রস, রোনাল্ড

রোনাল্ড রস

রস, রোনাল্ড (১৮৫৭-১৯৩২)  ম্যালেরিয়া রোগের কারণ আবিষ্কারের জন্য চিকিৎসা শাস্ত্রে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। ১৮৫৭ সালের ১৩ মে ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশের আলমোড়া নামক একটি পার্বত্য এলাকায় রস জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা স্যার ক্যাম্পবেল ক্লে গ্র্যান্ট রস (Sir Campbell Claye Grant Ross) ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল। মাতা মাতিলদা সার্লোট ছিলেন লন্ডনের আইন ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড মেরিক এল্ডারটন-এর জ্যেষ্ঠ কন্যা। মাত্র আট বছর বয়সে রোনাল্ড রসকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য ইংলান্ডে পাঠানো হয়। রাঈড (Ryde) এ দুটি স্বল্পখ্যাত স্কুলে শৈশবকালীন শিক্ষাশেষে তাঁকে ১৮৬৯ সালে সাউদাম্পটনের নিকটবর্তী স্প্রিংহিল-এ একটি বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়।

রস প্রাণিবিদ্যায় আগ্রহী ছিলেন। এছাড়া ছন্দ, সঙ্গীত ও কাব্য বিষয়েও তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তিনি শিল্পি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পিতার ইচ্ছায় তিনি চিকিৎসক হিসেবে লন্ডনের সেন্ট বার্থলোম্যু’র হাসপাতালে যোগ দেন। রস ১৮৭৯ সালে রয়াল কলেজ অব সার্জন্স-এর সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন (এম.আর.সি.এস)। কিন্তু প্রথমবার এল.এস.এ (Licentiate of the Society of Apothecaries) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ১৮৮১ সালে এল.এস.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। অতঃপর তিনি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসে যোগ দেন।

১৮৯৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ইংল্যান্ড গেলে স্যার প্যাট্রিক ম্যাসনের সঙ্গে রস-এর সাক্ষাৎ হয়। ম্যাসন তাঁকে ১৮৮০ সালে আলফনস্ লেভারান কর্তৃক আবিষ্কৃত মানবদেহে ম্যালেরিয়ার জীবাণুগুলির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ১৮৭৮ সালে ম্যাসনের নিজের পর্যবেক্ষণেই ধরা পড়ে যে, বিশেষ ধরনের মশা মনুষ্য শরীরে এক বিশেষ ধরনের জীবাণুবাহী হিসেবে কাজ করতে পারে, যা পরবর্তীকালে স্যার রস-এর গবেষণায়ও পূর্বানুমান হিসেবে ব্যবহূত হয়। এই বিশেষ ধরনের মশা ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু বহন করে। পরের বছর রস ভারতে ফিরে এসে ম্যাসনের উৎসাহ ও পরামর্শ অনুসারে কাজ শুরু করেন। ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট তিনি আবিষ্কার করেন যে, এনোফিলিস প্রজাতির মশার পাকস্থলীর প্রাচীরের জলকোষে এক ধরনের দানাদার কালচে রঞ্জক পদার্থ রয়েছে। কয়েক মাস পর রস খাঁচায় বন্দি পাখির মাধ্যমে জীবাণুর জীবনচক্র বিশ্লেষণ করে দেখতে পান যে, রোগাক্রান্ত পাখির দেহ থেকে ম্যালেরিয়া সুস্থ পাখির দেহে সংক্রমিত হতে পারে। অন্তত একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ম্যালেরিয়া পানি বা বায়ুবাহী কোন রোগ নয়, এটা সংক্রামক ব্যাধি যা একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে মশার মাধ্যমে সংক্রামিত হয়। বাতিস্তা এবং তাঁর ইতালীয় সহকর্মীরাও মানব দেহে ম্যালেরিয়ার জীবাণু সংক্রমণ নিয়ে গবেষণা করেন; যার ফলে রস না বাতিস্তা আগে গবেষণা করেছেন এ নিয়ে তিক্ত বিতর্কের সূত্রপাত হয়। ১৯০২ সালে রস-এর নোবেল পুরষ্কার লাভের মাধ্যমে বহুলাংশে এই বিতর্কের অবসান ঘটে।

রস ১৮৯৯ সালে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস থেকে অবসর গ্রহণ করে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। সেখানে তিনি লিভারপুলস্থ স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন (School of Tropical Medicine, Liverpool)-এ প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন (অধ্যাপক: ১৯০২-১৯১২) এবং ১৯১২ সালে লন্ডন যান ‘কনসালটিং প্র্যাকটিস’ করার জন্য। রস-এর জীবনের বাকি সময়টুকুর অধিকাংশই কাটে ম্যালেরিয়া শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন জনস্বাস্থ্য কার্যক্রমে। তিনি বহু দেশে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ বিষয়ে প্রচারণাকর্মে অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্ব দেন। তিনি ম্যালেরিয়া বিষয়ক বহু নিবন্ধ যথা: Instructions for the Prevention of Malarial Fever for the Use of Residents in Malarial Places) Mosquito Brigades and How to Organise Themএবং Prevention of Malaria লেখেন। ১৯২৩ সালে তিনি তাঁর জীবনস্মৃতি Memoirs রচনা করেন। গণিত বিষয়েও তিনি বেশ কিছু নিবন্ধ লেখেন। এছাড়া তিনি বেশ কিছু নাটক, উপন্যাস এবং কবিতাও রচনা করেন।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞান সংগঠনসমূহ রসকে বহু সম্মানসূচক ডিগ্রিতে ভূষিত করে। ১৯০১ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন এবং ১৯০৯ সালে তাঁকে রয়াল মেডেল প্রদান করা হয়। ১৯০২ সালে নোবেল পুরষ্কার অর্জন ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯১২ সালের পর তিনি একই সাথে কিংস কলেজ হসপিটালের ট্রপিক্যাল রোগের ফিজিশিয়ান এবং লিভারপুলস্থ ট্রপিক্যাল স্যানিটেশনের অধ্যাপকের দ্বৈত দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিনি ১৯১৩ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ‘Science Progress’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ‘War Office’-এর ম্যালেরিয়া বিষয়ক পরামর্শক নিযুক্ত হন। ১৯২৬ সালে পাটনিতে (Putney) প্রতিষ্ঠিত ‘Ross Institute and Hospital for Tropical Diseases’-এর প্রথম পরিচালকও ছিলেন রোনাল্ড রস। এই ইনস্টিটিউটটি ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে London School of Hygiene and Tropical Medicine-এর সাথে যুক্ত হয়।

রোনাল্ড রস ১৯৩২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মারা যান। তাঁকে পাটনি ভেইল সিমেট্রিতে স্ত্রীর পাশে (স্ত্রী ১৯৩১ সালে মারা যান) সমাহিত করা হয়।  [সুজাতা মুখার্জী]