রায়, শিবনারায়ণ

রায়, শিবনারায়ণ (১৯২১-২০০৮)  সাহিত্যিক, সমালোচক, মানববাদী দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, সম্পাদক। তিনি ১৯২১ সালের ২০ জানুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃনিবাস বরিশাল জেলার রায়েরকাঠি গ্রাম। পিতা উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ শাস্ত্রী ছিলেন নাট্যকার, লেখক, শিক্ষাবিদ। মাতা, রাজকুমারী দেবী। শিবনারায়ণ রায় প্রধানত ইংরেজি এবং দর্শন অধ্যয়ন করেন; তবে ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব এবং শিল্পকলায়ও তাঁর অবদান রয়েছে।

কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে তিনি তাঁর কর্মজীবন আরম্ভ করেন ১৯৪৫ সালে।  ১৯৬৩ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতবিদ্যা বিভাগের প্রধান ছিলেন।  এ ছাড়া, তিনি অক্সফোর্ড, কেমব্রি্জ, শিকাগো এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সমেত ইউরোপ, অ্যামেরিকা এবং জাপানের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন।

জীবনের প্রথমপর্বে তিনি ছিলেন কট্টর মার্কসবাদী। পরে, তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সান্নিধ্যে এসে তাঁর আদর্শে প্রভাবিত হন। মানবেন্দ্রনাথ রায় সুপরিচিত ছিলেন এম এন রায় নামে। শিবনারায়ণ রায় এম এন রায়ের র‌্যাডিকেল হিউম্যানিজ্ম দর্শনের একজন প্রধান প্রবক্তা ও অনুসারী। এম এন রায় এক সময়ে লেনিনের উপদেষ্টা এবং দ্বিতীয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সদস্য ছিলেন। তাছাড়া, এম.এন রায় রাশিয়ার বাইরে প্রথম কমিউনিস্ট দল করেন (মেকসিকোতে); ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি, কিন্তু মার্কর্সীয় রক্তক্ষয়ী ও মানবতা-বিরোধী আদর্শে বিশ্বাস রাখতে পারেননি। তাই তিনি র‌্যাডিকেল হিউম্যানিজ্মের দর্শন প্রচার করেন।

‘হিউম্যানিজম’-এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘মানববাদ’ করা গেলেও ‘র‌্যাডিকেল’-এর প্রতিশব্দ বাংলা ভাষায় নেই। তাই ‘র‌্যাডিকেল হিউম্যানিস্ট’-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এঁরা হচ্ছেন সাধারণ হিউম্যানিস্টদের থেকে কিছু বেশি লিবারেল, অথচ রিভলিউশনারি হিউম্যানিস্টদের থেকে কিছু কম রিভলিউশনারি। এঁরা বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করেন। ইতোমধ্যে পাশ্চাত্যের ডেভিড হিউম, জন স্টুয়ার্ট মিল, বার্টান্ড রাসেল প্রমুখ চিন্তাবিদেরা এ ধারার চিন্তা প্রকাশ করেন। শিবনারায়ণ রায় এম এন রায়ের মতো সাম্যবাদী সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে সহিংস বিপ্লব সমর্থন করতে পারেননি; বরং গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজ পরিবর্তন এবং মানবতার বিকাশ ঘটানোর পক্ষপাতী ছিলেন।

