শিল্পায়ন

শিল্পায়ন  প্রাচীন কাল থেকেই বাংলা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কারুশিল্পের জন্য খ্যাত। পাঁচ শতকে বাংলার সর্ববৃহৎ বন্দরনগরী তাম্রলিপ্তির সাথে দক্ষিণ ভারত, সিংহল (শ্রীলঙ্কা), বার্মা (মায়ানমার), মালয় (মালয়েশিয়া), পারস্য উপসাগর এবং দূরপ্রাচ্যের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। এই সময়ে প্রধান প্রধান উন্নত শিল্পসমূহের মধ্যে ছিল বস্ত্রশিল্প, চিনি শিল্প, লবণ শিল্প, গজদন্ত শিল্প এবং ধাতু শিল্প। আট শতকে আরব দেশীয় বণিকগণ চট্টগ্রামের সাথে বহির্বিশ্বের বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খ্রিস্টবর্ষ শুরুর অনেক আগে থেকেই বাংলায় নৌকানির্মাণ শিল্প উন্নতি লাভ করে। ঢাকার মসলিন খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫ থেকেই বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করে। এমনকি ৫০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেও বস্ত্র, চিনি, লবণ ও অলঙ্কার রপ্তানিতে বাংলার রেকর্ড ছিল। ৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে হস্তশিল্পও সমৃদ্ধি লাভ করে। অবশ্য উৎপাদনকারীদের কার্যক্রম কয়েক প্রকারের দ্রব্য উৎপাদনের মধ্যেই দীর্ঘদিন সীমাবদ্ধ ছিল এবং সতেরো শতক পর্যন্ত এর বিকাশ হয়েছে ধীর গতিতে।

মুগল আমলে  বাংলায় উৎপাদন ক্ষেত্রে তেজি ভাব আসে এ সময়ে। এর কারণ এদেশে ইউরোপীয় কোম্পানিসমূহের আগমন। রপ্তানি বাজারে বিদেশীদের অংশগ্রহণ শিল্প উন্নয়নে নতুন প্রেরণা যোগায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুদ্রার প্রসার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় এবং মূলধন গঠন প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়। ফলে নতুন নতুন বাজার ও উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপিত হয়। উৎপাদন ও বাজারের প্রসার ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও বীমা খাতে বাণিজ্যিক কাগজপত্রের ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলে। মুগল শাসিত বাংলায় দেশীয় শিল্প উন্নয়নে চরকাকার, তাঁতি, সূত্রধর এবং কুম্ভকার নামের প্রধান প্রধান কারিগর শ্রেণির অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। সতেরো শতক থেকে উৎপাদিত সূক্ষ্ম বস্ত্র ছিল লাভজনক রপ্তানিযোগ্য দ্রব্যাদির অন্যতম। বাজার সম্প্রসারণের সাথে সাথে চিনি উৎপাদন জোরদার করা হয়। সতেরো শতকে নোনা পানি থেকে লবণ উৎপাদনে ব্যাপক উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়। এই সময়ের মধ্যে বাংলায় অন্যান্য যে সকল দ্রব্য উৎপাদনের প্রসার ঘটেছিল তার মধ্যে কৃষি যন্ত্রপাতি, ধাতুনির্মিত দ্রব্যাদি ও অস্ত্রপাতি, তামার ছাঁচ, গজদন্ত ভাস্কর্য, কাঠের কারুকাজ, সূচিশিল্প, অলঙ্কার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

