লক্ষ্মীপট

লক্ষ্মীপট  লক্ষীর পট বা লক্ষ্মীর সরা (মাটির ঢাকনা সদৃশ্য)। বাংলা লোকশিল্পকলার এক সনাতন প্রকাশধারা। লক্ষ্মী হিন্দুদের ধন, সৌন্দর্য, সমৃদ্ধি ও জনন উর্বরতার দেবী। সকল হিন্দুগৃহে প্রতি বৃহস্পতিবার এই দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হলেও দেবীর বার্ষিক পূজা হয়ে থাকে শারদ পূর্ণিমা রাতে। এই সময়ে, কোন কোন হিন্দু মাটির মূর্তি গড়ে, কেউবা পূর্ণকলস জলে আমের পাতা দিয়ে তার ওপর কলসের মুখে বংশবৃদ্ধিমূলক উর্বরতা বিশ্বাসের প্রতীক ডাব বসিয়ে রেখে লক্ষ্মীপূজা করে। কোন কোন গৃহে, বিশেষ করে, অব্রাহ্মণ গৃহে লক্ষ্মীপট বসিয়ে পূজা করা হয়। লক্ষ্মীপটে লক্ষ্মীর মূর্তি অাঁকা থাকে।

লক্ষ্মীপটের উদ্ভব বাংলাদেশে। এর পটশৈলী, মূর্তি অঙ্কন ও আচাররীতি সবকিছুতেই আদি লোকজ ও দেশজ পরিচয় এবং যুগপৎ সনাতন হিন্দু ধর্মের মূলধারা থেকে বিচ্যুতির বিষয় সুপরিস্ফুট। লক্ষ্মীপট পূজায় যে মন্ত্রপাঠ করা হয় তা সংস্কৃত শ্লোকে করা হয় না, বরং তা করা হয় পাঁচালি নামের এক বিশেষ ধরনের বাংলার লোকরচনা থেকে, যাতে পাপের বিরুদ্ধে পুণ্যের জয়মূলক নীতিবাক্য তুলে ধরা হয়। এ ধরনের পূজায় আলপনা অাঁকা হয়। আলপনা অাঁকতে ডানহাতের তর্জনীর ডগা তুলি হিসেবে ও চালের গুঁড়ো পানিতে গুলে রং হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি করা হয় লক্ষ্মীপট  পূজার এক আনুষঙ্গিক অলঙ্করণ হিসেবে। আলপনা অাঁকা হয় পূজাস্থলের চারদিকে এবং পূজাস্থলে যাওয়ার পথে।

লক্ষ্মীসরা মোটামুটি চাররকমের দেখা যায়। তবে এগুলির আবার নানা রকমফেরও আছে। উল্লিখিত চার শ্রেণির সরা হলো: (১) ঢাকাই সরা- বলাবাহুল্য এ ধরনের সরার উৎপত্তিস্থল ঢাকায়। এ সরার কানা বা চারদিকের কিনার ঈষৎ উঁচু করা, যদিও এর উত্তল অংশটি খুব বেশি উঁচু নয়। উপরিভাগে সাদা রঙের প্রলেপ দেওয়া থাকে। নারায়ণ ও লক্ষ্মীকে এই সরায় পরস্পরের মুখোমুখি দন্ডায়মান অবস্থায় দেখানো হয়। তাঁদের হাতে ধরা থাকে ফসলের শীষ। ফসলের ডাঁটাসহ শীষ কনুইয়ের ওপরে উঠে আছে। হলুদ গোলাকার ফুলভরা একটি কদম গাছ শাখাসহ খিলানের মতো তাঁদের দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। লক্ষ্মী তাঁর পদ্মাসনে হাতে ফসলের ডাঁটা ধরা অবস্থায় আসীন থাকেন।আর তাঁর রত্নাধার ও বাহন পেঁচা থাকে তাঁর পায়ের কাছে।

