ষন্ডা

ষন্ডা  উনিশ ও বিশ শতকের প্রথমদিকে পূর্ববাংলার জেলাসমূহে অপরাধমূলক কর্মকান্ডের জন্য কুখ্যাত একটি অপরাধপ্রবণ সম্প্রদায় বিশেষ। বর্তমানে অপরাধী হিসেবে এদের পরিচিতি শুধু লোককাহিনীতেই সীমিত। গ্রাম্যভাষায় ষন্ডা বলতে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের মাস্তানকে বোঝায়। অতীতে তারা বিশেষ করে পাবনা, রাজশাহী, বগুড়া, ফরিদপুর, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলায় অপরাধমূলক তৎপরতা চালাত। ষন্ডা নামটি ’সানা’ শব্দ থেকে আগত বলে মনে করা হয়। সানা অর্থ বুননতাঁতের মাকু এবং সানা উৎপাদনকারীদের বলা হতো সানাদার, যা থেকে কালক্রমে সান্দার, ষন্ডার এবং ষন্ডা শব্দের উদ্ভব হয়।

ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে দেশিয় তাঁতের উৎপাদন নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে অধিকাংশ সান্দারই কর্মহীন হয়ে পড়ে। তখন বাঁচার তাগিদে তারা গরু চুরি, সিঁদ কাটা ও নৌকা ডাকাতির মতো অপরাধমূলক কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা ডাকাতিতে বিশেষভাবে পারদর্শী হয়ে ওঠে। তাঁতি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ছিল মুসলমান। ষন্ডারা সাধারণভাবে ছিল মুসলমান। পুলিশের রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, একমাত্র শীতকালে এলাকায় যখন শ্রমিক হিসেবে উপার্জনের সুযোগ থাকত, তখন অধিকাংশ ষন্ডা স্থলে বাস করত। কিন্তু বর্ষাকালে যখন তাদের উপার্জনের সুবিধাদি দুর্লভ হয়ে পড়ত, তখন তারা নদীপথে ডাকাতি করে বেড়াত। প্রতিটি বহরে কয়েকটি পানসি ধরনের দ্রুতগামী নৌকাসহ ৩০ থেকে ৪০টি নৌকার বহর নিয়ে ষন্ডাগণ নদীপথে অপরাধ অভিযান পরিচালনা করত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকের পুলিশ রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, পূর্ববঙ্গের নদীসমূহের নৌডাকাতির দশ ভাগের নয় ভাগই ষন্ডাদের দ্বারা সংঘটিত হতো। মহিলা ষন্ডারা সিঁদ কেটে চুরি, ছিনতাই এবং মেলা-উৎসবে ছোটখাটো চুরি করায় সমানভাবে অভ্যস্ত ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে যাতায়াত ও শাসনব্যবস্থার উন্নতির কারণে ষন্ডাদের পক্ষে পুলিশ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়ানো উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে ওঠে। ফলে এই সম্প্রদায়ের অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পেতে শুরু করে এবং বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ষন্ডাদের অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।  [সিরাজুল ইসলাম]