মৌমাছিপালন

মৌমাছিপালন (Apiculture)  উন্নত পদ্ধতিতে মৌমাছির (Apis spp.) লালন-পালন ও মৌচাকের যত্নের মাধ্যমে তাদের তৈরি মধু আহরণ ও সংরক্ষণ। মৌমাছি পালনের মাধ্যমে মধু ও অন্যান্য উপজাতের বাণিজ্যিক উৎপাদন সম্ভব হয়। ফুলের নির্যাস ও পরাগ সংগ্রহকালে মৌমাছি ফসল-উদ্ভিদের পরাগযোগ ঘটায়। এতে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ে। বাংলাদেশে প্রতিবছর মৌমাছি পালকদের উৎপাদিত মধুর কোন পরিসংখ্যান নেই। ষাটটির অধিক কৃষি-ফসলে পরাগযোগ এবং এভাবে ফল ও বীজের ফলন বৃদ্ধির সামর্থ্যের মধ্যেও মৌমাছির গুরুত্ব নিহিত।

বাণিজ্যিক হিসেবে বাংলাদেশে Apis cerana indica সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌমাছি প্রজাতি। অধিকন্তু একটি বন্য প্রজাতিও (Apis dorsata) আছে যেটি বনে, বসতবাড়ির আশেপাশের বড় বড় গাছে, এমনকি দালান-কোঠার কার্নিশেও মৌচাক বানায়। বাংলাদেশের অনেক পেশাদার মধুচাষি মধুর জন্য A. dorsata প্রজাতির মৌচাক খোঁজে। তারা প্রধানত বনাঞ্চল, বিশেষত সুন্দরবন, মধুপুর ও বাংলাদেশের অন্যান্য জঙ্গলের কাছাকাছি বাস করে।

কৃত্রিম মৌবাক্স

বর্তমানে ব্যবহূত বেশির ভাগ মধুই বিশুদ্ধ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে উৎপন্ন। মধু সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় মৌচাকগুলি বিনষ্ট না করে ভবিষ্যতের জন্য সেগুলি সুরক্ষার আবশ্যকতা উপলব্ধি থেকেই সম্ভবত মৌমাছিপালন শুরু হয়েছে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য গৃহপালিত A. c. indica প্রজাতির প্রাকৃতিক বাসার পরিবর্তে বিভিন্ন কৃত্রিম বাসার ব্যবহার বাংলাদেশেও প্রচলিত হয়। এ ধরনের বিকল্প বাসা বা মানুষের তৈরি মৌচাক মৌমাছির ক্ষতি না করে মধু সংগ্রহের সুযোগ তৈরি করে। বাক্সটি ১ সেমি দূরত্বে স্থাপিত কয়েকটি ফ্রেমে গঠিত, যাতে মৌমাছিরা পাশাপাশি দুটি পৃষ্ঠতলকে মোমের বন্ধনী দিয়ে সহজাত প্রবৃত্তিবশে জোড়া না দিয়ে চলাচল করতে পারে। ‘মৌমাছির ফাঁক’ (bee space) ধারণাই বদলিযোগ্য কাঠামোর এই চাক উদ্ভাবনের পথ খুলে দিয়েছে, যাতে মৌমাছির দেখাশোনা এবং অক্ষত চাক থেকে মধু সংগ্রহ দুটিই চলে। এই ধরনের মৌবাক্সের অসংখ্য নকশা বাংলাদেশে পাওয়া যায়। কিন্তু কার্যকারিতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার সমন্বয়ের মাধ্যমে অবশেষে সর্বত্র ব্যবহার্য যে মৌবাক্সটি উদ্ভাবিত হয়েছে তা হলো একটি কাঠের বাক্স, যাতে অনেকগুলি পরিবর্তনযোগ্য কাঠামো থাকে।

মৌমাছি পালকরা সাজসরঞ্জাম এমনভাবে প্রমিত করেছে যাতে যন্ত্রাংশগুলি একই ধরনের মৌমাছিশালার সঙ্গে বিনিয়ম করা যায়।

মধু সংগ্রহ  মৌচাক মধুপূর্ণ হয়ে উঠলে ও সবগুলি মধুকোষ ঢাকনাবদ্ধ হলে সেগুলি বাসা থেকে সরিয়ে এনে মৌমাছিমুক্ত করা হয়। তারপর মধুকোষগুলির মোমের পাতলা ঢাকনি ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে সেগুলি মধুনিষ্কাশক যন্ত্রে রেখে দ্রুতগতিতে ঘুরানো হয়। কেন্দ্রাতিগ বলের প্রভাবে নিষ্কাশকের পাশ-বরাবর মৌচাক থেকে মধু নির্গত হয়। অতঃপর মৌচাকগুলি উলটে দিয়ে অন্য পিঠের মধুও সংগ্রহ করা হয়। মৌমাছি দ্বারা পুনরায় মধুপূর্ণ হওয়ার জন্য সবগুলি আবার মৌবাক্সের যথাস্থানে সন্নিবেশ করা হয়।

