সরকার, নলিনীরঞ্জন

সরকার, নলিনীরঞ্জন (১৮৮২-১৯৫৩)  ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৮৮২ সালে বর্তমান নেত্রকোনা জেলার এক মধ্যবিত্ত কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধনে তিনি ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯০২ সালে ঢাকার  পোগোজ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করার পর নলিনীরঞ্জন ঢাকার  জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি হলেও আর্থিক কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন নি।

খুব অল্প বয়স থেকেই নলিনীরঞ্জন উদার চিন্তা-চেতনার সাথে সংযুক্ত ছিলেন। জাতীয়তাবাদ ও অর্থনৈতিক মুক্তি এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে  সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, তেজবাহাদুর সপ্রু, মতিলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধী,  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও  চিত্তরঞ্জন দাশএর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ব্যাপক অবদান রেখেছে। তিনি ১৯০৫ সালের  বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে যোগ দেন। পরবর্তী বছরগুলিতে তিনি গান্ধীর অহিংস ধারণায় প্রভাবিত হন এবং ১৯২০ সালের  অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ব্যক্তিগতভাবে ব্রিটিশদের প্রতি তাঁর কোন ক্ষোভ না থাকলেও ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল ঘৃণা।

বিংশ শতকের বিশের দশকের প্রথম দিকে  চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহরু স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে নলিনীরঞ্জন তাতে যোগ দেন এবং খুব শীঘ্রই পার্টির একজন নেতায় পরিণত হন। একইসঙ্গে তিনি  বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯২৩ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য এবং ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় আইন পরিষদে স্বরাজ্য পার্টির চিফ হুইপ ছিলেন। তিনি ১৯২৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন উপলক্ষে আয়োজিত প্রদর্শনীর সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর ড. বিধানচন্দ্র রায়, নির্মলচন্দ্র চন্দর,  শরৎচন্দ্র বসু ও তুলসীচন্দ্র গোস্বামীসহ নলিনীরঞ্জন বাংলায় কংগ্রেস আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা রাখেন এবং বঙ্গীয় কংগ্রেস দলের ‘বিগ ফাইভ’ নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৩২ সালে তিনি কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের কাউন্সিলর এবং ১৯৩৫ সালে এর মেয়র নির্বাচিত হন।

১৯৩৬ সালে তিনি এ.কে ফজলুল হকের সঙ্গে একত্রে  কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করেন এবং ১৯৩৭ সালে প্রথম হক মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৩৮ সালে তিনি মন্ত্রিপদে ইস্তফা দিলেও পরবর্তীকালে পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভায় আবার যোগ দেন। ক্যাবিনেটের পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অসন্তুষ্ট নলিনীরঞ্জন ১৯৩৯ সালে আবারও মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৪১-৪২ সালে তিনি ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে সদস্য হিসেবে যোগ দেন এবং প্রথমবার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভূমি মন্ত্রণালয় এবং পরে বাণিজ্য, শিল্প ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৪৩ সালে গান্ধীর আটকাদেশের প্রতিবাদে তিনি ইস্তফা দেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৪৯ সালে তিনি সামান্য কয়েক মাসের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

বাণিজ্য ও শিল্পক্ষেত্রেও তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ১৯১১ সালে তিনি হিন্দুস্থান কো-অপারেটিভ ইন্সুরেন্স সোসাইটিতে যোগ দেন এবং খুব সাধারণ পদ থেকে জেনারেল ম্যানেজারের মতো উঁচু পদে উন্নীত হন। শেষ পর্যন্ত তিনি এর প্রেসিডেন্টের পদ অলংকৃত করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। একজন সফল শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী হিসেবে নলিনীরঞ্জন সরকার বঙ্গীয় জাতীয় বণিক ও শিল্প সমিতির প্রেসিডেন্ট পদ অলংকৃত করেন। তিনি কোম্পানি আইন সংশোধন উপদেষ্টা কমিটি, সেন্ট্রাল ব্যাংকিং ইনকোয়ারি কমিটি, বোর্ড অব ইনকাম ট্যাক্স রেফ্রিজ, রেলওয়ে রিট্রেঞ্চমেন্ট কমিটি, সেপারেশন কাউন্সিল অ্যান্ড বোর্ড অব ইকোনমিক ইনকোয়ারি, রিসার্চ ইউটিলাইজেশন কমিটি এবং সেন্ট্রাল জুট কমিটি-র সদস্য ছিলেন। ১৯২৩ সালে তিনি ইন্দো-জাপান বাণিজ্য সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন। নলিনীরঞ্জন কলকাতা বন্দরের কমিশনার ও ‘চিত্তরঞ্জন সেবা সদন’-এর ট্রাস্টি ছিলেন।

তিনি বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা কাউন্সিলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ভারতে শিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের ফেলো, ১৯৪০-৪১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্ট-এর সদস্য এবং ১৯৪২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের গভর্নিং বডি-র প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৪১-৪২ সালে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেন। নলিনীরঞ্জন সরকারের মুত্যু ১৯৫৩ সালে।  [রাজশেখর বসু]