ব্রিটিশ আমল  ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে বাংলায় বস্ত্রশিল্প ছিল সম্পূর্ণ কুটিরশিল্প নির্ভর। বস্ত্র উৎপাদন ও বস্ত্র ব্যবসার অর্থায়নে মহাজনগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্ত্তৃক দাদনি প্রথার মাধ্যমে ও এজেন্সি পদ্ধতিতে তাঁতিদের ঋণ দেওয়া হতো। দাদনি প্রথা কালক্রমে কারিগর শ্রেণির জন্য প্রতিকূল, এমনকি অত্যাচারমূলক হয়ে ওঠে। এর ফলে বহু তাঁতি প্রবলভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পেশা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১৭৭৬ সালে শুধুমাত্র ঢাকা জেলায় বস্ত্রশিল্পে ১৪৬৭৫১ জন তাঁতি এবং বাকীরা সুতাকাটায় নিযুক্ত শ্রমিকঅ আরও অনেক অঞ্চলে বৃটিশ শাসনামলের শুরুতে বস্ত্রশিল্পে সমৃদ্ধ ছিল। এর মধ্যে রাজশাহীর মালদহ হরিপল ও শ্রীপুর, ময়মনসিংহের বালিকুশি ও কাগমারি, মিদনাপুরের বর্ধমান, ক্ষীরপয় ও রাধানগর এবং নদীয়ার শান্তিপুর ও বারণ। এসব শিল্প উপনিবেশিক আমলে ধ্বংস হয়। এর কারণ একদিকে বৃটিশ সরকার কর্তৃক ব্রিটেনের বাজারে প্রেরিত কাপড়ের উপর শুল্ক ও শুল্ক বাধা, অপরদিকে শিল্প বিপ্লবে বিকাশমান বস্ত্রশিল্প। অবশ্য বৃটিশ আমলেই সরকারের বাণিজ্যিক নীতিমালার অধীনে বহিঃবিশ্বের সাথে বাংলার বস্ত্রশিল্পের বাণিজ্য চলতে থাকে এবং বিদেশি বণিকদের বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়া হয়।

ভারতের রেশম শিল্প প্রধানত বাংলায় কেন্দ্রীভূত ছিল এবং ব্রিটিশদের শাসন আরম্ভের প্রথম থেকেই এই শিল্প তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রেশম কারখানা স্থাপন এবং রেশমগুটি চাষের উন্নয়ন করে। কোম্পানি বিদেশে রেশম রপ্তানি ব্যবস্থাকে সংগঠিত ও রপ্তানি করে। রেশমগুটি চাষ ও রেশম উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র ছিল মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদের অংশবিশেষ এখন রাজশাহীর অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য মধ্য ঊনিশ শতকে চীন ও জাপানে উৎপাদিত সস্তা রেশমের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে এবং ব্রিটেনে উৎপাদিত বিকল্প বস্ত্রের দ্রুত মূল্য হ্রাসের জন্য বাংলার রেশম শিল্পের প্রসার ব্যাহত হয়।

একটি ডক নির্মাণ এবং বাণিজ্যপোত, যুদ্ধজাহাজ মেরামত ও সজ্জিত করার জন্য সুবিধাদি সৃষ্টি করার মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় জাহাজনির্মাণ শিল্পের উন্নয়ন সাধন করে। বৃহদাকার নৌকা নির্মাণে দক্ষতাসম্পন্ন এবং জাহাজনির্মাণে পুনঃপ্রশিক্ষিত স্থানীয় শ্রমিকদের সাহায্যে ব্রিটিশ ও স্থানীয় উভয় শ্রেণির কোম্পানি জাহাজ নির্মাণ, মেরামত ও সজ্জিত করার কাজে এই সুবিধাসমূহ ব্যবহার করে।

