রিকার কোন কোন অঞ্চলে ঝুঁটিদার সারসেরা নিরাপদে থাকে, গ্রামের গাছগাছালিতে রাত কাটায়। সারসকুলে উত্তর আমেরিকার স্যান্ডহিল সারসদেরই সংখ্যা বেশি। উত্তরের প্রজনন ক্ষেত্রে যাওয়ার আগে এই জাতের পাঁচ লক্ষাধিক সারস মধ্য-আমেরিকার প­াতে নদীর এলাকায় ৬৫ কিলোমিটার জুড়ে একত্রিত হয়। নাব্রাস্কায় বসন্তকালে হাজার হাজার পর্যটক স্যান্ডহিল ক্রেনের সমাবেশ দেখতে আসে।

বাংলাদেশের একমাত্র স্থায়ী সারস পাখি (Sarus Crane, G. antigone) দুই মিটার থেকে সামান্য নিচু; লম্বা পা ও লম্বা গলাবিশিষ্ট ধূসর রঙের বিশাল পাখি, মাথা ও গলার ঊর্ধ্বাংশ পালকহীন, মাথা লাল। স্ত্রী ও পুরুষ সারস দৃশ্যত অভিন্ন, স্ত্রী পাখি আকারে সামান্য ছোট। কমবয়সীরা বাদামি-ধূসর, মাথা ও গলা কালচে বা দারুচিনি রঙের পালকে ঢাকা। সাধারণত সজোড়, কখনও মা-বাবার সঙ্গে থাকে গত মৌসুমের দুএকটি ছানা। শীতের শেষে ছড়ানো-ছিটানো দলে ৬০-৭০টি থাকে। প্রধানত মাছ খায়, তবে চিংড়ি, কাঁকড়া, ফড়িং, ব্যাঙ, টিকটিকিও খায়। উদ্ভিজ্জ আহারে তেমন আকৃষ্ট নয়। ডাকে সুরেলা উচ্চস্বরে। প্রজনন মৌসুমে প্রণয়নৃত্যে অত্যন্ত উচ্ছল। এই নৃত্যে দুজনেই শরিক হয়। জুলাই থেকে ডিসেম্বরে দুটি ডিম পাড়ে; হালকা সবুজ বা গোলাপি। এ পাখি দেশের উত্তর, দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের হাওর ও বাগেরহাট জেলায় বিস্তৃত। এদের পরিযায়ী একটি প্রজাতি হচ্ছে ডেমোওজেল ক্রেন (Demoiselle Crane), স্থায়ী সারসের চেয়ে আকারে ছোট, প্রায় ৮০ সেমি উঁচু, ধূসর রঙের পাখি। মাথা ও গলা কালো, চোখের পিছনে কানের কাছে সাদা রঙের পালকগুচ্ছ আছে। গলার নিচের দিকের লম্বা পালকগুলি চোখা ও বুক পর্যন্ত নামানো। লেজের উপর বাদামি-ধূসর দ্বিতীয় পর্যায়ের ঝুলন্ত পালক থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ দৃশ্যত অভিন্ন। কমবয়সীরা বড়দের মতো, তবে ঝুঁটি ছাড়া, মাথা ধূসর রঙের। [মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম]