রুয়াইলবাড়ি

রুয়াইলবাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা রুয়াইলবাড়ি গ্রামে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। এ ক্ষুদ্র সামরিক ঘাটির পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষসমূহ জোড়া দুর্গ দেওয়ালের অভ্যন্তরে ছিল। এর পশ্চিম দিকে রয়েছে বেতাগী নদী এবং অন্য তিন দিক পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। বেতাগী নদী ধ্বংসাবশেষসমূহের সমগ্র পশ্চিম তীর ধরে এঁকেবেঁকে কিছু দূরত্বে উত্তর দিকে মোড় নিয়েছে এবং মৃত প্রায় সুতী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।

সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৪-১৫১৯) কামরূপের খেন রাজা নিলাম্বরের বিরুদ্ধে ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে এক যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং তাঁর রাজধানী অধিকারে সাফল্য লাভ করেন। সদ্য বিজিত এ পার্বত্য অঞ্চলের শাসনভার হোসেন শাহের পুত্র নাসিমউদ্দীন আবুল মুজাফফর নুসরত শাহের (১৫১৯-৩২) ওপর অর্পণ করা হয়। কিন্তু অহম রাজ্যের ওপর এ অধিকার ছিল স্বল্পস্থায়ী এবং নুসরত শাহকে পশ্চাদপসরণ করতে হয়। কথিত আছে যে, নুসরত শাহ কামরূপ থেকে পালিয়ে আসেন এবং রুয়াইলবাড়ির সামরিক ঘাটিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি এর নতুন নাম করেন নুসরত আজিয়ান মহল। পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা নুসরত শাহী পরগনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

রুয়াইলবাড়ির সুরক্ষিত এলাকার মোটামুটি আয়তন ৫৩৩.২৩ মি × ৪২৬.৫৮ মি। পূর্বদিকের ইটের দেওয়ালে একটি প্রবেশদ্বার রয়েছে, যা বর্তমানে স্থানীয়ভাবে সিংহ দরওয়াজা (লায়ন গেইট) নামে পরিচিত। মাটির দুর্গের অভ্যন্তরে পূর্ব দিকে দুটি বড় পুকুর আছে। এ দুটির মধ্যে উত্তর দিকে অবস্থিত বড়টির পরিমাপ ১৭৭ মি × ৯০ মি এবং দক্ষিণ দিকেরটির আয়তন ১৫৬ মি × ৯০ মি। সিংহ দরওয়াজা (৬ মিটার পথসহ ১০.২ মি × ৮ মি প্রশস্ত) বরাবর ২৫.৫ মিটার প্রশস্ত একটি উঁচু পথের দ্বারা পুকুর দুটি বিচ্ছিন্ন ছিল। এ পথটি অভ্যন্তরীণ ইটের দেওয়ালের দিকে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। দক্ষিণ দিকে মাটির দেওয়ালের উভয় পার্শ্বে দুটি পরিখা ছিল। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ পরিখাটি একটি প্রশস্ত নালার মাধ্যমে পূর্বদিকে দুটি বড় পুকুরের সাথে সংযুক্ত ছিল। বর্তমানে পুকুর দুটিতে মাছের চাষের উন্নয়নের জন্য নালাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

দুর্গের আরও দুটি প্রবেশ পথ ছিল; একটি দক্ষিণ দেওয়ালে এবং অন্যটি উত্তর দেওয়ালে। মনে করা হয় যে, দক্ষিণদিকের অভ্যন্তরীণ পরিখা সিংহ দরওয়াজামুখী উঁচুপথে পশ্চিম দিকের বেতাগী নদী থেকে আসা নৌযানগুলির নোঙ্গর করার সুযোগ করে দিয়েছিল। দক্ষিণদিকের প্রবেশপথটি নির্মিত হয় বড় বড় পাথর খন্ড দ্বারা। বর্তমানে এগুলি ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় মাটিতে পড়ে রয়েছে।