ব্রিটিশ আমলে যে সকল বৃহদাকার শিল্পের উন্নয়ন করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল লবণ ও চিনি শিল্প। লবণ ব্যবসায়ের ওপর ট্যাক্স আকারে রাজস্ব আদায় করে কোম্পানি সরকার প্রচুর অর্থ আয় করে। এই লবণ ব্যবসায়ের দুটো পরিণতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল: এক, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লবণ উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং দুই, বর্ধিত ট্যাক্সের জন্য লবণের ঊর্ধ্বগামী মূল্য সাধারণ ও গরিব ভোক্তাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে ব্রিটিশ সরকার স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত লবণের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমদানিকৃত লবণের জন্য আমদানি কর ধার্য করে। এছাড়াও আমদানিকৃত লবণের মান উন্নততর বলে আমদানিকৃত লবণের জন্য  দেশীয় লবণশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আঠারো শতকে ভারতে চিনি উৎপাদন প্রধানত বেনারসে কেন্দ্রীভূত ছিল। এই শতকের শেষের দিকে বাংলা চিনিশিল্পে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ইংল্যান্ডে চিনির ঊর্ধ্বমূল্য এবং হাইতি ও সেন্ট ডমিঙ্গোতে চিনি উৎপাদনকারী কৃষ্ণকায় সম্প্রদায়ের ধ্বংসের সুযোগ গ্রহণ করে ব্রিটিশ শাসকবর্গ বাংলার চিনি ব্রিটেন ও পৃথিবীর অন্যান্য অংশে রপ্তানি করতে থাকে। ১৮৩০ সাল নাগাদ গোরখপুর, আজিজপুর, মতিহারী, বেলসুন্দা, বড়চাকিয়া, রোসা ও দুবাহ সহ অনেক স্থানে বাষ্পচালিত আধুনিক চিনি কল স্থাপন করা হয়। কিন্তু ১৮৪৬ সাল থেকে বাংলা ব্রিটেনে চিনির বাজার হারায়। তখন থেকে ব্রিটিশ সরকার শুল্কবিধির সমতার অধীনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে থেকে আমদানিকৃত চিনির শুল্ক ধার্য করার জন্য শুল্কবিধি পরিবর্তন করে। ইউরোপে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বিট চিনি উৎপাদনের উন্নয়ন বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে চিনি রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দেয়। জাভা, মরিসাস ও ফরমোজায় ইক্ষু ও চিনি উৎপাদনের প্রযুক্তি উন্নয়নের ফলে চিনির আন্তর্জাতিক মূল্য ভারতে উৎপাদিত চিনির উৎপাদন মূল্যের নিচে নেমে আসে। এইসব ঘটনার ফলে বাংলার চিনিশিল্পে ধস নামে। তবে, ইক্ষু, খেজুর এবং তাল বৃক্ষ থেকে গুড় উৎপাদনে বাংলা বেশ ভাল ভূমিকা পালন করে। সস্তা ও পুষ্টিকর খাদ্যের উপকরণ হিসেবে গুড়ের বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। আন্তর্জাতিক চিনির বাজারে সব ধরনের উন্নয়ন সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যাপক চাহিদার জন্য চিনি শিল্প বাংলায় টিকে থাকে।

ব্রিটিশ আমলে বাংলার শিল্পের, বিশেষ করে কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে, একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সীমিত শিল্পখাতে সঙ্কীর্ণ বিশেষায়ণ। বহু শতক ধরে ভারতে প্রচলিত বর্ণভিত্তিক কারুকর্মীদের বিশেষায়ন ব্রিটিশ আমলেও সমৃদ্ধি অর্জন করে। অনেক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এইসব কুটির শিল্পের উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখেন। কিন্তু অন্য অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় কারিগরদের দৈহিক নিপীড়নসহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয় এবং  জোর করে তাদের ব্যবসায় থেকে বিতাড়ন করে আমদানিকৃত দ্রব্যাদির জন্য স্থান করে দেওয়া হয়।

পাকিস্তান আমল  ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান অবিভক্ত বাংলার শিল্পের সামান্যই উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করে। বাংলার ১০৮টি পাটকল, ১৮টি লৌহ ও ইস্পাত কল এবং ১৬টি কাগজ কলের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশে একটিও পড়ে নি। বাংলার ৩৮৯টি সুতাকলের মধ্যে মাত্র ৯০টি, ১৬৬টি চিনিকলের মধ্যে মাত্র ১০টি এবং ১৯টি সিমেন্ট কারখানার মধ্যে মাত্র ৩টি পূর্ব পাকিস্তান ভূখন্ডে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের সিলেটের ছাতকে অবস্থিত সিমেন্ট কারখানাকে চুনাপাথর সরবরাহের জন্য ভারতের আসামের ওপর নির্ভর করতে হতো। পূর্ব পাকিস্তানের সুতাকলগুলিকেও আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর নির্ভর করতে হতো। ১৯৫১ সালের আদমশুমারি থেকে জানা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানে অদক্ষ অকৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৬৩,২৩৪ জন, উৎপাদনকারী শিল্পসংস্থায় নিয়োজিত দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১,১৫,৪৮০ জন,  কয়লা ও পাথর খনিতে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১,৮৪,৫৩৫ জন এবং পেশাদার লোক ছিল ১,২১.৫২২ জন। উৎপাদন সেক্টরে (প্রধানত খাদ্য, পানীয় ও তামাক প্রক্রিয়াকরণ শাখাসমূহ নিয়ে গঠিত) সর্বমোট ৬০২,৮৭৫ জন শ্রমিক (মোট শ্রমিক শক্তির ৪.৬৭%) নিয়োজিত ছিল। এদের মধ্যে ৪,৩০,১৪৮ জন প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত ছিল এবং ১,৭২,৭২৭ জন সহায়ক কাজে নিয়োজিত ছিল। মোট ৩,৬০,৬০৩টি কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠানে ৯,৪৯,০৭৪ জন লোক নিয়োজিত ছিল। উৎপাদনশীল শিল্প ইউনিটসমূহের মধ্যে মাত্র ২০০টিতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হতো।

পাকিস্তান সরকারের শিল্প উন্নয়ন নীতিমালায় অস্ত্র ও গোলাবারুদ, পানিবিদ্যুৎ শক্তি, রেলওয়ে ওয়াগন, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ও ওয়ারলেস উৎপাদন রাষ্ট্রের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয় এবং অবশিষ্ট সকল সেক্টরে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের শিল্প স্থাপনে উৎসাহ প্রদান করা হয়। পাট, বস্ত্র, রেশম ও রেয়নসহ চবিবশটি শিল্প ছিল কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাধীন। শিল্পায়নের উন্নয়নের জন্য সরকার পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন এবং পাকিস্তান শিল্প অর্থসংস্থান করপোরেশন নামে দুটি সংস্থা সৃষ্টি করে। পাট, পেপার বোর্ড, সিমেন্ট, সার, চিনি, রাসায়নিক দ্রব্যাদি, বস্ত্র, ঔষধ, হাল্কা প্রকৌশল ও জাহাজনির্মাণ প্রভৃতি খাতে শিল্প ইউনিট স্থাপনে পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অবশ্য, কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নে পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করে। এই উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার করা হয়। তাছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার বহিঃসম্পদের অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নের জন্য ব্যয় করে। পূর্ব পাকিস্তানে নতুন শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়ে যারা এগিয়ে এসেছিলেন তাদের তালিকায় বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল না এবং স্বাধীন পরিবেশ-পরিস্থিতির অভাবে স্থানীয় পুঁজি বিকাশের সুযোগ ছিল খুবই সামান্য। কেন্দ্রীয় সরকার উৎপন্ন দ্রব্যের নিয়ন্ত্রিত মূল্য এমনভাবে নির্ধারণ করতেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে জন্মানো বা উৎপাদিত দ্রব্যাদি স্থানীয় বাজারে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে অধিক মূল্যে বিক্রয় হতো। এসব সত্ত্বেও ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পায়নে কিছুটা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন খাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল খাদ্য উৎপাদনকারী ৪০৮টি, পানীয় প্রস্ত্ততকারী ৬টি, তামাক প্রক্রিয়াকরণ ২৬টি, বস্ত্র ৭৯২টি, পাদুকা ২০৪টি, কাঠ ও ছিপি ১৪টি, আসবাবপত্র ৭০টি, কাগজজাত দ্রব্য উৎপাদন ৩৩টি, মুদ্রণ ও প্রকাশনা ১৪টি, রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন ৫৭২টি, পেট্রোলিয়াম ও কয়লাজাত পদার্থ ৩টি,  রাবারজাত দ্রব্য উৎপাদন ৩টি, খনিজ পদার্থ ৫৩টি, মৌলিক ধাতু ৩৫টি, ধাতব দ্রব্য ২৫৭টি, অবৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ৮৮টি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ৩৪টি, যোগাযোগ যন্ত্রপাতি ৬৫টি এবং অন্যান্য দ্রব্য ১৬৬টি। অবশ্য সরকারি সূত্রমতে, ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ১,৫৮০টি উৎপাদন ইউনিটে  ২,০৬,০৫৮ জন লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। তাদের মোট উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য ছিল ৩,৬৩৬ বিলিয়ন টাকা এবং মূল্য সংযোজিত হয়েছিল ১,৭০৮ বিলিয়ন টাকা। ১৯৭০ সালে মোট জাতীয় আয়ে শিল্পখাতের অংশ ছিল ৮.৯%। কিন্তু  ১৯৫০ সালে এই অংশ ছিল ৩.৯%।