লক্ষ্মীপট

এগুলি হলো একক প্রতিমার অনুষঙ্গী বিষয়। আবার বাণিজ্যতরীতেও লক্ষ্মীকে বসা অবস্থায় দেখানো হয়ে থাকে। এটি বস্ত্তত ঢাকা যে এককালে সমৃদ্ধ ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল তারই ইঙ্গিত। সরার গোলাকার জায়গা কতকগুলি অনুভূমিক রেখা টেনে বড়ো ও ছোট কতকগুলি অর্ধবৃত্তে ভাগ করা হয়। প্রধান দেবীমূর্তিটি অপেক্ষাকৃত সুপরিসর ঊর্ধ্ব অর্ধাংশে দেখানো হয়। এখানে এ মূর্তিটি অাঁকা হয় মূলানুগ আলঙ্কারিক ডিজাইনে, যা সরার কানা বা প্রায় কিনার অবধি স্পর্শ করে। কানার উঁচু অংশটি লালরঙে রাঙানো হয় সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে। সরার নিম্ন অর্ধাংশে লক্ষ্মী ও তাঁর বাহন পেঁচা কিংবা শুধু পেঁচাকে অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতিতে দেখানো হয়। সরার পটভূমি রেখে দেওয়া হয় সাদা। (২) ফরিদপুরী- ফরিদপুর অঞ্চলে এ ধরনের সরার উৎপত্তি। এধরনের সরায় প্রতিমা অঙ্কনে স্থানবিভাজন ও পটভূমি সাদা রাখা হয়; ঢাকাই সরার মতোই কেবল সরার কানাটি উঁচু করা হয় না।  অর্থাৎ এক্ষেত্রে শৈলীর তারতম্য রয়েছে। (৩) সুরেশ্বরী- ফরিদপুরের একটি গ্রাম সুরেশ্বরে এ ধরনের সরার উৎপত্তি। এই সরার গোলাকার জায়গা পাঁচটি খাড়া প্যানেলে ভাগ করা হয়। এসব ভাগের মধ্যভাগের প্যানেল অলঙ্কৃত করে প্রধান দেবীমূর্তি, আর বলাবাহুল্য মূর্তির আকার অপেক্ষাকৃত বড়। একটি তল বা ভিত্তিরেখা অনুভূমিকভাবে টেনে নিচের দিকে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অর্ধবৃত্ত তৈরি করা হয়। মধ্যভাগের খাড়া প্যানেলটিকে আরও দুটি আয়তক্ষেত্রে বিভক্ত করা হয়। এর অপেক্ষাকৃত ছোট ঊর্ধ্ব প্রকোষ্ঠে দেখানো হয় দুর্গার স্বামী শিবকে। মধ্য প্যানেলের প্রকোষ্ঠ জুড়ে থাকেন প্রধান দেবীমূর্তি দুর্গা। তিনি সেখানে সিংহবাহনী অবস্থায় অসূরবধে নিয়োজিত। তাঁর সন্তানগণ- লক্ষ্মী ও গণেশ আছেন বাম পাশের দুই খাড়া প্রকোষ্ঠে, অন্যদিকে সরস্বতী ও কার্তিকেয় রয়েছেন ডানদিকের অনুরূপ প্রকোষ্ঠ দুটিতে। তলরেখার নিচের অর্ধবৃত্তে লক্ষ্মীকে দেখা যায়। পঞ্চরত্ন মন্দিরের আকৃতিতে শীর্ষদেশে পদ্মকলি খিলান স্থাপত্য গাঠনিক উপায়ে স্থানবিভাজনকে আরও কুশলী করে তোলা হয়। সরায় সাদা রঙের প্রথম অনুজ্জ্বল পোঁচ কিংবা পটভূমি নিয়ে যা-ই করা হোক তা ঢাকাই বা ফরিদপুরী সরারই অনুরূপ। (৪) গণকী- এ হলো হিন্দু সমাজের একেবারে নিম্নস্তরের লোকজনের ব্যবহূত সাধারণ সরা বা লক্ষ্মীর পট। এই সরার পটভূমি ঘন লাল। সরার স্থানবিভাজনও করা হয়েছে অনুভূমিকভাবে, উপরের অর্ধাংশ অপেক্ষাকৃত বড়, নিচের অর্ধাংশ ছোট প্যানেলে। সরার কানায় কালো রং দেওয়া। উপরের দিকের প্যানেলে একটি অর্ধ বৃত্তাকার পুষ্প অলঙ্করণমূলক পটি বা বন্ধনী সংযোজন করা হয়েছে। এটি সরার কানা স্পর্শ করে আছে। পটের প্রধান দেবীমূর্তি হলেন দুর্গা ও তাঁর পরিবার। নিচের প্যানেলে রয়েছেন লক্ষমী ও তাঁর বাহন পেঁচা। পটচিত্রের দেবদেবীর পরিধানে দামী, রত্নময় পোশাক। প্রচুর সাদা রেখা, বিন্দু ও ছোপ সহকারে সরার অলঙ্করণের কাজ শেষ করা হয়েছে।

আর সব লোকশিল্পশৈলীর মতো পটশৈলীর উত্তরাধিকার বংশানুক্রমিকভাবে হস্তান্তরিত হয়ে এসেছে। কাদায় মূর্তি গড়া কুমার নানা মৌসুমেই এই পট রাঙানোর কাজটিও করে থাকে। উল্লিখিত প্রথম তিন ধরনের সরার বেলায় রঙের প্রলেপ দেওয়া হয় ঢালাও পোঁচ লাগিয়ে স্থানানুযায়ী, আর তাতে একটা অস্থিতিস্থাপকতার আমেজ আনা হয়। কাজ শেষ করে আনার পর্যায়ে কতকগুলি দ্রুত অন্তিম পোঁচ লাগানো হয় কালো রঙের। গণকী ধরনের সরায় সতর্কতার সাথে রঙ দেওয়ার ও পূর্ণ করার কাজটি করা হয়। আর এই রঙের পোঁচগুলি কখনও পরস্পরের সমোন্নতিরেখার সীমা পেরিয়ে একে অন্যের ওপর গিয়ে পড়ে না। পূর্ণতাদায়ক রেখাগুলিও কখনও বিচ্যুত হয়েছে নির্ধারিত ধারা থেকে-এমনও দেখা যায় না। পটচিত্র অাঁকার এই যে শৈলী তাতে লোকশিল্পকলার সকল বৈশিষ্ট্যই বর্তমান। এতে পটে রূপরেখামূলক রেখা অঙ্কনের ও হালকা রঙের ছোঁয়াচ দেওয়া ছাড়াই ঢালাও রঙ ব্যবহারে পক্ষপাতিত্ব লক্ষ করা যায়। মূর্তির ভাবভঙ্গিমার অভিব্যক্তি ঘটানো হয়েছে চর্চিত ছান্দসিকতায়। আর হালকা রঙের ছোঁয়াচ বা প্রলেপ লাগানোর বেলায় লাল, হলুদ, নীল, সবুজ, সাদা ও কালো রং ব্যবহার করা হয়েছে। এ রংগুলি সবই প্রাণবন্ত ও সুতীব্র। পণ্য হিসেবে তৈরি হলেও লক্ষ্মীর পট বা সরা জীবন্ত লোকঐতিহ্যের ধারক হয়ে একটি জনসমাজকে বাঁচিয়ে রেখেছে।  [শোভন সোম]