লোকচিকিৎসা

লোকচিকিৎসা  মানুষের সাথে রোগের সম্পর্ক, রোগের কারণ ও ফলপ্রসূ প্রতিকার সম্পর্কে লোকজ সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস, পদ্ধতি ও আচারের সমন্বয়। জৈবিক, মানসিক ও সামাজিক উপাদানসমূহ বেশ অদ্ভুতভাবেই লোকজ চিকিৎসায় সন্নিবেশিত। স্মরণাতীতকাল থেকে বাংলায় লোকজ চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচলিত। সম্প্রতি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রভূত প্রসার সত্ত্বেও লোকজ চিকিৎসা, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার স্বাস্থ্যসেবায় এখনও শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। লোকজ চিকিৎসায় বস্ত্তগত ও অবস্ত্তগত উভয় উপাদান বিদ্যমান। বস্ত্তগত উপাদানসমূহের মধ্যে রয়েছে প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, উদ্ভিদের ফল, ফুল, বীজ, পাতা, মূল এবং নানারকম তেল। প্রয়োজন অনুভূত হলেই নিকটস্থ উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীর দেহ থেকে এ ধরনের ঔষধ প্রস্ত্তত করা হয়। এসব ঔষধ যেসব উপসর্গ বা রোগের প্রতিকারে সচরাচর ব্যবহূত হয় তাদের মধ্যে রয়েছে সর্দি-কাশি, জ্বর, বদহজম, কোষ্টকাঠিন্য, ডায়রিয়া, আমাশয়, কৃমির আক্রমণ প্রভৃতি। অবস্ত্তগত উপাদানসমূহের মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক উপাদানসমূহ। পবিত্র গ্রন্থাদির বাক্যসমূহ বা ছত্র ধর্মীয় উপাদানসমূহের আওতায় পড়ে। গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী মনে করা হয় এমন ছত্রসমূহকে কাগজে লিখে তাবিজে পুরে দেওয়া হয়। অনেক সময় ধর্মীয় উপাদানের বাইরেও আধ্যাত্মিক মন্ত্র পড়ে রোগীর মুখে অথবা শরীরে ফুঁক দেওয়া হয়। ঝাড়ফুঁক, কিংবা পানিপড়ায় আধ্যাত্মিক মন্ত্র ও ধর্মীয় ছত্রের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। দেবদেবীর নামে উৎসর্গীকৃত বলি অশুভ প্রভাব দূরীকরণে ব্যবহূত হয়। আধ্যাত্মিক উপাদানের আরেকটি ধরন হলো মানুষের মাধ্যমে পূর্বপুরুষের প্রেতাত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপন। এর ফলে রোগের কারণ ও প্রতিকার সম্বন্ধে জানা যায়। প্রতিকার ব্যবস্থায় অনেক সময় নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়। কাল্পনিক ভূত তাড়াতে মন্ত্রের সাথে সাথে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়। অবস্ত্তগত উপাদানসমূহ স্বতন্ত্রভাবে অথবা বস্ত্তগত উপাদানসমূহের সাথে যুক্তভাবে সবধরনের রোগ নিরাময়ে ব্যবহূত হয়। তবে এই পদ্ধতির অত্যধিক প্রয়োগ দেখা যায় মানসিক রোগীদের চিকিৎসায়। অনেক সময় এর ব্যবহার বসন্ত, ক্যান্সার, কুষ্ঠ, ক্ষত, সাপের কামড়, এমনকি নবজাতকের টিটেনাস নিরাময়েও প্রয়োগ করা হয়।

লোকজ চিকিৎসায় লোকসমাজ থেকে উদ্ভূত পদ্ধতির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। স্বাস্থ্য এবং রোগ সম্বন্ধে রয়েছে লোকজ জনগোষ্ঠীর আলাদা ধ্যানধারণা। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল নির্দেশ করে যে, গ্রামবাংলায় অনেক সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। গ্রামীণ জনগণের রয়েছে রোগসম্পর্কিত নিজস্ব প্রত্যয়, নিরাময় ও প্রতিরোধ পদ্ধতি। বিভিন্ন ধরনের ডায়রিয়া বোঝাতে স্থানীয়ভাবে নানারকমের নাম ব্যবহার করা হয়, যেমন দুধের পায়খানা, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি। কারও উত্তেজিত আচরণকে বলা হয় বাতাস লাগা বা আলগা বাতাস। আলগা বাতাস হলো অস্পর্শনীয় আত্মা যার কোন শারীরিক অস্তিত্ব নেই। এটি বাতাসে ঘুরে বেড়ায় এবং অসাধারণ ছিদ্রানুসন্ধান ক্ষমতার বলে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। শ্বেতপ্রদাহ বোঝাতে ‘মেহ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, আর নিম্নাঙ্গ ফুলে যাওয়াকে বলা হয় পদ্মফুল। গ্রামীণ লোকসমাজের কাছে সেই ব্যক্তি স্বাস্থ্যবান যে খুব মোটা, যাকে প্রাণোচ্ছল দেখায় এবং যে শারীরীক কাজকর্মে বেশি শক্তি প্রদর্শন করতে পারে। এদের নিকট কম গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গসমূহ, যেমন মাথাব্যথা, সর্দি, সাধারণ জ্বর, কিংবা পেট খারাপ করা তেমন একটা আমল পায় না। কোন উপসর্গ মারাত্মক আকার ধারণ করার পূর্বপর্যন্ত একজন স্বাস্থ্যবান লোক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় না। রোগ হিসেবে গ্রামের মানুষ যা ধারণা করে তা আসলে স্বাভাবিক অসুস্থতার পর্যায়ে পড়ে এবং ব্যাপকার্থে, তা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার অংশ বলে বিবেচিত। আসলে উপসর্গসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন না করে এবং লোকজ সংস্কার ও প্রত্যয়সমূহের সঠিক ব্যাখ্যা ব্যতীত গ্রামবাংলায় প্রচলিত রোগসমূহকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা দুষ্কর।