বাংলাদেশ আমল  ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে শিল্পখাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পসমূহের পুনর্সহাপন ও পুনর্বাসনের ব্যয় হিসাব করা হয়েছিল ২৯১ মিলিয়ন টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শিল্পসমূহের জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ২২৩ মিলিয়ন টাকা। ৭২টি পাটকল (৭৯,২০০ টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন), ৪৪টি বস্ত্রকল (১৩.৪ মিলিয়ন পাউন্ড), ১৫টি চিনি কল (১,৬৯,০০০ টন), ২টি সার কারখানা (৪,৪৬,০০০ টন), একটি ইস্পাত কল (৩,৫০,০০০ টন), একটি ডিজেল ইঞ্জিন ইউনিট (৩,০০০) এবং একটি জাহাজনির্মাণ কারখানা নিয়ে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পখাতের কার্যক্রম আরম্ভ হয়। অবশ্য রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের কলকারখানাগুলি প্রধানত অব্যবস্থা ও সম্পদ পাচারের ফলে শীঘ্রই লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সরকারকে অতি তাড়াতাড়ি রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ওপর কর্তৃত্বসংক্রান্ত নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হয় এবং শিল্পসমূহের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রেখেও ব্যক্তিগত বিনিয়োগের অনুমোদনযোগ্য সর্বোচ্চ সীমা বৃদ্ধি করা হয়। এতে অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয় নি। রাষ্ট্রীয় নীতিতে বহু সমন্বয় ও সাময়িক পরিবর্তন আনয়ন করে সরকার অবশেষে ১৯৮২ সালে একটি নতুন শিল্পনীতি প্রণয়ন করে। এই নীতি অনুসরণে ১,০৭৬টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়। নব্য সম্পদশালীদের অনভিজ্ঞতার কারণে হস্তান্তরিত শিল্পসমূহ রুগ্ন হয়ে পড়লে বিরাষ্ট্রীয়করণ নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে। ব্যক্তিমালিকদের অনেকেই শিল্প উন্নয়ন ও চালু রাখার পরিবর্তে সস্তায় প্রাপ্ত সম্পত্তি বিক্রয় করে নগদ অর্থ অর্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে শিল্পরুগ্নতা দেখা দেয় এবং খাদ্য উৎপাদনকারী শিল্পসমূহের ৫০%, বস্ত্র শিল্পসমূহের ৭০%, পাট খাতের শিল্পসমূহের ১০০%, কাগজ ও কাগজ বোর্ড শিল্পসমূহের ৬০%, চামড়া ও রাবার শিল্পসমূহের ৯০%, রসায়ন ও ঔষধ শিল্পসমূহের ৫০%, গ্লাস ও সিরামিক্স শিল্পের ৬৫% এবং প্রকৌশল শিল্পসমূহের ৮০% ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশে সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ১৯৮৪ সালে এই শ্রেণির শিল্পের সংখ্যা ছিল ৯,৩২,২০০টি। এর মধ্যে ২০.৭% ছিল তাঁত, ১৫.৪% বাঁশ ও বেতের কাজের কারখানা, ৮.১% কাঠমিস্ত্রির কাজের কারখানা, ৬.১% পাট ও তুলার সুতায় তৈরি দ্রব্য উৎপাদনের কারখানা,  ৩.৪% মৃৎশিল্প, ০.৩% তেলভাঙ্গা কল, ৩.২% কামারের কারখানা, ০.৮% তামা ঢালাই কারখানা এবং অবশিষ্ট অন্যান্য ধরনের শিল্প। বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায়ই তাঁতিদের বসতি আছে, কিন্তু নরসিংদী, বাবুরহাট, হোমনা, বাঞ্ছারামপুর, বাজিতপুর, টাঙ্গাইল, শাহাজাদপুর এবং যশোর এলাকায় তাদের অধিক সংখ্যায় কেন্দ্রীভূত রূপে দেখা যায়। রেশম শিল্প রাজশাহী ও ভোলাহাটে প্রসার লাভ করেছে। বাংলাদেশে ১৯৮০-র দশকে অন্যান্য যে সকল স্থান কুটির শিল্পের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিল সেগুলির মধ্যে রয়েছে চাঁপাই নবাবগঞ্জ ও ইসলামপুর (তামা ঢালাই), সিলেট (মাদুর ও বেতের আসবাবপত্র), কুমিল্লা (মৃৎশিল্প ও বাঁশের কাজ), কক্সবাজার (সিগার), বরিশাল (নারিকেলের ছোবড়া থেকে উৎপাদিত দ্রব্য) এবং রংপুর (নকশাযুক্ত কার্পেট)।

