ম্যানরিক, সেবাস্টিয়

ম্যানরিক, সেবাস্টিয়  পর্তুগিজ মিশনারি ও পর্যটক। ১৬২৮ থেকে ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় ষোল বছর ধরে ফ্রে সেবাস্টিয় ম্যানরিক প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে রোম থেকে তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত স্পানিশ ভাষায় Itinerate Rio Dila Missionery Del India Oriental শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯২৬-২৭ খ্রিস্টাব্দে লুয়ার্ড ও হেসটেনের যৌথ সম্পাদনায় লন্ডনের হ্যাকল্যুট সোসাইটি দুই খন্ডে Travels of Fray Sebastien Manrique শিরোনামে তাঁর গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন।

ম্যানরিকের প্রাচ্য ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার এবং বিদেশে অবস্থিত খ্রিস্টান মিশনগুলি পরিদর্শন। অগাস্টান চার্চ তাঁর ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করেছিল। ভারত ভ্রমণকালে ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পর্তুগিজ ক্যাথোলিক চার্চ পরিদর্শনকল্পে ঢাকায় আসেন। প্রায় সাতাশ দিন তিনি ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় অতিবাহিত করেন। তিনি ঢাকা তথা বাংলা সুবাহর যে বিবরণ রেখে গেছেন তা বাংলা ও এর রাজধানীর জনজীবনের চিত্র সম্পর্কে ব্যাপক আলোকপাত করে। তিনি তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে ঢাকা সম্বন্ধে বেশ কিছু আকর্ষণীয় মন্তব্য করেছেন, যদিও ঢাকা তখন মুগল প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে মাত্র তিরিশ বছর অতিবাহিত করেছে। তবে এটা উল্লেখ্য যে, ম্যানরিক যে সময়ে ঢাকা ভ্রমণ করেন সে সময়ে ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী ছিল না। ঠিক পূর্ববর্তী বছরেই সুবাহদার শাহ সুজা ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কারণে রাজধানী ঢাকা থেকে বিহারের রাজমহলে স্থানান্তরিত করেন। ১৬৩৯-১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজমহল রাজধানী হিসেবে অব্যাহত থাকে। এর পর ঢাকা অবশ্য আবার রাজধানীর মর্যাদা ফিরে পায়। তবে এই বিরতি সত্ত্বেও ঢাকা এতদঞ্চলের প্রধান নগর হিসেবে টিকে থাকে এবং এর বৃদ্ধিও ঘটে প্রয়োজন অনুসারেই। ম্যানরিকের বর্ণনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি ঢাকা সম্বন্ধে লিখেছেন-এটিই হচ্ছে বেঙ্গালার প্রধান নগর এবং এখানেই প্রধান নবোব বা ভাইসরয়ের প্রশাসনিক কেন্দ্র। ভাইসরয়গণ সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হন এবং বেশ কয়েকবার শাহজাদাগণও এই দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। বিখ্যাত ও অত্যন্ত ফলপ্রসূ গঙ্গার বিস্তৃত ও সুন্দর সমতল উপত্যকায় ঢাকা অবস্থিত এবং নদীতীরবর্তী নগরটি প্রায় দেড় লিগ (১ লিগ= ৫.৬ কি.মি) পর্যন্ত বিস্তৃত।

ম্যানরিক ঢাকার জনসংখ্যা, সম্পদ ও রাজনৈতিক গুরুত্বের একটি বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে মুগল ঢাকার বৃদ্ধি ও উন্নয়নের ওপর তাঁর বিবরণই সর্বপ্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, নগরটি মানাজোর (মাণেশ্বর) থেকে একদিকে নারানদিউ (নারিন্দা) ও অন্যদিকে পুলগড়ি (ফুলবাড়িয়া) পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার তীর ধরে প্রায় ৩ কি.মি ও অধিক বিস্তৃতি লাভ করেছে, যা নগরটিকে সুসামঞ্জস্য করে তুলেছে। এগুলি ছিল নগরের পশ্চিম, পূর্ব ও উত্তরের শহরতলী যেখানে প্রচুর খ্রিস্টান বসবাস করত। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, এখানে কনভেন্টসহ ছোট কিন্তু সুন্দর একটি চার্চ ছিল।

ম্যানরিক তাঁর বিবরণে বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উপর আলোকপাত করা ছাড়াও বাংলার বিখ্যাত মসলিনের কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি মসলিন সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন এই দেশে সর্বোৎকৃষ্ট মসলিন উৎপাদিত হয়। পঞ্চাশ থেকে ষাট গজ লম্বা ও সাত-আট হাত চওড়া কাপড়গুলির বর্ডার তৈরি করা হতো সোনালী ও রূপালী রেশমে। এগুলি এতই সূক্ষ্ম ছিল যে, ব্যবসায়ীরা মাত্র দুই বিঘত লম্বা বাঁশের চোঙে ভরে নিরাপদে খোরাসান, পারস্য, তুরস্ক ও বিভিন্ন দেশে নিয়ে যেত।

ম্যানরিকের কাছ থেকে বাংলা সম্পর্কে যে বিবরণ পাওয়া যায় তা আসলেই বৈচিত্র্যপূর্ণ ও আকর্ষণীয়। তাঁর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকে কিভাবে  পর্তুগিজরা বাংলায় বাণিজ্যিক সুবিধা পেয়েছিল এবং কিভাবে তারা হুগলিকে তাদের বাণিজ্যিক কেন্দ্রে ও গুরুত্বপূর্ণ পর্তুগিজ কলোনিতে পরিণত করে। ঢাকার ভিতরে এবং এর আশপাশের এলাকায় মগ জলদস্যুদের লুণ্ঠনের ঘটনা এবং কিভাবে ঢাকার সরকার ক্রমাগতভাবে এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তাও তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি বাংলার বারো ভূঁইয়াদের স্ব স্ব রাজ্য ও কর্মতৎপরতারও বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি ঢাকায় আসার কিছুকাল আগেই বারো ভূঁইয়াদের দ্বারা মুগল প্রতিরোধ আন্দোলন সমাপ্ত হয়েছিল।

বাংলার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর ম্যানরিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন এখানে হিন্দু, মুসলিম ও পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ও বণিকগণ বাণিজ্যে সম্পৃক্ত ছিল। বাণিজ্য দ্রব্যগুলির মধ্যে প্রধান ছিল- চাল, রেশম, চিনি, নীল, লাক্ষা, মাখন এবং বিভিন্ন রকম সুতি বস্ত্র। প্রধান আমদানীকৃত দ্রব্যগুলির মধ্য ছিল- মসলা, শঙ্খ, রূপা ও সোনা।

ম্যানরিক নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহের মূল্য তালিকাও দিয়েছেন। যেমন- পাঁচ আনায় এক মন চাল পাওয়া যেত। তিনি এখানকার জনগণের আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যদির পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা দিয়েছেন। বাংলার নারীদের আবেগ পুরুষদের তুলনায় বেশি বলে তিনি বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া বাংলার অধিবাসিগণ অত্যন্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে তিনি লক্ষ করেছেন।

ঢাকার পর ম্যানরিক দিয়াং ও চট্টগ্রামে পর্তুগিজ বসতিগুলিতে ভ্রমনে যান। ১৬৪১ সালে তিনি ভারত ত্যাগ করেন এবং ১৬৪৩ সালের জুলাই মাসে দেশে পৌঁছান।  [শরীফ উদ্দীন আহমেদ]