ইটের দেওয়ালে বেষ্টিত দুর্গের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষিত এলাকা উত্তর-দক্ষিণে ২৪৬ মি এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৫০ মি পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। এ এলাকাটিকে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর একটি দেওয়াল দ্বারা দুটি অসমান অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। এর উত্তর অংশের আয়তন ছিল ১৫০ মি × ১৩৫ মি এবং দক্ষিণ অংশের আয়তন ১৫০ মি × ৯৭.৫ মি। উত্তরাংশে রয়েছে বুরুজ বা উঁচু ইমারত (টাওয়ার) নামে পরিচিত আয়তাকার একটি উঁচু ঢিবি, একটি পুকুর, একটি প্রবেশপথ ও একটি কবরস্থান। আর দক্ষিণ অংশে দেখা যায় একটি জামে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ, যা খননের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছিল। পূর্বদিকে বুরুজ ঢিবির পার্শ্বে অপেক্ষাকৃত পরবর্তী সময়কার একটি ভবন রয়েছে। এর ভেতরে বিভিন্ন আকারের পাঁচটি কক্ষ আছে, যার অংশবিশেষ বর্তমানে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার দখলে আছে।

বুরুজ ঢিবিটি অভ্যন্তরীণ ইটের বেষ্টনীর উত্তর-পশ্চিম কোণায় অবস্থিত। এর পরিমাপ ২৫.৫ মি × ২১ মি × ৬.৬ মি। এখানে খননকার্যের ফলে একটি বড় পর্যবেক্ষণ চিলেকোঠা (watch tower) আবিষ্কৃত হয়েছে। বাহির থেকে এর পরিমাপ পূর্ব-পশ্চিমে ২০.৫ মি এবং উত্তর-দক্ষিণে ২৫.৮ মি। বিভিন্ন সময়ে কয়েকবার এটি পুনঃনির্মিত হয়েছিল। দক্ষিণদিকে দুপার্শ্বদেওয়ালের মধ্যে ২ মিটার চওড়া সিঁড়ি নির্মিত হয়। সিঁড়িতে ওঠা-নামার দুটি প্ল্যাটফর্ম-এর (উঁচু এবং নিচু) মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে নিচু প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করা হতো পূর্ব দিক থেকে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং দক্ষিণ দেওয়ালে একটি প্রবেশদ্বার নির্মাণ করা হয়। আরও পরে দুটি প্রবেশদ্বারই ব্যবহূত হয় বলে ধারণা করা হয়। স্থানীয় জনগণের লুণ্ঠন সত্ত্বেও উত্তর ও পূর্বদিকের প্রবেশ দেওয়াল দুটি সাদা, নীল, হালকা সবুজ এবং বাদামী রংয়ের চকচকে টালি দ্বারা ফুল ও জ্যামিতিক নক্সায় সুসজ্জিত অবস্থায় পাওয়া যায়।

প্রাথমিক পর্যায়ে দুটি বড় কক্ষ নির্মিত হয়, যার আয়তন যথাক্রমে ৫.৪ মি × ৫.৪ মি এবং ৫.৪ মি × ৬.৬ মি। আর উঁচু ইমারতের (টাওয়ার) নির্মাণের দ্বিতীয় পর্যায়ে দক্ষিণের ধ্বংসাবশেষের উপর অপেক্ষাকৃত দুটি ছোট কক্ষ নির্মিত হয়, যার প্রত্যেকটির পরিমাপ ৭ মি × ২.৪ মি। খননকার্যের ফলে বুরুজ ঢিবির পূর্বদিক থেকে সমান্তরাল তিনটি দেওয়াল বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। এগুলির মধ্যে বাইরের উত্তর দেওয়াল ৪.৫ মি দৈর্ঘ্য পর্যন্ত দেখা যায়। কিন্তু এর অবশিষ্ট অংশ প্রায় ৭.৫ মি দেওয়ালের ইট চুরি হয়ে গেছে। উত্তর দেওয়ালে ১.৬ মি প্রশস্ত প্রবেশদ্বার ছিল। খননকার্যের ফলে উপরিউক্ত কাঠামোগুলি ছাড়াও উঁচু ইমারত ঢিবির দক্ষিণ পশ্চিমে কিছু বিক্ষিপ্ত দেওয়াল আবিষৃকত হয়েছে, যা কোন সুচিন্তিত পরিকল্পনার প্রমাণ দেয় না।

