সাপ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২৩:০৮, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

সাপ  Reptilia শ্রেণীর Serpentes বর্গের অন্তর্ভুক্ত লম্বা বেলনাকার পা-হীন মেরুদন্ডী প্রাণী। এদের দেহ অাঁশ দ্বারা আবৃত, দেহে স্কন্ধবেষ্টনী ও উপাঙ্গ নেই। অবশ্য অজগরজাতীয় সাপের কোন কোন প্রজাতির দেহে শ্রোণিচক্রের অবশেষ ও পশ্চাৎপদের কিছু চিহ্ন এখনও রয়েছে। সাপ মাটিতে, মাটির নিচে গর্তে বা সুড়ঙ্গে, গাছে ও পানিতে থাকতে পারে। প্রায় সব সাপ সাঁতার কাটতে পারে। কালনাগিনী সাপ (Chrysopelea ornata) গাছের উঁচু ডাল থেকে নিচের ডালে গড়িয়ে পড়তে পারে।

সাপ বছরে কয়েকবার খোলস বদলায়। এদের কশেরুকার সংখ্যা সর্বাধিক ১০০ থেকে ৪০০। সাপের কোন বহিঃকর্ণ নেই, যেজন্য বায়ুবাহিত শব্দ নিখুঁতভাবে গ্রহণ করতে পারে না। তবে মাটি বা অন্য যে মাধ্যমে এরা থাকে তা থেকে শব্দ তরঙ্গ নিচের চোয়াল ও কোয়াড্রেট অস্থির মাধ্যমে অন্তঃকর্ণ গ্রহণ করতে পারে। সাপের কান ও চোখের পাতা নেই। চোয়ালের দুই অংশের হাড় নমনীয় অস্থিবন্ধনী দিয়ে যুক্ত থাকায় শিকার গেলার সময় চোয়ালের প্রতি অর্ধাংশ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।

সাপ অনুষ্ণশোণিত (poikilothermic) প্রাণী, কারণ সাপের তিন প্রকোষ্ঠীয় হূৎপিন্ডে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত ও অক্সিজেনবিহীন রক্তের আংশিক মিশ্রণ ঘটে, ফলে ধমনিসমূহ মিশ্ররক্ত বহন করায় তা দেহের তাপমাত্রা স্থির রাখার মতো শক্তি যোগাতে পারে না। সাপের জিভের আগা দ্বিধাবিভক্ত। চোয়ালের বিশেষ একটি ছিদ্র দিয়ে, এমনকি মুখ বন্ধ থাকলেও, সাপ জিহবাকে ভিতরে-বাইরে আনা-নেওয়া করতে পারে। উপরের চোয়ালের দুই পাশে জ্যাকবসনস প্রত্যঙ্গ (Jacobson’s organ) থাকে। জিহবাকে মুখের ভিতরে ঢুকালে আগাগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্যাকবসনস প্রত্যঙ্গ স্পর্শ করে, যেখান থেকে রাসায়নিক সংকেত পায়। জ্যাকবসনস প্রত্যঙ্গের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং জিহবা ভিতর-বাহির করার মাধ্যমে বায়ু ও মাটি থেকে সংগৃহীত তথ্য সাপের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাপের জিহবা কার্যত শোনার অক্ষমতা ও ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির ঘাটতি মেটায়।

সাপের প্রতি চোয়ালের পিছনমুখী অনেকগুলি সাধারণ দাঁতের মধ্যে কেবল এক বা দুই জোড়া দাঁতই বিষদাঁত বা দ্রুতগামী শিকার ধরার উপযুক্ত দাঁতে রূপান্তরিত হতে পারে। সাপ কেবল জীবন্ত প্রাণীই আহার করে। যদিও ভারতীয় ডিমভুক সাপ (Indian Egg-eater, Elachistodon westermanni) ডিমও খায়। সাপ নিজের আকার অনুযায়ী ব্যাঙ, টিকটিকি, অন্যান্য সাপ, ছোট পাখি, ইঁদুরজাতীয় প্রাণী, ছোট স্তন্যপায়ী, মাছ ইত্যাদি খায়। বড় সাপ শিকারকে আস্ত গিলে ফেলে। সাধারণত সাপ শিকারকে পেঁচিয়ে অাঁকড়ে ধরে ও পরে শ্বাসরোধ করে মারে। বিষধর সাপ কখনও কখনও শিকারের দেহে বিষ ঢেলে শিকারের শরীর অবশ করে দেয়। সাপের পরিপাকতন্ত্র খুবই শক্তিশালী বিধায় পাকস্থলিতে শিকারের দেহের সকল অংশ হজম হয়ে যায়। ডিমভুক সাপ অবশ্য ডিমের ভিতরের অংশ খাওয়ার সময় ডিমের খোসা উগলে ফেলে। সাপ কদাচিৎ পানি পান করে।

