মোমেন, খান বাহাদুর আবদুল

মোমেন, খান বাহাদুর আবদুল (১৮৭৬-১৯৪৬)  বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের সদস্য, বিশ শতকের প্রথম দিকে সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট অপারেশন-এর অন্যতম প্রধান সেটেলমেন্ট অফিসার এবং কৃষক রাজনীতির একজন কর্মী। নওয়াব আবদুল জববারের দ্বিতীয় পুত্র এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিচার বিভাগের প্রধান সদর আমিন আলী আসগরের নাতি আবদুল মোমেন ১৮৭৬ সালের ২৪ জুন বর্ধমান জেলার  কাশীয়ারা গ্রামে (বর্তমানে কাসেমনগর) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮৯৬ সালে  প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন।

১৮৯৭ সালে সিভিল সার্ভিসে সাব ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় এবং ১৯০৬ সালে তিনি ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হন। তিনি চট্টগ্রাম বিভাগের ডিভিশনাল কমিশনার পদে কর্মরত অবস্থায় মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৩০) সংঘটিত হয়। অবসর গ্রহণের পর আবদুল মোমেন ‘কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’-এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। সমসাময়িক মুসলিম শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারেও একজন নিবেদিত কর্মী ছিলেন। তিনি ১৯৩১ সালে গঠিত মুসলিম শিক্ষা কমিশন  কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে এ কমিটি ‘মোমেন কমিশন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এ কমিশনের অন্তর্ভুক্ত অন্য সদস্যরা হলেন আজিজুল হক, তমিজ উদ্দিন খান, খান বাহাদুর আফাজ উদ্দিন আহমেদ এবং আবুল কাসেম (বর্ধমান)।

মুসলিম সম্প্রদায়ের ওয়াকফ ব্যবস্থা সংস্কার ও বিধিবদ্ধ করার ব্যাপারে আবদুল মোমেন ছিলেন একজন বলিষ্ঠ সমর্থক। তাঁর ভাবনা এবং প্রচেষ্টার ফলে ১৯৩৪ সালের ওয়াক্ফ আইন বিধিবদ্ধ হয়। ফলে ১৯৩৬ সালে বেঙ্গল ওয়াক্ফ বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকার তাঁকে খান বাহাদুর এবং সি,আই,ই উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। তিনি আর্যস্থান বীমা কোম্পানি নামে পরিচিত একটি বীমা কোম্পানির তহবিল গঠনে সক্রিয় ভূীমকা পালন করেন। মুসলিম বীমা উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি সূচনাকারীদের মধ্যে অন্যতম একজন।

১৯২৯ সালে আইনজ্ঞ স্যার আবদুর রহিমের সভাপতিত্বে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি গঠিত হয়। সভাপতির সাহায্যকারী পাঁচজন সহ-সভাপতির একজন ছিলেন আবদুল মোমেন। অপর চার সহ-সভাপতি ছিলেন এ.কে ফজলুল হক, ড. আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী, আবদুল করিম ও মুজিবুর রহমান। সমিতির সেক্রেটারি হন আকরম খান।

১৯৩৪ সালে স্যার আব্দুর রহিম ভারতীয় আইন সভার স্পিকার হন। ফলে দিল্লিতে এ পদে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি সমিতির সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। প্রজা সমিতির পরবর্তী সভাপতি কে হবেন- এ প্রশ্নে তৎক্ষণাৎ দলাদলি এবং বিতর্ক শুরু হয়। আবদুল মোমেন এবং এ. কে ফজলুল হক উভয়েই সভাপতি হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সমিতির অনিবার্য ভাঙ্গনরোধে প্রতিনিধিত্বকারী সদস্যবৃন্দ ঐকমত্যে পৌঁছান যে, বিদায়ী সভাপতি যাকে তাঁর পদে স্থলাভিষিক্ত করবেন অন্য সকলে তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন। এর পরেও আবদুর রহিম দলীয় কোন্দল মেটাতে পারেননি। যদিও তিনি খান বাহাদুর আবদুল মোমেনকে মনোনয়ন দিয়ে নিজস্ব মত প্রদান করেন কিন্তু ১৯৩৫ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত প্রজা সমিতির বার্ষিক সম্মিলনী সভায় এ.কে ফজলুল হক উক্ত মনোনয়নকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিজেকে প্রজা সমিতির সভাপতি ঘোষণা করেন।

পেশাগত জীবনে সরকারি উচ্চ পদের চাকুরির শুরু থেকে বাংলায় ভূমি ব্যবস্থা আবদুল মোমেনের বিশেষ আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে এবং উক্ত বিষয়ে তিনি নিজেকে একজন বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তোলেন। ভূমি ব্যবস্থায় গভীর জ্ঞানের কারণে তাঁকে যশোর জেলার ‘সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট এর প্রধান অফিসার পদে নিয়োগদান করা হয়।

আবদুল মোমেন তাঁর Final Report on Survey and Settlement Operations in the Jessore District 1920-1924-এ উক্ত জেলার বিভিন্ন ভূমির প্রজাস্বত্ব এবং অর্থনৈতিক বিষয়াবলির অনুধাবনের ক্ষেত্রে একটি মূল্যবান অবদান রাখেন। তাঁর জরিপ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলির তথ্য  অন্তর্ভুক্ত করে, যেমন- ভূমির স্বত্ব আরোপ, মধ্যস্বত্বভোগী, সকল প্রকার রায়তের অধিকার ও অবস্থা, হাট ও বাজার, জনসংখ্যা, সকল শ্রেণির অর্থব্যবস্থা প্রভৃতি। উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রধান সেটেলমেন্ট অফিসার পদটি ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্য ব্রিটিশদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হতো। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের আবদুল মোমেনের সময়ে। ১৯৪৬ সালের ১৮ জুন তাঁর মৃত্যু হয়।  [বদরুদ্দিন উমর]