দুর্গের উত্তরাংশের অভ্যন্তরীণ ইটের বেষ্টনীর পরিমাপ উত্তর-দক্ষিণে ৫৬.৭ মি এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৫০.২ মি। এখানে দুটি অসমান আঙিনা রয়েছে। একটি অভ্যন্তরে ও অপরটি বাইরে। আঙিনা দুটির আয়তন ছিল যথাক্রমে ৩৭.৫ মি × ২৪.৫ মি এবং ৯০ মি × ৬৯ মি। অভ্যন্তরের আঙিনার পশ্চিম ও পূর্ব কোণার দিকে কয়েকটি কক্ষের বিক্ষিপ্ত ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। যদিও এর আংশিক অংশ একটি আধুনিক মাদ্রাসার দখলে, তবুও পশ্চিমে তিনটি কক্ষ দেখা যায় যার দুটির পরিমাপ ৫.৬ মি × ৩.৩ মি এবং তৃতীয়টির পরিমাপ ১১.৭ মি × ৩.৩ মি। কক্ষগুলির দেওয়ালে রয়েছে কুলুঙ্গি। অনুরূপভাবে পূর্বদিকেও একই ধরনের কুলুঙ্গিসহ অনুরূপ আয়তনের তিনটি কক্ষ রয়েছে। আঙিনার দক্ষিণ অংশে প্রবেশপথের উভয়দিকে ৫.৭ মি × ৫ মি আয়তনের দুটি করে কক্ষ রয়েছে।

বারোদুয়ারী ঢিবি   ইটের বেষ্টনীর দক্ষিণ অংশের অভ্যন্তরে সিংহ দরওয়াজার দক্ষিণে এবং কবরস্থানের প্রায় ৩৮ মি দক্ষিণে অবস্থিত। এটি ভুলবশত বারোদুয়ারী নামে বা বারো দরওয়াজা বিশিষ্ট ইমারত বলে পরিচিত। খননকার্যের ফলে এখানে প্রাক-মুগল যুগের একটি বড় মসজিদের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। পরিকল্পনায় আয়তাকার এ মসজিদের পরিমাপ উত্তর-দক্ষিণে ২১.৫৬ মি ও পূর্ব-পশ্চিমে ১৪.৩৩ মি এবং দেওয়ালগুলি প্রায় ২ মি পুরু। সম্ভবত এর ছাদ ১৫টি গম্বুজ দ্বারা (বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত) আবৃত ছিল। এ গম্বুজগুলি দুসারির প্রতি সারিতে চারটি করে মোট আটটি পাথরের থামে বহনকারী খিলানগুলির উপর স্থাপিত ছিল। পূর্ব দেওয়ালে পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের প্রতিটিতে তিনটি করে খিলান দরওয়াজা ছিল। মনে করা হয় যে, কিছুকাল পরে উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের দরওয়াজার নিচের অংশ ইট দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং জানালায় রূপান্তর করা হয়। পশ্চিম দিকের কিবলা দেওয়ালে চমৎকারভাবে সজ্জিত অলঙ্কারস্বরূপ চারটি মিহরাব ছিল। কিন্তু উত্তর-পশ্চিম কোণার শেষেরটিতে মিহরাব স্থাপনের পরিবর্তে একটি বদ্ধ খিলান আছে, যেখানে রয়েছে আকর্ষণীয় পোড়ামাটির শিকল ঘণ্টা এবং কেন্দ্রে ফুলেল মোটিফ।

মসজিদের চারদিকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় প্রচুর অলঙ্কৃত ইট দেখা যায়। চমৎকার সূর্যমুখী ফুলের নকশায় সজ্জিত দেওয়ালের গুটিযুক্ত বর্ডারে এগুলি সংযুক্ত ছিল। পাথর ও পোড়ামাটির সূক্ষ্ম শিল্পকর্মগুলি সুলতানি আমলের মসজিদ স্থাপত্যে ব্যবহূত রীতিতে নির্মিত। ফলকসমূহে ফুল ও জ্যামিতিক নকশায় বদ্ধ মেরলোন, অাঁকা-বাঁকা লতা এবং দড়ি নকশার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অনুরূপভাবে বুরুজ ঢিবিতে প্রাপ্ত চকচকে টালিতেও সুন্দর ফুল, লতা এবং নানা ধরনের আকর্ষণীয় জ্যামিতিক নকশা পরিলক্ষিত হয়।

খননকার্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্ন নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে বহুবর্ণের নকশা অঙ্কিত টালি, ফুল ও জ্যামিতিক মোটিফ, শোভাবর্ধক ইট, বর্শা, নানা ধরনের লোহার জিনিসপত্র এবং চীনামাটির তৈরি অনেক বাসনপত্রের বিশাল সংগ্রহ।

কাল-পরিক্রমায় শত শত বছর ধরে সুলতানি যুগের বিস্তৃত সীমান্ত সামরিক ঘাটিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এতে প্রকৃতির যেমন হাত ছিল, তেমনি ছিল মানুষের হাত।  [নাজিমউদ্দীন আহমেদ]