শোর, স্যার জন

শোর, স্যার জন (১৭৫১-১৮৩৪)  ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল ও রাজস্ব বিশেষজ্ঞ। ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের গোড়াপত্তন কালে ১৭৬৮ সালে জন শোর কোম্পানির একজন শিক্ষানবিশ করণিক রূপে কলকাতায় আসেন। তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে কোম্পানির রাজনৈতিক গোপনীয় শাখায় কাজ করেন এবং এই সময়ই তিনি ফারসি ও বাংলা ভাষায় পারদর্শিতা লাভ করেন। ফারসি ও বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসার সূত্রে তিনি এক ভারতীয় নারীর পাণিগ্রহণ করেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনকালে (১৭৭২-১৭৮৫) জন শোর ছিলেন তাঁর প্রধান রাজস্ব উপদেষ্টা। বাংলার রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়াদি, বাংলার গণপ্রতিষ্ঠানাদি, প্রথা ও আচার অনুষ্ঠান সম্বন্ধে তাঁর প্রভূত জ্ঞান কোর্ট অব ডাইরেক্টর্সকে এতটা প্রভাবিত করে যে, ১৭৮৭ সালে তাঁরা তাঁকে গভর্নর জেনারেলের পরিষদের সদস্য নিয়োগ করেন। পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি রাজস্ব বোর্ডের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন।

১৭৮৬ এবং ১৭৯০ সালের রাজস্ব প্রশাসনে গৃহীত সংস্কার মূলত তাঁর মতের ওপর ভিত্তি করে শুরু ও সম্পন্ন করা হয়।  চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রশ্নে শোর কর্নওয়ালিসের প্রস্তাবিত নীতির সাথে মৌলিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি জমির উৎপাদন ক্ষমতা সম্বন্ধে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও তথ্য সংগ্রহ করার পূর্বে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রয়োগের বিরোধী ছিলেন। জন শোরের এই মতামত প্রথম তাঁর কাউন্সিলের বর্ননায় ১৭৮৫ সালে ‘Remarks on the Mode of Administering Justice to the Natives in Bengal and on the Collection of the Revenues’ শিরোনামে গ্রহন করা হয়। এই বর্ণনায় জন শোর সরকারের নির্ধারিত ব্যবস্থায় আপত্তি তোলেন, বিচার কার্যে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের কার্যাবলীর ধরনের সমালোচনা করেন ও সরকার কিভাবে কোম্পানির শাসনের সময় নির্ধারণের পক্ষে কাজ করবে ও এই পথে কিভাবে বাংলার জনগণের কল্যাণ সাধন হবে, তার জন্য উপদেশ প্রদান করেন। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়া উচিত কিন্তু তাদের উপর অর্পিত রাজস্ব অবশ্যই দেশের সম্পদের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধানের পরই নির্ধারন করা জরুরী। তাঁর পরামর্শ ছিলো যে, জমিদারদের উপর আরোপিত রাজস্ব পরিমিত হওয়া উচিত। দেশের ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ  জ্ঞাত না হয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো ব্যবস্থা করা উচিত হবে না বলে জন শোর  তাঁর মত প্রকাশ করেন। কিন্তু চার্লস কর্নওয়ালিস তাঁর সঙ্গে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে অনতিবিলম্বে তাঁর পক্ষে রায় দেয়ার জন্য নিজে দীর্ঘ পত্র লিখেন। জন শোর ও কর্নওয়ালিস উভয়ের বক্তব্য কোর্ট অব ডাইরেক্টরদের এর নিকট পাঠানো হয় তাদের মতামত জানার জন্য। রাজনৈতিক অত্যাবশ্যকতা ও লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রভাবের কারণে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে রায় প্রদান করে এবং ১৭৯৩ সালের মার্চে বন্দোবস্ত কার্যকরী হয়। তবে শোর তাঁর পুরস্কার পান। শোরের যুক্তি ও জ্ঞান এবং জনগণ ও কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণে তাঁর প্রকৃত আগ্রহে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স এতটা প্রভাবিত হন যে, কর্নওয়ালিসের বিদায়ের পর তাঁরা ১৭৯৩ সালে তাঁকে গভর্নর জেনারেল পদে নিয়োগ করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের তড়িৎ সিদ্ধান্ত বিপর্যয়ের সামিল ছিলো বলে প্রমানিত হয়। কারন অধিকাংশ জমিদদের উপর অতিরিক্ত রাজস্ব ধার্য করা হয়েছিলো এবং তাঁরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হলে তাঁদের আওতাভূক্ত জমিদারী বিক্রির মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। বন্দোবস্তের দশ বছরের মধ্যে বাংলার প্রায় অর্ধেক জমিদারীর সম্পত্তি ভূক্তভূগিদের মাঝে সূর্যাস্তের আইন নামে খ্যাত রাজস্ব বিক্রি আইনের অধীনে বিক্রি হয়ে যায়।

গভর্নর জেনারেল হিসেবে জন শোর দ্বন্দ্ব সংঘাত ও যুদ্ধ পরিহার করেন। তাঁর নীতি ছিল পরিহারযোগ্য বৈদেশিক অভিযান না চালিয়ে ঔপনিবেশিক রাজ্যগুলি সুদৃঢ় করা এবং তা সুচারুরূপে শাসন করা। তাঁর শাসনামলের পাঁচ বছর বাংলায় শান্তি বজায় ছিলো। যদিও  তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ আরও কিছু বিধিবিধানে কর্নওয়ালিস থেকে ভিন্নমত পোষণ করতেন, তথাপি তিনি গভর্নর জেনারেল হওয়ার পর কর্নওয়ালিসের নীতিমালাই যথাযথভাবে অনুসরণ করেছেন।

কোম্পানির অন্যান্য কর্মচারীরা যখন ব্যাপকভাবে অসাধুতা ও দুর্নীতিতে লিপ্ত, তখন পরিপূর্ণ সততার জন্য শোর খ্যাত ছিলেন। দস্যুবৃত্তি অবলম্বন করে রাতারাতি ধনী হওয়া কোম্পানির অনেক কর্মচারীর নীতিতে পরিণত হয়েছিলো। শোর ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তিনি প্রাচ্যের সংস্কৃতিকে ভালবাসতেন, আর একারণেই স্যার উইলিয়ম জোনস এর সাথে তিনি নিবিড় সম্পর্ক রাখতেন। স্যার উইলিয়ম জোনস ছিলেন প্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারক। শোর তাঁকে প্রাচ্য বিষয়ক সকল প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহায়তা দেন এবং ১৭৯৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পর জোনসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এশিয়াটিক সোসাইটিকে শক্তিশালীকরণে সহায়তা করেন। শোরের সভাপতিত্বেই এশিয়াটিক সোসাইটি রাজকীয় মঞ্জুরি লাভ করে এবং সোসাইটি ভবন নির্মাণের জন্য একখন্ড জমি বরাদ্দ পায়।

স্যার উইলিয়ম জোনসের কর্ম এবং জীবনের উপর লিখতে অনেকেই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শোরই প্রথম তাঁর জীবনী লেখেন। তাঁর রচিত মেমোয়ের্স অব স্যার উইলিয়ম জোনস (১৮০৪) এখনও সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। তিনি নিজেকে দার্শনিক ক্ল্যাপহ্যাম গোষ্ঠীর একজন সদস্য বলে গর্ব করতেন। ১৭৯২ সালে শোর ব্যারণেট সম্মান লাভ করেন। ১৭৯৮ সালে তাঁকে আইরিশ পিয়ার (লর্ড টিন মাউথ) করা হয়।  [সিরাজুল ইসলাম]