রায়, অজয় কুমার

অজয় কুমার রায়

রায়, অজয় কুমার (১৯৩৫-২০১৯) বিশিষ্ট পদার্থবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, মানবাধিকারকর্মী এবং মুক্তচিন্তক। তিনি ১৯৩৫ সালে দিনাজপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। অধ্যাপক এ.কে রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যয়ন করেন এবং সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ফিরে আসার পর অধ্যাপক রায় ইউনেস্কোর সহায়তায় ১৯৬৮-৬৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণা কেন্দ্র ‘অ্যাডভান্সড সেন্টার অফ সলিড স্টেট ফিজিক্স অ্যান্ড ক্রিস্টালোগ্রাফি’ প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক নিযুক্ত হন এবং ৪০ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার পর ২০০০ সালে অবসরগ্রহণ করেন। এরপর তিনি দুই বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

প্রফেসর রায়ের গবেষণার কাজ ছিল মূলত সলিড-স্টেট ফিজিক্স, ক্রিস্টালোগ্রাফি এবং পাতলা ফিল্ম নিয়ে। তাঁর প্রধান গবেষণার ক্ষেত্র ছিল ‘ইলেক্ট্রন স্পিন রেজোন্যান্স’, যা তিনি রাসায়নিক পদার্থবিদ্যা এবং বিকিরণ রসায়নের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি ‘ডিসসোসিয়েটিভ ইলেক্ট্রন ক্যাপচার’ প্রক্রিয়াতে মৌলিক অবদান রেখেছিলেন এবং তাঁর গবেষণার ফলাফলগুলি জৈব অণুর মধ্যে একটি আটক হওয়া ইলেকট্রনের কী ঘটে সেটার ব্যাখ্যা করে। তিনি প্রফেসর শামসুল হক এবং প্রফেসর এ.কে রফিক উল্লাহর সাথে বিদ্যুত এবং চুম্বকত্বের উপর একটি বই রচনা করেছিলেন, যা গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নের স্নাতক ছাত্রদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিল।

অধ্যাপক রায় পদার্থবিদ্যা, বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা, দর্শন এবং বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্পসংখ্যক শিক্ষকদের একজন, যাঁরা মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কুমিল্লা সীমান্তে গেরিলা যুদ্ধে নিয়োজিত হয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। অধ্যাপক অজয় রায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

অধ্যাপক রায় তাঁর কর্মমুখর জীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি ২০০৭ সালে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতি পুরস্কার’, ২০০৮ সালে ‘বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ’, ২০০৯ সালে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি ফেলোশিপ’, ২০১১ সালে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ এবং ২০১২ সালে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন। এর পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ ফিজিক্যাল সোসাইটির একজন ফেলো ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

অজয় কুমার রায় ২০১৯ সালের ৯ই ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন । [ইয়ারুল কবীর]