রংপুর-দিনাজপুর রুরাল সার্ভিস

রংপুর-দিনাজপুর রুরাল সার্ভিস বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা লুথেরান ওয়ার্ল্ড ফেডরেশন-এর মাধ্যমে এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুর দিকে  আরডিআরএস যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশের মানুষকে ত্রাণ সহায়তাদান এবং তাদের পুনর্বাসনের কাজ করে। বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে গ্রামীণ জনপদ ও জনমানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি কাজ শুরু করে এবং ধীরে ধীরে এর কাজের পরিধি প্রসারিত হয়। আরডিআরএস-এর তিনটি মৌলিক কাজের ধারা রয়েছে: ত্রাণ সহায়তা, পুনর্বাসন সেবা ও সমন্বিত কর্মসূচি প্যাকেজের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়ন। এই কাজের ধারা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরডিআরএস আশির দশক থেকে ইউনিয়নভিত্তিক গণসংগঠন ‘ইউনিয়ন ফেডারেশন’ গড়ে তোলে। আরডিআরএস ১৯৯৭ সালে দেশিয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিসাবে যাত্রা শুরু করে এবং  জাতীয় সম্পদে ন্যায্য অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার মূল লক্ষ্য স্থির করে।

আরডিআরএস নিজ কাজের পরিক্রমায়  ক্ষুদ্রঋণকে সংযুক্ত করে এবং পরবর্তীকালে এই কর্মসূচি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। নারী ও শিশুর প্রতি বৈষম্য রোধের পাশাপাশি এই সম্পর্কিত ইস্যু নিয়ে আরডিআরএস জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেটওয়ার্ক গঠন করে। এই সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটি পলিসি অ্যাডভোকেসি করছে এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা বিশেষ করে নিরাপদ মাতৃত্ব ও শিশুস্বাস্থ্য উন্নয়নে উল্লেযোগ্যভাবে কাজ করে যাচ্ছে আরডিআরএস। এছাড়া এটি সরকারি স্বাস্থ্যনীতি অনুসরণ করে প্রতিরোধ এবং নিরাময়মূলক পন্থায় যক্ষা, কুষ্ঠ এবং এইচআইভি/ এইডস-এর বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যক্ষা রোগী চিহ্নিতকরণে সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ৭০% হলেও আরডিআরএস অর্জন করে প্রায় ৭৪%। একইভাবে যক্ষা নিরাময়ের ক্ষেত্রে আরডিআরএস-এর সাফল্য ৯০%।

দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের স্কুলমুখীকরণ, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া রোধকরণ এবং প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে আরডিআরএস শুরু থেকেই স্কুল নিমার্ণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আরডিআরএস প্রায় ১২শত প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে যার প্রায় সবই রেজিষ্ট্রেশন লাভ করেছে ও সরকারিকরণ হয়েছে।  উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিনির্ভর জীবনমান উন্নয়নে আরডিআরএস-এর সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি রয়েছে। আরডিআরএস কৃষক মাঠ স্কুলের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও উচ্চফলনশীল শষ্য উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মঙ্গা নিরসন ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর কৌশল রপ্ত করার জন্য আরডিআরএস-এর একাধিক গবেষণাভিত্তিক  কৃষি,  খাদ্য নিরাপত্তা ও  জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত কর্মসূচি রয়েছে।

আরডিআরএস শুরু থেকেই এ অঞ্চলের মানুষকে রাস্তার ধারে বৃক্ষরোপন ও বসতভিটায় গাছ লাগানোয় উদ্বুদ্ধ করে সামাজিক বনায়নে সহযোগিতা করছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ১৩০টি চরের কষ্টসহিষ্ণু জনগোষ্ঠীর জীবন স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে আরডিআরএস আশির দশক থেকে চর উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে। উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য ২০০১ সালে আরডিআরএস আদিবাসী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। রংপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলায় বসবাসকারী  সাঁওতাল, ওরাও, মশোহর, মাহালী, পাহান, মালো, ঋষি এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দরিদ্র নারী, পুরুষ ও শিশুরা এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত। আরডিআরএস ১১টি জেলার ৫৫টি উপজেলায় ১৫৫ টি শাখা অফিসের মাধ্যমে প্রায় চার লক্ষ দরিদ্র মানুষকে ক্ষুদ্রঋণ সেবা প্রদান করছে। সর্বোপরি আরডিআরএস বন্যা, খরা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, শৈত্যপ্রবাহ ইত্যাদি  প্রাকৃতিক দুর্যোগ-এ বিপর্যস্ত মানুষকে সহায়তা করে আসছে। বর্তমানে আরডিআরএস উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, জামালপুর, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার ৬০টি উপজেলার ৪৬৭ ইউনিয়নের ১৬,৬৬৪ বর্গকিলোমিটার কর্মএলাকার ৪১১,২৪৬টি দরিদ্র পরিবারকে সামাজিক সংগঠন ‘ইউনিয়ন ফেডারেশনের’ মাধ্যমে অবকাঠামো নির্মাণ,  বৃক্ষরোপণ,  দারিদ্র্য দূরীকরণ,  নারী অধিকার ও উন্নয়ন,  স্বাস্থ্য,পুষ্টি ও  পরিবার পরিকল্পনা, ব্যবহারিক, বয়স্ক ও শিশু  শিক্ষা, ক্ষুদ্র  শিল্প, কৃষি, জলবায়ু ও  পরিবেশ রক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, চর উন্নয়ন, আদিবাসী উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কর্মকান্ড চালিয়ে আসছে।

আরডিআরএস বর্তমানে প্রায় ১৮-২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার-এর বার্ষিক বাজেটের মাধ্যমে দেশের চার লক্ষ পরিবারের ১.৯ মিলিয়ন মানুষকে উন্নয়ন সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।  [শামসুল হুদা]