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ৬,০০০ তাঁত এবং ১,০২৫,০০০ টাকুবিশিষ্ট ৫৮টি বস্ত্রকল ছিল। এই বস্ত্রকলগুলির বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১০৬.২ মিলিয়ন পাউন্ড সুতা, ৬৩ মিলিয়ন মিটার কাপড়। বস্ত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত খাতের অন্যতম শিল্প এবং অন্যান্য অধিকাংশ শিল্পখাতের মতোই বস্ত্রখাতকে লোকসানের বোঝা বহন করতে হয়েছে। ১৯৮৪ সালে এই লোকসানের পরিমাণ ছিল ৩৫৩.৪ মিলিয়ন টাকা। এই খাতের অসুবিধাসমূহের মধ্যে রয়েছে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টির অসুবিধা, কাঁচামাল ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অপর্যাপ্ততা। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ২৩,৭০০টি টাকুবিশিষ্ট ৭০টি পাটকল ছিল। ওই বছর এই পাটকলসমূহে ১,৬৮,০০০ জন শ্রমিক এবং ২৭,০০০ জন অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছিল। এই মিলসমূহে ওই বছর ৫৪৫০০০ টন কাঁচাপাট ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আলোচ্য বছরে এই সকল পাটকলের উৎপাদন ১৯৬৯ সালের ২১,৫০৮টি টাকুবিশিষ্ট ৫৫টি পাটকলের ৫৬১০০০ টন উৎপাদন অপেক্ষা কম ছিল। বাংলাদেশের পাট শিল্পের প্রধান তিনটি কেন্দ্র ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় অবস্থিত। পাটজাত দ্রব্যের পরিবর্তে এখন সস্তা ও অধিক টেকসই প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহূত হচ্ছে। ভারতের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আন্তর্জাতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের পাট শিল্প ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

১৯৮৫ সালের পূর্বে বাংলাদেশে সালফিউরিক এসিড, রাসায়নিক দ্রব্য, কাগজ, কস্টিক সোডা, গ্লাস, সার, চীনামাটি দ্বারা প্রস্ত্তত বাসনকোসন, সিমেন্ট, ইস্পাত এবং প্রকৌশলের মতো নতুন শিল্পের উন্নয়ন ছিল মন্থর। ১৯৮৫ সালে সালফিউরিক এসিড উৎপাদনের জন্য দেশে মাত্র দুটি কারখানা ছিল এবং তাদের মোট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫,৯৯৫ মেট্রিক টন, যদিও সাবান, কাগজ, ঢালাই লোহা ও ইস্পাতের মতো শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ এই উপকরণটির উৎপাদন ১৯৭০ সালে ছিল ৬,৪৬৬ মেট্রিক টন। ১৯৮৫ সালে কস্টিক সোডার উৎপাদন ছিল ৬,৭৮৭ মেট্রিক টন, এর প্রায় সবটাই কাগজকলসমূহে ব্যবহার করা হতো। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বালু, লবণ ও চুনাপাথর সহজলভ্য হওয়ায় দেশে কাচ শিল্প উন্নয়নের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। এই শিল্প স্থাপনের জন্য দুটি প্রধান স্থান হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত স্বয়ংক্রিয় গ্লাস ফ্যাক্টরিতে ১৯৮৫ সালে ১২.৯ মিলিয়ন বর্গফুট শিট গ্লাস উৎপাদন করা হয়।

