ম্যাজিস্ট্রেট

ম্যাজিস্ট্রেট  আধুনিক ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বসূরী ছিলেন প্রাক-ব্রিটিশ আমলের ‘আমীল’ ও ‘ফৌজদার’। ১৭৭২ সাল থেকে দেওয়ানি প্রশাসনের অধীনে সীমিত ক্ষমতা দিয়ে ব্রিটিশ আদলে ম্যাজিস্ট্রেট পদ সৃষ্টি করা হয় এবং ১৭৯৩ সালে নবাবের ফৌজদারি বা বিচারিক ক্ষমতা আনুষ্ঠানিকভাবে বিলোপ করা হয়। ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত জেলা  কালেক্টর ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। কর্নওয়ালিস কোডের আওতায় জেলা কালেক্টরের বিচার ক্ষমতা জেলা জজের উপর ন্যস্ত করা হয়। এ জজের অভিধা হয় জেলা জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট। ১৮২৮ সাল থেকে আবার জজের বিচার ক্ষমতা প্রত্যাহার করে তা জেলা কালেক্টরের উপর ন্যস্ত করা হয় এবং এ পদের নামকরণ হয় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট অ্যান্ড কালেক্টর। এ পদমর্যাদা উপনিবেশিক শাসনামলের পরও অব্যাহত ছিল।

বেতনভুক ম্যাজিস্ট্রেট বা অবৈতনিক জজ উভয়েই ছোটখাট ও লঘু অপরাধের ফৌজদারি বিচারকার্য সম্পন্ন করতেন। তারা সংক্ষুদ্ধ কোনো ব্যক্তির লিখিত অভিযোগ বা পুলিশের প্রদত্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অথবা অপরাধ সংঘটনে নিজেদের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কোনো অপরাধ আমলে নিতে পারেন। ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক তদন্ত করার নির্দেশ বা কোনো প্রকার গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ একজন অপরাধীকে গ্রেফতার এবং আমলযোগ্য কোনো অপরাধ তদন্ত করতে পারে। তবে আমলযোগ্য নয় এধরনের কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ তা করতে পারে না। যেসব গুরুতর অপরাধের বিচার ম্যাজিস্ট্রেট করতে পারেন না, সেগুলো সম্পর্কে কতিপয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বিচারের জন্য দায়রা আদালত বা এধরনের অন্য কোনো আদালতে অথবা ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করেন।

মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনরত ম্যাজিস্ট্রেট

ক্ষমতা প্রয়োগের ভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট তিন শ্রেণীতে বিভক্ত, প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট এবং তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট। মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে প্রত্যেক জেলায় একজন ডেপুটি কমিশনার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে, এডিশনাল ডেপুটি কমিশনার এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এবং জয়েন্ট ডেপুটি কমিশনার জয়েন্ট ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এঁরা প্রত্যেকেই প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ভোগ করেন। এঁদের পাশাপাশি মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে প্রত্যেক জেলায় প্রথম শ্রেণী, দ্বিতীয় শ্রেণী বা তৃতীয় শ্রেণীর আরও কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

জেলায় নিয়োগপ্রাপ্ত অন্য সকল ম্যাজিস্ট্রেট কার্যত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে থাকেন যদিও এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং জয়েন্ট ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কার্যত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট অধীনস্থ ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে কার্যবণ্টনও করতে পারেন। একজন প্রথম শ্রেণী বা দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট একটি উপজেলা/থানার দায়িত্বে বহাল থাকেন। এধরনের একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে উপজেলা/থানা ম্যাজিস্ট্রেট বলা হয়। তিনি ঐ থানার যেকোন অংশে সংঘটিত কোনো অপরাধ আমলে নিতে পারেন। সরকার যে-কোন ম্যাজিস্ট্রেটকে অতিরিক্ত ক্ষমতাও প্রদান করতে পারে। মেট্রোপলিটন এলাকার মধ্যে এধরনের এলাকা বা তার যেকোন অংশে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, এডিশনাল চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়। এডিশনাল চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্য সব মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে থাকেন এবং তিনিই অধীনস্থ ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করেন।

সরকার দেশের যেকোন নাগরিককে যেকোন স্থানীয় এলাকার জন্য জাস্টিস অব দি পিস (অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট) নিয়োগ করতে পারে। শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড দানের ক্ষেত্র ব্যতীত সবধরনের অপরাধের বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য সরকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, এডিশনাল চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট অথবা যেকোন এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে এবং মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা দশ বছরের অধিক মেয়াদে কারাবাসের শাস্তিযোগ্য নয় এমন সব অপরাধের বিচারের জন্য যেকোন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটকে ক্ষমতা প্রদান করতে পারে। মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন একটি জেলার প্রধান এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন ওই এলাকার প্রধান প্রশাসক। প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে তারা কিছু অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।

বর্তমানে যেকোন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আইন দ্বারা স্বীকৃত নির্জন কারাবাসসহ অনধিক পাঁচ বছরের কারাদন্ড প্রদান, অনধিক ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং বেত্রাঘাতে দন্ড প্রদান করতে পারেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর যেকোন ম্যাজিস্ট্রেট আইনে স্বীকৃত নির্জন কারাবাসসহ অনধিক তিন বছরের কারাদন্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারেন। কোনো তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অনধিক দুই বছরের কারাদন্ড প্রদান এবং দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারেন। জরিমানার টাকা অনাদায়ে ম্যাজিস্টেট কারাদন্ড মেয়াদকালের অনধিক এক চতুর্থাংশ অতিরিক্ত মেয়াদের কারাদন্ড প্রদান করতে পারেন, যা অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের আওতাধীন। বড় ধরনের অপরাধসমূহের বিচারকার্য সম্পাদনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত একজন ম্যাজিস্ট্রেট সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদন্ড প্রদান করতে পারেন। প্রশাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথককরণের জন্য মাজদার হোসেন মামলার বিচারের রায় কার্যকর করার লক্ষ্যে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ২০০৭ সংশোধন এবং ২০০৭ সালের ১ নভেম্বরে কার্যকর হওয়ার পর প্রশাসনিক সরকারি কর্মকর্তাদের বিচারকার্যে নিয়োজিত করার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে বিচারিক কর্মকর্তাদের এক্তিয়ারে বিচারিক ক্ষমতা অর্পন করা হয়েছে। একজন অতিরিক্ত জেলা জজকে প্রথম শ্রেণীর বিচারিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে এবং তার পদবি করা হয়েছে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। [কাজী এবাদুল হক]