রোগের কারণ সম্বন্ধে লোকজ সংস্কৃতি ও বিশ্বাসে রয়েছে আলাদ ব্যাখ্যা। রোগের কারণ সম্বন্ধে অনেক পৌরাণিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস রয়েছে, যেমন খোদার ইচ্ছা, খারাপ কাজ করার জন্য দেবতা প্রদত্ত শাস্তি, খারাপ খাদ্য গ্রহণ, খারাপ চোখ বা বদ আত্মার প্রভাব ইত্যাদি। যেমন কারো অস্বাভাবিক আচরণ এর কারণ হিসেবে আলগা বাতাসকে দায়ী করা হয়। আলগা বাতাস কীভাবে মানুষের রোগের সংক্রমণ ঘটায় তার বর্ণনায় গ্রামীণ জনগণ নানারকম বিষয়কে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে। তাদের ভাষ্য, বাতাস একজন রুগ্ন ব্যক্তির শরীরে সবসময় সরাসরি প্রবেশ করে না। রোগীর সাথে সম্পর্কিত অন্য ব্যক্তির মাধ্যমেও বাতাস লাগতে পারে। সংক্রামক ব্যাধিসমূহের কারণ বা প্রতিকারের ক্ষেত্রে আলগা বাতাসের প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম। সাধারণত স্নায়বিক দুর্বলতা, মূর্ছা রোগ, ক্রোধপ্রবণ হওয়া, ভয়ানক আচরণ, অসংলগ্ন কথাবার্তা, উচ্চৈঃস্বরে হাসা এবং অন্যান্য অস্বাভাবিক আচরণ ইত্যাদিকে আলগা বাতাসের পূর্বলক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একইভাবে অপুষ্টি, টিটেনাস ও গর্ভপাত ইত্যাদির খারাপ বাতাস কিংবা বদ আত্মার প্রভাবে সংঘটিত হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। অপরদিকে ডায়রিয়া এবং আমাশয়ের কারণ হিসেবে বলা হয় উভয়ের প্রভাব। চর্মরোগ যেমন খুজড়ি পাঁচড়া হয় রক্ত দূষিত হলে। কিছু লোক রোগের কারণসমূহকে ব্যাপকভাবে দুই শ্রেণিতে বিন্যাসিত করেন যেমন শরীরে ‘কষা’ বা সংকোচন এবং ‘রসা’ বা শৈথিল্য এর প্রভাব। তাদের মতে, প্রশ্রাবের নালিতে সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, আমাশয় এবং রক্তাল্পতা তৈরি হয় কষা থেকে এবং রসা এর প্রভাবে হয় ডায়রিয়া, ঠান্ডালাগা, সর্দি, ফুলা, গ্রন্থিফুলা ইত্যাদি। তবে সব রোগের মূলে রয়েছে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।

স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আচরণ এমনকি প্রজনন বিষয়ক স্বাস্থ্যও গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত নয়। গ্রামীণ মানুষের চিকিৎসা বিশ্বাস অনুযায়ী প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যাসমূহ, বিশেষ করে নিম্নাঙ্গের প্রদাহ বিভিন্নভাবে উদ্ভূত হতে পারে। মনে করা হয় যে শরীরের অভ্যন্তরে তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য এ ধরনের প্রদাহ ঘটে থাকে। নারীর মাসিক ঋতুস্রাব এর বিষয়েও রয়েছে চিরায়ত বিশ্বাস। স্ত্রীর ঋতুস্রাব বা সন্তান জন্মদান স্বামীকে দূষিত করতে পারে। এ কারণে স্ত্রীকে এ সময় ‘নিষিদ্ধ’ মনে করা হয় এবং পুরুষের নিকট থেকে দূরে থাকতে হয়। ঋতুস্রাবযুক্ত মহিলারা অনেক সময় পুকুরে কিংবা নদীতে গোসল করার অনুমতি পায় না।

