শিশু অধিকার

শিশু অধিকার  বাংলাদেশে শিশুদের অধিকার সংরক্ষণ ও তাদের কল্যাণ নিশ্চিতকরণের জন্য সাংবিধানিক বিধান ও অনেক আইন রয়েছে। বাংলাদেশের শিশু অধিকার প্রসঙ্গটির একটি আর্ন্তজাতিক প্রেক্ষাপট আছে। ১৯২৪ সালে লীগ অব নেশনস-এর ৫ম অধিবেশনে গৃহীত শিশু অধিকার ঘোষণায় শিশু অধিকারসমূহ প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক দলিলে স্থান পায়। ১৯৫৯ সালের শিশু অধিকার ঘোষণায় শিশুদের বহুবিধ সুবিধা, তাদের নিরাপত্তা ও অগ্রাধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। নতুন ঘোষণাপত্রের অধিকারসমূহ পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিনামায় পুনঃসমর্থিত এবং ১৯৬৬ সালে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ১৯৫৯ সালের ঘোষণার ৩০ বছর পর ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার কনভেনশন গৃহীত হয়। বাংলাদেশ এ কনভেনশনে স্বাক্ষর দিলেও এর অনুচ্ছেদ ২১ ও ১৪ (১) সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপন করে। দত্তক গ্রহণ বিষয়ক অনুচ্ছেদ ২১ সম্পর্কে আপত্তির কারণ হলো মুসলিম আইনে দত্তক গ্রহণ স্বীকৃত নয়। তা ছাড়া, স্বাধীনতা উত্তরকালে যুদ্ধশিশু উদ্ধারের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা থাকলেও বাংলাদেশ আন্তর্দেশীয় দত্তক গ্রহণে অনাগ্রহী। ধর্মীয় ও নৈতিক উভয়বিধ কারণেই এদেশের জনমত আন্তর্দেশীয় দত্তক গ্রহণের বিরুদ্ধে। অনেক ক্ষেত্রেই দত্তক গ্রহণের নামে শিশু বিক্রির ঘটনাও প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের দ্বিতীয় আপত্তির বিষয় ছিল শিশুদের চিন্তা, নৈতিকতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার সম্পর্কে। শিশুর এই স্বাধীনতা রাষ্ট্র স্বীকার করলেও বিদ্যমান সামাজিক বিশ্বাস হলো যে, আলোচ্য প্রশ্নের অন্তর্নিহিত জটিলতা বোঝার ক্ষেত্রে শিশুরা অপরিপক্ব ও অসমর্থ বিধায় তাদের নিজেদের পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ অসম্ভব। এমতাবস্থায় একটি শিশুর পক্ষে চাপ ও প্রভাবের বশবর্তী হওয়াই স্বাভাবিক, যার কোনটাই তার সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের অনুকূল নয়।

বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় নীতির  মৌলাদর্শ বর্ণনায় শিশু অধিকারের প্রাসঙ্গিক বিধান [অনুচ্ছেদ ১৫, ১৭ এবং ২৫ (১)], মৌলিক অধিকারসমূহ [অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮ (১) (২) (৩) (৪), ৩১, ৩২ এবং ৩৯ (১) (২)], এবং বিচার বিভাগীয় পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা [অনুচ্ছেদ ২৬ (১) (২)] রয়েছে। সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩১ অনুচ্ছেদে সব ধরনের বৈষম্য থেকে শিশুর নিরাপত্তা বিধানের সাধারণ নীতিমালার উলে­খ রয়েছে। সংবিধানের এসব অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান ও অভিন্ন নিরাপত্তা লাভের অধিকারী বিধায় পক্ষাপাতহীনভাবে তাদের আইনের সুযোগ লাভের অধিকার রয়েছে।

বাংলাদেশের শিশুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ সম্পর্কিত অন্যান্য আইন কোনো একক সংবিধিভুক্ত নয়, এগুলো নিম্নোক্ত বিভিন্ন আইন ও সংবিধিতে ছড়িয়ে আছে:

১. ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৮২ ও ৮৩ নং ধারায় বলা হয়েছে যে কেবল ১২ বৎসর বয়স উত্তীর্ণ হওয়ার পরই কারও উপর দন্ডনীয় অপরাধের দায় বর্তায়, এ বয়সের পূর্বে কেউ স্বীয় কাজের প্রকৃতি ও ফলাফল বোঝার মতো পরিপক্ব হয় না। ৯০নং ধারায় বলা হয়েছে যে, ১২ বছরের কমবয়সী কারও সম্মতি যথার্থ সম্মতি হিসেবে গ্রহণীয় নয়। কিন্তু বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রীর বয়স ১৩ বৎসরের বেশি হলে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ধর্ষণ হিসাবে গণ্য হবে না। বৈধ অভিভাবকের কাছ থেকে ১৪ বছরের কম বয়সের ছেলে ও ১৬ বছরের কম বয়সী মেয়েকে অপহরণ ৩৬১ নং ধারায় একটি অপরাধ। ১০ বছরের কম বয়সী যে কাউকে অপহরণও ৩৬৪-এ ধারায় একটি অপরাধ।
২. তালাক আইন, ১৮৬৯ যা বাংলাদেশের খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তাতে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের পিতা-মাতা বিচ্ছেদ, তালাক বা বিবাহরদ মামলায় জড়িয়ে পড়লে ওই শিশুদের অভিভাবকত্ব, রক্ষণাবেক্ষণ ও শিক্ষার বিধান উল্লেখ আছে।
৩. চুক্তি আইন, ১৮৭২ অনুযায়ী অপ্রাপ্তবয়স্করা চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অযোগ্য। আইনের ১১ নং ধারা মোতাবেক অপ্রাপ্তবয়স্কদের চুক্তি অকার্যকর। তবে, অপ্রাপ্তবয়স্কদের অভিভাবকরা আইনের প্রয়োজনে বা ভূসম্পত্তির স্বার্থে নাবালকের পক্ষে বিক্রয়চুক্তি সম্পাদন করতে পারে।
৪. অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ আদালতকে নাবালক তার সম্পত্তি বা উভয়ের জন্য অভিভাবক নিয়োগের অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে আদালতকে এ মর্মে নিশ্চিত হতে হবে যে, এ অভিভাবক নিয়োগ অপ্রাপ্তবয়স্কের মঙ্গলের জন্যই করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে অপ্রাপ্তবয়স্কের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে অভিভাবক নিয়োগ করা যাবে না।
৫. ফৌজদারি দন্ডবিধি, ১৮৯৮ অনুযায়ী কোন সমর্থ ব্যক্তি তার স্ত্রী বা সন্তানকে (বৈধ বা অবৈধ) অবহেলা করলে বা তাদের ভরণপোষণ দিতে অস্বীকার করলে মনোনীত আদালত তাদের ভরণ-পোষণের জন্য মাসিক ভাতা প্রদানে তাকে বাধ্য করতে পারে। দন্ডবিধির ৫৬২ নং ধারা অনুসারে আদালত কোন কোন ক্ষেত্রে প্রথমবার দন্ডিত ২১ বছরের কমবয়সী ব্যক্তিকে জেলে না পাঠিয়ে সদাচরণের শর্ত সাপেক্ষে অবেক্ষাধীন রাখতে পারে।
৬. খনি আইন, ১৯২৩ যেকোন খনিতে ১৫ বছরের কমবয়সীদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। এ আইনে ১৫ বছরের বেশি ও ১৭ বছরের কম বয়সীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বিধির উল্লেখ আছে।
৭. বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯ (সংশোধিত ১৯৮৪) ২১ বছরের কম বয়সী পুরুষ এবং ১৮ বছরের কমবয়সী মেয়ের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ করেছে এবং এতে বাল্যবিবাহের সঙ্গে জড়িত পিতা, মাতা বা অভিভাবকের শাস্তির বিধান রয়েছে।
৮. ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৩০ নং ধারা মতে অপ্রাপ্তবয়স্ক কেউ কোনো ফার্মের অংশীদার হতে পারে না, তবে সকল অংশীদারের সম্মতিক্রমে সে সাময়িকভাবে অংশীদারের সুবিধা ভোগ করতে পারে।
৯. অনৈতিক কার্যকলাপ দমন আইন, ১৯৩৩ অনুসারে ১৮ বছরের কমবয়স্ক কোনো মেয়েকে নারীকে বেশ্যাবৃত্তিতে বাধ্যকরণের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। বালিকার জিম্মাদার বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি কর্তৃক তার দায়িত্ব পরিহারও দন্ডনীয় অপরাধ। ১০ বছরের কমবয়সী মেয়ে বেশ্যাবৃত্তিতে লিপ্ত হলে সে স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হিসেবে বিবেচিত হবে এবং সেজন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে না।
১০. শিশু (শ্রমের অঙ্গীকার) আইন, ১৯৩৩ অনুসারে পিতা বা অভিভাবক শিশুর শ্রম প্রদানের চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে বা শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করতে প্রতিশ্রুত হলে তারা দন্ডিত হবে।
১১. শিশুর কর্মনিয়োগ আইন, ১৯৩৮ যেকোন ধরনের নির্দিষ্ট পেশায় এবং পরিবহন, রেলগাড়িতে যাত্রীদের মালামাল বহন অথবা বন্দর এলাকায় পণ্যসামগ্রী বিক্রি ইত্যাদি কাজে শিশুদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। এ আইন লঙ্ঘন করলে নিয়োগকারী শাস্তি পাবে।