দেশের সার শিল্পে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হয়। ১৯৮৫ সালে সার কারখানাসমূহের মোট উৎপাদন ছিল ৮,০৮,৬৬০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৭,৪১,৪৬৩ মেট্রিক টন ছিল ইউরিয়া, ৯,৬৩৪ মেট্রিক টন অ্যামোনিয়াম সালফেট, এবং ৫৭,৫৬৩ মেট্রিক টন ট্রিপল সুপার ফসফেট। ফেঞ্চুগঞ্জ, ঘোড়াশাল ও আশুগঞ্জে তিনটি প্রধান সার কারখানা অবস্থিত ছিল। ১৯৮৫ সালে দেশের মোট সিমেন্ট উৎপাদন ছিল ২,৯২,০০০ মেট্রিক টন এবং দেশের প্রধান সিমেন্ট কারখানাদ্বয় ছাতক ও চট্টগ্রামে অবস্থিত। পাবনার পাকশী এবং চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায় রয়েছে বাংলাদেশের কাগজ শিল্পের প্রধান কারখানা এবং ১৯৮৫ সালে কাগজের মোট উৎপাদন ছিল প্রায় ৭৫,০০০ মেট্রিক টন। খুলনায় আছে একটি নিউজপ্রিন্ট মিল (১৯৮৫ সালে উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৫৫,০০০ মেট্রিক টন) এবং একটি হার্ড বোর্ড মিল (১৯৮৫ সালে উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১,৬২১ বর্গমিটার)। ১৯৮৫ সালেই বাংলাদেশে পার্টিকেল বোর্ড ও পারটেক্স উৎপাদনের জন্য কয়েকটি মিল ছিল। ম্যাচ উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। ঢাকা, খুলনা, খেপুপাড়া, চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া ও রাজশাহী ম্যাচ উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র। ১৯৮৫ সালে ম্যাচের মোট উৎপাদন ছিল ১.৩০ মিলিয়ন গ্রোস বাক্স। একই বছরে বাংলাদেশের ৮টি চিনিকলের উৎপাদন ছিল ৮৭,০০০ টন। দর্শনার (ঈশ্বরদী) চিনিকলে চিনি ছাড়া আরও উৎপন্ন হয় অ্যালকোহল, মেথিলেটেড স্পিরিট এবং রেক্টিফাইড স্পিরিট। বাংলাদেশের লৌহ ও ইস্পাত মিলগুলির অধিকাংশই ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের অধীনে চট্টগ্রাম ও ঢাকাতে কেন্দ্রীভূত। অবশ্য খুলনা, কুষ্টিয়া ও বগুড়াতেও কিছু ইস্পাত ও লোহার কাজের প্রতিষ্ঠান আছে।

১৯৮০-র দশকে বাংলাদেশে জাহাজনির্মাণ শিল্প, মোটরগাড়ি সন্নিবেশ শিল্প, তৈল শোধনাগার, ইনসুলেটর ও চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরির কারখানা, টেলিফোন যন্ত্রপাতি তৈরির শিল্প, বৈদ্যুতিক দ্রব্যাদি তৈরির কারখানা, টেলিভিশন সন্নিবেশ কারখানা, সিগারেট কোম্পানি এবং উদ্ভিজ্জ তেল কল বিশেষ স্থান অধিকার করে। এই সময় দেশে তৈরি পোশাক শিল্প ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করে। সরকার পরিকল্পিত উন্নয়নের সাথে মুক্তবাজার অর্থনীতির মিশ্র কৌশল অনুসরণ করে। ১৯৯০-এর দশকে উৎপাদন খাতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায় এবং ১৯৯৬ সালে দেশের মোট জাতীয় আয়ে এই শিল্পখাতের অংশ ১১%-এ উন্নীত হয়। এই খাতে ১৯৯৭ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৫৭.৮ বিলিয়ন টাকা এবং ১৯৯১ সালে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২২.৫ বিলিয়ন টাকা। দেশের শিল্পসমূহের মোট  বিনিয়োগে সরকারি খাতের অংশ ১৯৯১ সালের ৩৭.০৩% হ্রাস পেয়ে ১৯৯৭ সালে দাঁড়ায় ৮.৬৩%। বাংলাদেশে উৎপাদনকারী শিল্পসমূহের ১৯৯১ সালে পরিচালিত শুমারি অনুযায়ী (কুটির শিল্প ব্যতীত) শিল্প পরিসংখ্যানের মৌলিক সূচকসমূহ সারণিতে দেওয়া হয়েছে।