শিবনারায়ণ নানা বিষয়ে পঞ্চাশটিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এসবের মধ্যে ছিল সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস এবং সমাজ-সংস্কৃতি। তিনি কয়েকটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর চিন্তাভাবনায় তিনটি প্রধান স্তম্ভ লক্ষ করা যায়। রেনেসাঁস, মানবতন্ত্র এবং নাস্তিক্য। সে সঙ্গে যুক্ত হয়েছ শিল্পসাহিত্য বিষয়ে তাঁর গভীর অধ্যয়ন ও স্বাতন্ত্র্যধর্মী চিন্তা যা ফুটে উঠেছে তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে,  যেমন—সাহিত্যচিন্তা (১৯৫৬), মৌমাছিতন্ত্র (১৯৬০), কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা (১৯৭৩), গণতন্ত্র সংস্কৃতি ও অবক্ষয় (১৯৮১), রবীন্দ্রনাথ শেক্সপীয়র ও নক্ষত্র সংকেত (১৯৮৩), স্রোতের বিরুদ্ধে (১৯৮৪), রেনেসাঁস (১৯৯২), স্বদেশ স্বকাল স্বজন (১৯৯৬) এবং Radicalism : Philosophy of democratic Revolution (1946), Socialism in India (1965), The Intelligentsia (1986)।

একজন সম্পাদক হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান ছিলেন। ১৯৫২ সালে উত্তরসূরী এবং পরে জিজ্ঞাসা নামে একটি মননশীল ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি তিনি বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে দীর্ঘ বাইশ বছর (১৯৮০-২০০২) সম্পাদনা করেন। এম এন রায়ের র‌্যাডিকেল হিউম্যানিস্ট পত্রিকাও তিনি কিছু কাল সম্পাদনা করেন। সম্পাদক হিসেবে তাঁর আর-একটি বিশেষ কৃতিত্ব হচ্ছে চার খন্ডে এম এন রায়ের নির্বাচিত রচনাবলী প্রকাশ। উল্লেখ্য যে, এম এন রায় প্রধানত তাঁর চিন্তাভাবনা ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করেন। ইংরেজি ছাড়াও তিনি বিভিন্ন ভাষায় তাঁর চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেন, বিশেষত তিনি যখন পৃথিবীর নানা দেশে ভ্রমণ করেন। এরকম বিভিন্ন ভাষায় লেখা রচনাগুলি শিবনারায়ণ রায় সেসব দেশ থেকে সংগ্রহ এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করে Selected Works of M. N. Ray, ১৯৮৭-১৯৯৭ শিরোনামে প্রকাশ করেন। একই পদ্ধতিতে শিবনারায়ণ রায়ের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান এম এন রায়ের জীবনী লেখা। শিবনারায়ণ রায় এ জীবনীও লিখেছেন চার খন্ডে—In Freedom’s Quest : Life of M. N. Ray, (১৯৯৯-২০০৭) শিরোনামে।

শিবনারায়ণ রায় সমালোচনামূলক এবং বিশ্লেষণাত্মক রচনাশৈলির জন্যে বিশেষভাবে খ্যাত ছিলেন এবং এ মেধা দিয়ে তিনি বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রা সংযোজন করেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তিনি সমর্থন করেন এবং বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের পক্ষে মতামত গড়ে তোলার জন্যে অনেক লেখালেখি করেন। তিনি ধর্মে আস্থাহীন ছিলেন। তাঁর মৃত্যু শান্তিনিকেতনে, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮। [গোলাম মুরশিদ]

গ্রন্থপঞ্জি  স্বরাজ সেনগুপ্ত, সম্পাদক, মনস্বী বিপস্নবী শিবনারায়ণ রায় (কলকাতা, ২০০১); কবিতীর্থ, ‘শিবনারায়ণ রায় বিশেষ সংখ্যা’, একাদশ বর্ষ, আগস্ট ১৯৯২; কবিতর্থ, ‘শিবনারায়ণ রায় আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য’, সপ্তবিংশতি বর্ষ, জ্যৈষ্ঠ ১৪১৫; জিজ্ঞাসা, ‘শিবনারায়ণ রায় বিশেষ সংখ্যা’, সপ্তবিংশ বর্ষ, দ্বিতীয়-তৃতীয় সংখ্যা, ২০০৯; ঐক্য পত্রিকা, ‘শিবনারায়ণ রায় সংখ্যা’, ডিসেম্বর ২০০৯; মূল্যায়ন, ‘শিবনারায়ণ রায় সংখ্যা’, ২০০৯।