শিশুর জন্মঘটনা আরেকটি জগৎ, যেখানে চিরায়ত কিছু অদ্ভুত বিশ্বাস ব্যাপকভাবে প্রচলিত। গর্ভবতী নারীদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের দ্বারা চেক-আপ করানো কিংবা হাসপাতালে ডেলিভারি করানোর আর্থিক ক্ষমতা অনেক গ্রামীণ গরীব মানুষের নেই। অধিকাংশ প্রসবই গৃহে সম্পন্ন হয় এমন ব্যবস্থায় যা কদাচ স্বাস্থ্যসম্মত এবং যেখানে প্রসূতির আত্মীয়স্বজনরাই প্রধান সেবিকার ভূমিকা পালন করে। কেবল সংকটাপন্ন অবস্থায় দাইকে (জন্ম সহকারী) ডাকা হয়। অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় চিরায়ত স্বাস্থ্য পরিচর্যায়ও লিঙ্গ বৈষম্য বিরাজমান। গ্রামের একজন মায়ের কাছে সন্তানের স্বাস্থ্য তার নিজের স্বাস্থ্যের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামের একজন স্ত্রীর কাছে তার স্বামীর স্বাস্থ্যই বেশি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু এবং আধুনিক চিকিৎসার সুবিধালাভে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। স্বামীর দীর্ঘদিনের অসুস্থতার কারণ হিসেবে স্ত্রীকে দোষারোপ করা হয় এবং এর জন্য তাকে কুলটা আখ্যা দেওয়া হয়। অবহেলা, অশিক্ষা, পর্দা ব্যবস্থা এবং চিরাচরিত প্রথা নারীদের স্বদেশী টোটকা চিকিৎসা গ্রহণে বাধ্য করে।

গ্রামীণ সমাজে তো বটেই, শহুরে সমাজেরও বিরাট একটি অংশে ব্যাপক বিশ্বাস রয়েছে যে, রোগ নিরাময়ে একজনকে অতিপ্রাকৃত শক্তির সহায়তা নিতে হয়। এই অতিপ্রাকৃত শক্তি বিরাজ করে পীর, ফকির প্রমুখের মাঝে। সাধারণত প্রথাগত নিরাময় পদ্ধতিতে পানিপড়া, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ, তেলপড়া ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। গ্রামীণ বাংলাদেশে মুখ্যত তিন ধরনের লোকজ চিকিৎসা বিদ্যমান। এগুলি হলো নিবন্ধনকৃত নয় এমন ভেষজ, যাদুবিদ্যাগত নিরাময় এবং ধর্মীয় টোটকা ও যাদুর সংমিশ্রণ। অনিবন্ধিত এবং আনুষ্ঠানিক চিকিৎসাসংক্রান্ত প্রশিক্ষণবিহীন ভেষজ ঔষধচর্চাকারীদের বলা হয় কবিরাজ। যদিও ‘কবিরাজ’ শব্দটি ইউনানী কিংবা আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু, বর্তমানে এ ধরণের চিকিৎসক গ্রামঞ্চলে কদাচ দেখা যায়। লোকজ কবিরাজ স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত বিভিন্ন গাছগাছড়া থেকে ঔষধ তৈরি করেন। সাধারণত তিনি এর মূলসূত্র গোপন রাখেন। এসব সূত্র তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে কিংবা তার কোন শিক্ষকের (ওস্তাদ) নিকট থেকে পেয়ে থাকেন। যাদুসংক্রান্ত চিকিৎসকরা মন্ত্রের সহায়তা নিয়ে থাকেন। তারা হলেন বেদে কিংবা ওঝা। কোন লোককে সাপে কামড়ালে ওঝাকে ডাকা হয়। আর ব্যথা, বাত, দাঁতের ব্যথার জন্য আহবান করা হয় বেদেকে। কোন ব্যক্তিকে জ্বিন বা ভূতে পেয়ে বসলে তা প্রতিকারের জন্য ধর্মীয় চিকিৎসকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

অনেক সময় ধর্মীয় ও মন্ত্রনির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতি স্বাস্থ্যবহির্ভূত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহূত হয়। যেমন লঘু অপরাধী চিহ্নিত করতে কিংবা নীতিভ্রষ্টতার প্রতিকারে ব্যবহূত হয় ধর্মীয় ও মন্ত্রনির্ভর কলাকৌশল। একজন চোরকে চিহ্নিত করতে কিংবা কোন অপরাধীকে শনাক্ত করতে আয়না পড়া, বাটিচালা, লাঠিচালা ইত্যাদির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় বিদ্বেষী ব্যক্তি কর্তৃক গুপ্ত তাবিজ উদ্ধারেও এ ধরনের কলাকৌশলের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। তবে সফলতা পেতে চাইলে লোকবিশ্বাস মতে তুলারাশির কেউ এই বস্ত্তগুলি ব্যবহার করতে হবে। যেহেতু প্রথাগত বিশ্বাস, সংস্কৃতিক আচার এবং কুসংস্কার এর প্রভাবে গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য পরিচর্যা কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে এ ধরণের লোকাচার এবং বিশ্বাসের প্রচলন রয়েছে তাই এদেরকে সম্মিলিতভাবে লোকজ চিকিৎসা নামে আখ্যা দেয়া হয়। [গোফরান ফারুকী]