সারণি  ১৯৯১ সালে শিল্প উৎপাদন ।

প্রশাসনিক বিভাগওয়ারি শিল্প স্থাপনার সংখ্যা উৎপন্ন ও উপজাত দ্রব্যের মূল্য (মিলিয়ন টাকা)
মোট          ২৬.৪৪৬ মোট ২,১৩,০৭৩
ঢাকা          ১১,৭৯০ চূড়ান্ত উৎপন্ন দ্রব্য ২,১০,৩০১
চট্টগ্রাম       ৩,৭৯১ উপজাত দ্রব্য ২,৬২৮
রাজশাহী    ৭,৭৬৫ শিল্পবর্জ্য ১৪৪
খুলনা        ৩,১০০  
স্থায়ী পরিসম্পদ (মিলিয়ন টাকা) ১০,২৪১৫ পরিশোধিত কর (মিলিয়ন টাকা) ১১,২৯৮
কর্মচারীদের সংখ্যা   মোট  উৎপাদন (মিলিয়ন টাকা) ২,২২,৮৬৮
উভয় লিঙ্গ ১১,৫৬,২০৪
পুরুষ         ৯,৭৯,৩২৮ মোট মূল্য সংযোজন (মিলিয়ন টাকা) ৭৩,২৪৯
মহিলা        ১,৭৬,৮৭৬  
নিযুক্ত লোকসংখ্যা   উৎপাদনের উপাদানের ব্যয়ভিত্তিক মূল্য ৫১,০৯০
উভয় লিঙ্গ   ১৩,২৭,২৮৭ সংযোজন (মিলিয়ন টাকা)
পুরুষ         ১১,২৮,৯০৫
মহিলা        ১,৯৮,৩৮২

সরকার রাষ্ট্রায়াত্ত খাতের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যক্তি মালিকানাধীনে হস্তান্তর করে বেসরকারীকরণ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। একই সাথে  বিভিন্ন কারণে রুগ্ন হিসেবে চিহ্নিত শিল্পসমূহের পুনর্বাসনের কর্মসূচিও সরকার গ্রহণ করেছে। ২০০০ সনে এই কর্মসূচির অধীনে পুনর্বাসনের জন্য চিহ্নিত শিল্পসমূহের মধ্যে ছিল একটি সিমেন্ট কারখানা (বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ০.১৫ মিলিয়ন টন), একটি কাগজ কল (৩০,০০০ টন), একটি নিউজপ্রিন্ট মিল (৫২,০০০ টন), ৬টি সিগারেট কারখানা (৬৩০ মিলিয়ন শলা), ৮টি তেলের কল (৯,৩৪,৮১৮ টন), ২টি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা (৯,৫০,৪০০ টন), ২টি মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা (৬.৯ মিলিয়ন টন), ২টি হিমাগার (৫.৯ মিলিয়ন পাউন্ড), ১টি পানীয় উৎপাদনকারী কারখানা (৪.৩ মিলিয়ন বোতল), ৩টি রাসায়নিক শিল্প ইউনিট (৬৫,১০০ টন), ১টি গ্লাস ফ্যাক্টরি (৭.৫ মিলিয়ন ফুট) এবং ১২টি ঔষধ প্রস্ত্তত কারখানা। ১৯৯৭-২০০২ সাল সময়ের জন্য প্রণীত পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতের ব্যয় ১.৩৯ বিলিয়ন টাকাসহ শিল্পখাতে মোট ৮.৯৫ বিলিয়ন টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। ২০০০ সালে শিল্পসমূহে মোট ০.৬ মিলিয়ন লোক নিয়োগের হিসাব করা হয়েছিল। এর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতে ছিল ০.৫ মিলিয়ন।

১৯৯০-এর দশকে সরকারের শিল্পায়ন উদ্যোগের মধ্যে ছিল সুষমকরণ, আধুনিকীকরণ ও পুনর্নির্মাণে বিনিয়োগ, নতুন শিল্প এলাকা ও রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা সৃষ্টি, বেসরকারি বিনিয়োগ উন্নয়ন এবং প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ। আন্তর্জাতিক বাজারের গতিধারা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উদারনীতিককরণে দাতা দেশ, এজেন্সিসমূহের সুপারিশ এবং কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির সাথে মিল রেখেই শিল্পনীতিতে পরিবর্তন আনয়ন করা হয়েছিল। ১৯৮২ সাল থেকে প্রতি ৪ থেকে ৬ বছর পর পর প্রায় নিয়মিতভাবে সরকার দেশ ও বিদেশের বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের জন্য বর্ধিত প্রণোদনার ব্যবস্থা করে নতুন শিল্পনীতি প্রণয়ন করে আসছে। এই নীতিসমূহের প্রধান প্রধান সাধারণ বিষয় হচ্ছে প্রত্যন্ত পল্লী এলাকার শিল্পায়নে উৎসাহ প্রদান, উদ্যোক্তাদের স্থানীয় কাঁচামাল ও প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরে সহায়তার জন্য পদ্ধতি উদ্ভাবন।  [এম হাবিবুল্লাহ]