বিপণন  বাংলাদেশে ব্যবসাভিত্তিক মৌমাছিপালন এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। কিছু সফল মৌচাষি মধুর উপযুক্ত নির্যাস উৎপাদক উদ্ভিদ প্রধান এলাকায় বাস করে। বাংলাদেশের সর্বোত্তম মধু সরিষা ফুলের মধু। বাংলাদেশের অনেক জেলাতেই সরিষা জন্মে এবং মধু তৈরির জন্য মৌমাছিদের প্রচুর পরিমাণ মিষ্টি নির্যাস যোগায়। সজিনা, কুল, আম, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলের গাছ, অনেক বনজ ও শস্য উদ্ভিদ উত্তম নির্যাস উৎপাদক। প্রত্যেকটি ফুল যেমন রং, গড়ন ও ঘ্রাণের দিক থেকে ভিন্ন, তেমনি প্রত্যেকটি ফুল থেকে পৃথক ধরনের মধু তৈরি হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ থানা পর্যায়ে অনেক সময়ে মৌমাছিপালনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করে। এসব কর্মসূচিতে শুধু মৌমাছি ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ দানই নয়, লাভজনক মধু উৎপাদন নিশ্চিত করতে মৌমাছি পালনের জন্য প্রশিক্ষণার্থীদের মৌবাক্সও সরবরাহ করা হয়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ মৌমাছিপালন ইনস্টিটিউট নিজস্ব অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে পেশাদার ও সৌখিন মৌমাছিপালকদের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। সফল পরাগায়ণ ও মধু উৎপাদনের জন্য শীত মৌসুমে বাংলাদেশের প্রধান সরিষা উৎপাদনকারী এলাকায় তারা ভ্রাম্যমাণ মৌমাছি পালনেরও আয়োজন করে থাকে।

ব্যবস্থাপনা  সফল মৌমাছিপালনের জন্য ব্যবস্থাপনার কয়েকটি দিক বিশেষভাবে বিবেচ্য। কখনও কখনও ঝাঁক বেঁধে মৌচাক ছেড়ে চলে যাবার ফলে মৌমাছির সংখ্যা হ্রাস পায় ও মধু উৎপাদন ব্যাহত হয়। মৌচাকে মৌমাছির অত্যধিক ভীড় ও উচ্চ তাপমাত্রা ব্যাপক সংখ্যক মৌমাছির মৌচাক ত্যাগের অন্যতম কারণ, যেজন্য বাক্সে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল এবং অতিরিক্ত স্থান সংকুলানের ব্যবস্থা করে এই প্রবণতা রোধ করা যায়। মৌসুমের শুরুর দিকে কম বয়সী রানী মৌমাছি এনে রাখলে দলবদ্ধ প্রস্থান রোধ করা যেতে পারে। মৌমাছির মধুর অভাব ঘটলে বিকল্প হিসেবে চিনির সিরাপ (২ ভাগ চিনি ও ১ ভাগ পানি) দেওয়া যায়। ছিদ্রবিশিষ্ট ঢাকনা দেওয়া একটি উল্টানো পাত্রে সিরাপ রাখা ভাল।

আমেরিকান ও ইউরোপীয় ফাউল ব্রুড রোগ বাংলাদেশেও মৌমাছির একটি মারাত্মক ব্যাধি। আমেরিকান ফাউল ব্রুড রোগের কোন সফল চিকিৎসা নেই। রোগাক্রান্ত মৌচাক ও মৌমাছি পুড়িয়ে ফেলাই একমাত্র উপায়। রানী বদলানোর মাধ্যমে দ্রুত কলোনির শক্তিবৃদ্ধি ঘটিয়ে ইউরোপীয় ফাউল ব্রুড প্রতিরোধ করা যায়। পিঁপড়ে ও ওয়াক্স-মথসহ (wax moth) বেশ কিছু কীটপতঙ্গ, পাখি, ইঁদুর ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী প্রায়ই মৌচাকের ক্ষতি করে। মথের লার্ভার আক্রমণ ঠেকানোর জন্য মৌচাককে প্যারা-ডাই-ক্লোরোবেন্জিন বা ইথাইলিন ডাই-ব্রোমাইড দিয়ে ধূমায়িত করা যেতে পারে। পিঁপড়ের ক্ষতি থেকে সংরক্ষণের প্রচলিত পদ্ধতি হলো তেল বা ক্রিওসোট (creosote) রাখা পাত্রে দাঁড় করানো কাঠামোর উপর মৌবাক্সটি স্থাপন করা।  [মোঃ জিন্নাতুল আলম]

আরও দেখুন ভ্রমর; মধু; মৌমাছি