অধিকাংশ পুরুষ সাপে একজোড়া অর্ধশিশ্ন (hemipenis) থাকলেও যৌনমিলনের সময় দুটির বদলে একটি ব্যবহার করে। সাপ একা থাকতে বেশি পছন্দ করে। তবে গোখরা থাকে জোড়ায়। অধিকাংশ সাপ ডিম পাড়ে। দেহের বাইরেই ডিমের ভিতরে ভ্রূণ বৃদ্ধি পায় এবং ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। কেবল লাউডগা সাপ (Ahaetulla nasutus), স্বাদুপানির কিছু সাপ, সমুদ্র ও সমুদ্রমোহনায় বসবাসকারী কিছু সাপ এবং Viper snake ডিম পাড়ে না, ডিম্ব-জরায়ুজ (ovo-viviparous) বা জরায়ুজ (viviparous) প্রক্রিয়ায় জীবন্ত সন্তান প্রসব করে।

বাংলাদেশে প্রায় ৯০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। দেশের সহজদৃষ্ট সাপের মধ্যে ঢোঁড়া (Xenochropis piscator), ডোরা (Amphiesma stolata), ঘরগিন্নী (Lycodon jara), কুকরী (Oligodon cinereus), মেটেসাপ (Atretium schistosum), দুধরাজ সাপ (Elaphe radiata), ফণিমনসা, পাইন্যা বা পানিসাপ (Enhydris enhydris), দাঁড়াশ, অজগর, গোখরা ও সামুদ্রিক সাপ। অধিকাংশ সাপ নির্বিষ এবং মানুষের ক্ষতি করে না। এদেশে অতি বিষধর সাপের সংখ্যা আধা ডজনেরও কম। এদের এড়িয়ে চলা কষ্টকর নয়।

সামগ্রিক বিবেচনায় সাপ মানুষের বন্ধু। প্রতিবছর ফসলের ক্ষতিকর প্রাণী বা মানুষের জন্য বিপজ্জনক বিপুল সংখ্যক জীবজন্তু খেয়ে সাপ মানুষের উপকার করে। সাপের চামড়ার বাজারদর বেশ চড়া। দূরপ্রাচ্যের দেশসমূহে জীবন্ত সাপও রপ্তানি হয়। কোন কোন সম্প্রদায়ের মানুষ বেশ কিছু প্রজাতির সাপের পূজা করে।

নির্বিষ সাপ (Non-poisonous snake)  বিষদাঁত ও বিষ উৎপাদক অঙ্গ বা বিষগ্রন্থিহীন সাপ। বাংলাদেশে ৯০ প্রজাতির সাপের তিন-চতুর্থাংশই নির্বিষ। Typhlopidae, Boidae ও Acrochoridae গোত্রভুক্ত সব সাপই নির্বিষ। Colubridae গোত্রভুক্ত অধিকাংশ সাপও বিষহীন। পূর্বোক্ত সবগুলি গোত্রই Serpentes বর্গভুক্ত।

নির্বিষ সাপ (বালুবোড়া)

সাধারণ নির্বিষ সাপ হলো: দুমুখা সাপ (তিনটি প্রজাতি), অজগর, গোলবাহার, বালুবোড়া, অাঁচিল সাপ (Acrochordus granulatus), সবুজ ঢোঁড়াসাপ (Macropisthodon plumbicolor), মেটেসাপ (Argyrogena fasciolatus), সবুজ দাঁড়াশ (Coluber nigromarginatus), গেছোসাপ (Dendrelaphis তিনটি প্রজাতি), দুধরাজ সাপ (Elaphe helena), ক্যানটর কালোমাথা সাপ (Sibynophis saggitaria), শামুকখোর সাপ (Pareas দুটি প্রজাতি), ঘরগিন্নি সাপ (Lycodon তিনটি প্রজাতি), কুকরী সাপ (Oligodon গণের ৭-৮ প্রজাতি)  ইত্যাদি।