১২. মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ অনুসারে অপ্রাপ্তবয়স্ক বিবাহিত মেয়ে ১৮ বছর পূর্তির আগে বিবাহ প্রত্যাখ্যান করতে পারবে। অবশ্যি যৌনমিলন দ্বারা বিবাহ সিদ্ধ হয়ে গেলে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না।
১৩. মাতৃত্ব কল্যাণ আইন, ১৯৩৯ নিয়োগকর্তাকে মহিলা শ্রমিকদের মাতৃত্বজনিত সুবিধাদি প্রদানের এবং সন্তান প্রসবের আগে ও পরে কিছুকাল তাদের শ্রম লাঘব করার নির্দেশ দিয়েছে।
১৪. ভবঘুরে আইন ১৯৪৩ বেকার, গৃহহীন ও ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা জীবিকানির্বাহকারীদের গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করার দায়িত্বপ্রাপ্তদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। এ আইনে ১৪ বছরের কমবয়সীরা শিশু হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে।
১৫. মাতৃত্ব কল্যাণ (চা-বাগান) আইন, ১৯৫০ সন্তান প্রসবের কিছু সময় আগে ও পরে মহিলা শ্রমিকদের চা বাগানে অথবা চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় কাজ করা নিষিদ্ধ করেছে এবং এ সময়ে মাতৃত্বকালীন সুবিধাদি প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে।
১৬. নিম্নতম মজুরি অধ্যাদেশ, ১৯৬১ কিশোর বয়সীসহ সকল শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করেছে এবং তাদের (১৮ বছরের কম বয়স্কদের) এ আইনে প্রতিষ্ঠিত বোর্ড কর্তৃক স্থিরীকৃত ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম মজুরি প্রদান নিষিদ্ধ করেছে। এক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘন দন্ডনীয় অপরাধ।
১৭.  দোকান ও প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৬৫ দোকানে ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ১২ বছরের কম বয়সীদের চাকরি নিষিদ্ধ করেছে। এ আইন ১৮ বছরের কমবয়সীদের কর্মসময়ও নিয়ন্ত্রণ করে।
১৮.  কারখানা আইন ১৯৬৫ ঝুকিপূর্ণ পেশায় ১৪ বছরের কমবয়সীদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছে এবং শিশু ও কিশোরদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রেখেছে। এ আইন কারখানায় কর্মরত মহিলাদের ৬ বছরের কমবয়সী সন্তানদের জন্য শিশুসদনের সুবিধাদিও নিশ্চিত করেছে।
১৯. শিশু আইন, ১৯৭৪ এবং শিশু বিধি, ১৯৭৬ সব ধরনের আইনগত কার্যক্রম চলাকালে শিশুদের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রণীত হয়েছে। এসব আইনে কোন আদেশ দেওয়ার আগে আদালতকে শিশুর বয়স, চরিত্র ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয় বিবেচনায় নিতে বলা হয়েছে। এ আইনে কিশোরদের জন্য আলাদা আদালতের ব্যবস্থা রয়েছে এবং একজন বয়স্ক ব্যক্তি ও শিশু একত্রে কোন অপরাধ ঘটালে সেক্ষেত্রেও যৌথ-বিচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ আইনে পিতামাতা/অভিভাবকের অবহেলা ও দুর্ব্যহারের শিকারসহ দুঃস্থ, নিগৃহীত ও অবহেলিত শিশুদের সুরক্ষার বিধান রাখা হয়েছে।
২০. নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধি) আইন, ১৯৯৫ অনুসারে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিভিন্ন অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ডসহ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এজাতীয় অপরাধ হলো ধর্ষণ, পাচার, অপহরণ, যৌতুকের জন্য খুন ইত্যাদি।
২১. উপর্যুক্ত আনুষ্ঠানিক আইন ছাড়াও বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, রক্ষণাবেক্ষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক ও শিশুদের উত্তরাধিকার নিয়ন্ত্রক ব্যক্তি-আইন ও ধর্মীয় আইনে শিশুদের জন্য সুনির্দিষ্ট নানা ব্যবস্থা রয়েছে। এক্ষেত্রে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এবং পারিবারিক আদালত আইন, ১৯৬৪ শিশু ও নারীর অধিকার সম্প্রসারিত করে।

শিশু অধিকার কনভেনশনের অভিপ্রেত বৈষম্যহীনতার নীতি বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকারসমূহের অন্তর্ভুক্ত হলেও সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের বিস্তৃত পরিমন্ডলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যে তাতে প্রায়শই বৈষম্য এড়ান যায় না। শিশুরা দু’ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়, একটি বয়সভিত্তিক আর অন্যটি লিঙ্গভিত্তিক।  [সুমাইয়া খায়ের]