অধিকাংশ নির্বিষ সাপের মজবুত পিছনমুখী দাঁত রয়েছে, যা দ্বারা শিকারকে শক্তভাবে ধরে রাখতে এবং চেপে মারতে পারে। কোন কোন সাপ শিকার নড়াচড়ার শক্তি না হারানো পর্যন্ত সেটা শক্তভাবে ধরে রাখে। কেউ জীবন্ত শিকারই গিলতে শুরু করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের শামুকখোর সাপের চোয়াল, দাঁত এবং গলার অাঁশ শামুকের খোলক থেকে নরম অংশ বের করে আনার উপযোগী।

নির্বিষ সাপ (ঢোঁড়া সাপ)

ফসলের ক্ষতিকর প্রাণী নিয়ন্ত্রণে (যেমন ইঁদুর) নির্বিষ সাপ খুবই উপকারী। এই সাপ মানুষের বাসস্থানের অদূরেই থাকে, যেমন দাঁড়াশ, দুধরাজ, গোলবাহার, বালুবোড়া ও ঘরগিন্নি সাপ। এসব সাপের চামড়ার বাজারদরও যথেষ্ট। অজগর, গোলবাহার, দাঁড়াশ, ঢোঁড়া ও দুধরাজ সাপের চামড়া মহিলাদের পোষাক, হাতব্যাগ, মানিব্যাগ, কুটির শিল্প সামগ্রী, জুতা ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহূত হয়। অধিকাংশ সাপের মাংসের রং সাদা, এতে কোলেস্টেরল কম এবং সুস্বাদু। নির্বিষ সাপ চিড়িয়াখানা ও সর্প উদ্যানের প্রধান আকর্ষণ।

বিষধর সাপ (Poisonous snake)  বিষ বা বিষগ্রন্থি ও বিষদাঁতযুক্ত কয়েক প্রজাতির সাপ। এই সাপদের শিকারের বা আক্রান্তের দেহে বিষদাঁতের মাধ্যমে বিষগ্রন্থি থেকে বিষ ঢেলে দেওয়ার বা বিষ ঢুকিয়ে দেওয়ার কার্যপ্রণালী থাকে। দেহে বিষ ঢোকানো হলে আক্রান্ত প্রাণী সাময়িকভাবে চলৎশক্তিহীন, মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত, এমনকি মারাও যেতে পারে। Elapidae গোত্রভুক্ত গোখরা ও শাখিনী এবং Hydrophidae গোত্রভুক্ত সামুদ্রিক সাপ এবং Viperidae গোত্রের পিট-ভাইপারসহ অন্য সব ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া জাতীয় সাপ বিষধর। Colubridae গোত্রের কয়েকটি সাপও বিষধর হিসেবে গণ্য।

Colubridae গোত্রের বিষধর সাপগুলি পশ্চাৎ-বিষদন্তীদের (opistoglyph) দলভুক্ত। Elapidae ও Hydrophidae গোত্রভুক্ত সাপগুলি পুরো-বিষদন্তী (proteroglyph) এবং এদের বিষদাঁত মাড়ির সঙ্গে দৃঢ়বদ্ধ। Viperidae গোত্রভুক্ত সাপেরাও পুরো-বিষদন্তী, তবে এই গোত্রের বিষধর সাপগুলি মুখের তালুর সঙ্গে বিষদাঁতকে ভাঁজ করে রাখতে পারে (solenoglyphs)। সকল সাপের বিষগ্রন্থিই ঊর্ধ্বচোয়ালের লালাগ্রন্থির পরিবর্তিত রূপ, যা কেবল লালা ও কিছু হজমি উৎসেচকই নয়, কতকগুলি প্রোটিনও নিঃসরণ করে, যেগুলি আক্রান্ত প্রাণীর জন্য অল্প বা অত্যধিক বিষাক্ত।

বিষধর সাপ (গোখরা)
বিষধর সাপ (ধারাজ)


বিষধর Colubridae সদস্যদের এক জোড়া Duvernoy’s gland বা কর্ণমূলগ্রন্থি অধি-ওষ্ঠ বা ঊর্ধ্বোষ্ঠ গ্রন্থির সঙ্গে একীভূত থাকে এবং শে­ষ্মাকোষ উৎপাদন করে। ঊর্ধ্বোষ্ঠ গ্রন্থির পিছনে অবস্থিত Duvernoy’s গ্রন্থিতে বিষ বা প্রোটিন নিঃসারক কোষ উৎপন্ন হয়। এসব সাপের ঊর্ধ্বচোয়ালের প্রতি পাশের ১৩টি দাঁত রূপান্তরিত ও সম্প্রসারিত বিষদাঁত হয়ে ওঠে। প্রতিটি বিষদাঁতের সম্মুখভাগ বা পাশে নালার মতো সোজা একটি খাদ থাকে, যা দিয়ে বিষগ্রন্থি থেকে আক্রান্ত প্রাণীর দেহে বিষ পৌঁছয়। বিষদাঁতগুলি সরাসরি Duvernoy’s গ্রন্থির সঙ্গে যুক্ত। কলুব্রিড বিষধর সাপের কামড় মানুষের জন্য তেমন মারাত্মক নয়। অবশ্য এ ধরনের কোন সাপ মানুষের আঙুল বা ত্বক কয়েকবার চিবালে তাতে যে পরিমাণ বিষ ঢোকে তা মারাত্মক হতে পারে। বাংলাদেশে এই জাতীয় সাপ হচ্ছে সুতানলি সাপ (Ahaetula species), ফণিমনসা (Boiga species), জলবোড়া (Cerberus rhynchops), কালনাগিনী, পানিসাপ (Enhydris species), সুন্দরী সাপ (Fordonia leucobalia), লাল ঢোঁড়াসাপ (Rhabdophis subminiata) ইত্যাদি।

সকল Elapidae ও Hydrophidae সাপের উপরের চোয়ালের সামনে একজোড়া বিষদাঁত থাকে। যথার্থ ও কার্যকর বিষগ্রন্থি চোখ ও উপরের চোয়ালের পিছনে অবস্থিত। প্রতিটি বিষদাঁতের একটি বিষ সরবরাহক নালি থাকে, যা দাঁতের খাদের দুই পাশের কিনারা যুক্ত হয়ে গঠিত। বিষদাঁতের আগার দিকে একটি রন্ধ্রমুখ থাকে, যা দিয়ে বিষ নির্গত হয়। Elapidae সাপের বিষ মূলত স্নায়ুবিষণক্ষম (neurotoxic) এবং দংশিত প্রাণী শ্বাসতন্ত্র বন্ধ বা হূৎপিন্ড অচল হয়ে মারা যায়। এই বিষ স্নায়ু থেকে পেশিতে উদ্দীপক চলাচলে বাঁধা দেওয়ার ফলে দেহ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়। স্নায়ুবিষ স্নায়ু ও পেশি সংযোজক স্নায়ুসন্ধির কর্মকান্ড বন্ধ করে দেয়। গোখরা (Naja species), কেউটে ও শঙ্খিনী (Bungarus species), রাজগোখরা/শঙ্খচূড় (Ophiophagus hannah) প্রভৃতি Elapid সাপ এবং Hydrophis, Lapemis, Laticauda, Microcephalophis, Pelamis গণের প্রজাতিগুলি বাংলাদেশের সাধারণ সামুদ্রিক সাপ। গোখরা ও কেউটে মানুষের বসতবাড়ির কাছাকাছি থাকে বিধায় মানুষের জন্য অধিক বিপজ্জনক। Viperid  সাপের মুখের সামনে একজোড়া বা দুইজোড়া বিষদাঁত থাকে এবং ব্যবহূত না হলে তারা সেগুলি ভাঁজ করে রাখে। এদেরও বিষদাঁতে নালি থাকায় এরা বিষদাঁতকে শিকারের উপরে সুইয়ের মতো ব্যবহার করে। Elapid ও Hydrophid সাপের বিষগ্রন্থির চেয়ে Viperid সাপের বিষগ্রন্থি আকারে বড়। ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া জাতীয় সাপ ও পিট-ভাইপার Viperidae গোত্রভুক্ত। এদের বিষ কোষকলায় ভাঙন ধরায় এবং লোহিত কণিকা ধ্বংস করে। এই জাতীয় সাপে কাটা মানুষ বা অন্য যেকোন প্রাণী অত্যধিক রক্তক্ষরণে মারা যায়।  [আলী রেজা খান]

আরও দেখুন অজগর; গোখরা; দাঁড়াশ সাপ; বেদে; শঙ্খিনী; সর্পদংশন; সামুদ্রিক সাপ; সাপুড়ে