মেলা

মেলা  বাংলাদেশের লৌকিক ও জনপ্রিয় উৎসব। এদেশে মেলার উৎপত্তি হয়েছে মূলত গ্রাম-সংস্কৃতি হতে। তবে কবে, কীভাবে এদেশে মেলার উৎপত্তি হয়েছে তা সঠিক করে বলার উপায় নেই। গবেষকদের মতে বাংলায় নানা ধরণের ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠান ও উৎসবের সূত্র ধরেই মেলার উৎপত্তি হয়েছে। সেদিক দিয়ে এদেশের মেলার প্রাচীনত্ব হাজার বছরেরও অধিক পুরানো।

এদেশের প্রাচীন পর্যায়ের উৎসব ও কৃত্যানুষ্ঠানকেন্দ্রিক মেলাগুলির মধ্যে প্রথমেই আসে জীবনধারণের আহার্য কৃষিশস্য এবং বিশেষ করে কৃষির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রোদ ও বৃষ্টির কথা। প্রাচীন বাংলার মানুষ চাঁদ ও সূর্যকে ‘বুড়াবুড়ি’ নামে অভিহিত করেছে এবং এর ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয়েছে ‘বুড়া-বুড়ির মেলা’। উল্লেখ্য, বুড়াবুড়ির মেলাটি পরবর্তীতে সূর্যমেলা, সূর্য ঠাকুরের ব্রত, চৈত্র-সংক্রান্তির ব্রতের মেলা, চড়কমেলা ও শিবের গাজনের মেলায় রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে মেঘের দেবতা বরুণ-বারুণী স্নানের মেলা হিসেবে রূপগ্রহণ করে। একসময় গ্রাম-গঞ্জের সবখানেই বরুণ বা বারুণী স্নানের মেলা বসতো। আবার বারুণী থেকে এর নাম হয়েছে ‘বান্নি’।

মেলায় জনতা

বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রাম-শহর জুড়ে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রচলিত প্রতিটি মেলা আয়োজনের পশ্চাতে কোনো না কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। সেটি হয় ধর্মীয়, নয় ব্রত-পালা-পার্বন বা যেকোনো একটি নির্ধারিত বিষয় বা ঐতিহ্যকে স্মরণ করে। মেলার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে-নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত তারিখ বা তিথিলগ্নে এক একটি মেলাতে নরনারী, শিশুকিশোর এমনকি আবাল বৃদ্ধরাও সমাগম ও সমাবেশ করে থাকে। তবে মেলার বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে-ব্যবহার্য পণ্য ও গৃহ সামগ্রীর বিরাট সমাবেশ এবং চিত্তবিনোদনের জন্যে যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ ইত্যাদির আসর।

আধুনিকতার অভিঘাতে ঐতিহ্যবাহী মেলাসমুহের চারিত্রিক পরিবর্তন হচ্ছে। এদেশের প্রচলিত মেলাগুলির প্রকৃতি নানা ধরণের। একবাক্যে তার প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণীকরণ দুঃসাধ্য। পূর্বে মেলার প্রায় সর্বাংশই ছিল গ্রামকেন্দ্রিক, যুগের পরিবর্তনে ধীরে ধীরে সেই চিত্র পাল্টে গিয়ে এদেশের মেলা বর্তমানে গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই ছড়িয়ে পড়েছে। চারিত্র্য বিচারে এদেশে প্রচলিত মেলাসমূহকে মোটামুটি সাতটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যেতে পারে-১. ধর্মীয় উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ২. কৃষি উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ৩. ঋতুভিত্তিক মেলা, ৪. সাধু-সন্তের ওরশ উপলক্ষে ফকিরী মেলা ৫. জাতীয় জীবনের বিভিন্ন বরেণ্য ব্যক্তি যেমন, কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক প্রমুখবিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের স্মরণোৎসব উপলক্ষে স্মারক মেলা, ৬. জাতীয় দিবসসমূহ উদ্যাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক মেলা, ৭. বাণিজ্যিক সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় মেলা। উল্লেখ্য, যেসব মেলার ঐতিহ্য বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচলিত আছে এশ্রেণীবিন্যাসে কেবল সেসব মেলাগুলিকেই বিবেচনায় আনা হয়েছে। তবে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মেলাসমূহের এরূপ শ্রেণীবিভাগ পুনর্বিন্যস্ত হতে পারে।

অধিকাংশ মেলাই ধর্মীয় উপলক্ষে প্রবর্তিত। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং আদিবাসী মিলে এদেশে বসবাসরত সব সম্প্রদায়ই তাদের নিজস্ব ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠান উপলক্ষে উৎসব ও মেলার আয়োজন করে থাকেন। সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা, শিবপূজা, কালীপূজা, রথযাত্রা, স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা, জন্মাষ্টমী ইত্যাদি উপলক্ষে মেলা বসে থাকে।

সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পার্বন ও ধর্মীয় অনুষঙ্গে অনুষ্ঠিত মেলার মধ্যে রথের মেলা সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী। একটি জরিপে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রা উপলক্ষে প্রায় ৬২টির মতো মেলা বসে। তারমধ্যে ঢাকার ধামরাইয়ের রথের মেলাটি অনেক প্রাচীন ও জাকালো। কুষ্টিয়া শহরে অনুষ্ঠিত রথের মেলাটিও তেমনি।

খেলনা পণ্য

এছাড়া বাগেরহাটের লাউপালা গ্রামে পনেরো দিনব্যাপী দীর্ঘস্থহায়ী রথের মেলা বসে থাকে। এত দীর্ঘায়িত হবার কারণ বাণিজ্য। সনাতন ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয়া দুর্গোৎসবকে উপলক্ষ করেই ৭৩টির অধিক মেলা বসে থাকে। সর্বজনীন দুর্গাপূজা সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ও বর্ণাঢ্য ধর্মীয় উৎসব। ফলে দুর্গোৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলাগুলো ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। সনাতন ধর্ম-দেবতা জগন্নাথ দেবের স্নান উপলক্ষে চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় যেসব মেলার আয়োজন হয়, সেগুলোও যথেষ্ট প্রাচীন ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। একমাত্র লাঙ্গলবন্দে অনুষ্ঠিত স্নান-মেলাটির ঐতিহ্য ও আয়োজন সবচেয়ে সমৃদ্ধ।

মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎসবকেন্দ্রিক মেলার মধ্যে মহররমের মেলাগুলিই অধিক বর্ণাঢ্য। শিয়া মতবাদী মুসলিমগণ কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকে স্মরণ করে শোভাযাত্রা বা তাজিয়া মিছিল বের করেন এবং বিভিন্ন ধরণের কৃত্যাচার পালনের সঙ্গে সঙ্গে কোথাও কোথাও জারিগানের আসরও করে থাকেন। মহররমের মেলার ঐতিহ্যের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। এদেশের মুসলিমদের অন্যান্য মেলার মধ্যে থাকে দুই ঈদ, ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা। এ দুই উপলক্ষের মেলার সংখ্যা যথাক্রমে ১৫ ও ১৬টি। উনিশ শতকের শেষের দিকে ঢাকার ধানমন্ডির ঈদগাহে ঈদের নামাজের পর মেলার আয়োজন করা হতো। অবশ্য পরে বিশ শতকের প্রথম থেকেই ঢাকায় নিয়মিত ঈদের মেলা বসতো চকবাজার আর রমনা ময়দানে। পুরানো ঢাকার হোসেনী দালান প্রাঙ্গণে এবং আজিমপুরের মহররমের মেলার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। এছাড়া মানিকগঞ্জের গড়পাড়ার মেলা ও কুষ্টিয়ার চক-দৌলতপুরের মহররমের মেলার কথা উল্লেখ করা যায়।

হস্তশিল্প সামগ্রী

মুসলিম সম্প্রদায়ের উৎসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত মেলার সূত্র ধরে বৌদ্ধধর্মের অনুষঙ্গে যুক্ত মেলার কথা আসে। বৌদ্ধধর্মের মেলাগুলোর মূল অনুষ্ঠান বৌদ্ধ পূর্ণিমার সঙ্গে যুক্ত। জানা যায়, ‘যেমন, চট্টগ্রামের বিজুড়ি গ্রামের আশ্বিনী পূর্ণিমায় বসে তিন দিনের মেলা কুমিল্লার বড়ইয়াতে মাঘী পূর্ণিমায় একদিনের। সবচেয়ে বড়টি মহামুনির, যার স্থিহতিকাল সারা বোশেখ মাস।’

খ্রিস্ট-ধর্মীয় মেলার সংখ্যা অতি নগণ্য। কেবলমাত্র বড়দিন উপলক্ষ্যেই দু’এক জায়গায় খ্রিস্টানদের মেলা বসে। গাজীপুরের কালীগঞ্জে এ ধরনের মেলা প্রতিবছরই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।তবে খ্রিস্টানদের মেলার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হচ্ছে গোপালগঞ্জের মকসুদপুর থানার অন্তর্গত কালীগ্রামের মেলা।

এ মেলাটি প্রায় শতবর্ষের পুরানো। সাতদিন ধরে প্রায় ১৪-১৫ বিঘা জমিতে এ মেলা চলে থাকে।

এদেশের অধিকাংশ কৃষি উপলক্ষের মেলা অনুষ্ঠানের ঐতিহ্যের সঙ্গে লোকধর্মীয় কৃত্যের যোগ থাকে; যেমন, গৌষ্ঠ মেলা, কার্তিক মেলা, পৌষ-মেলা, চৈত্র-সংক্রান্তির মেলা। কৃষি মেলার অন্য কয়েকটি রূপ আছে। যেমন আদিবাসী সম্প্রদায়ের কৃত্যানুষ্ঠান ও উৎসবের মধ্যে, কৃষিকেন্দ্রিক কৃত্যানুষ্ঠানের সূত্রে এদেশের আদিবাসীরা প্রতিবছর বিজু, বৈজু বা বৈজু উৎসব-মেলা এবং কারামপূজা উপলক্ষে একটি বিশেষ কৃষিভিত্তিক উৎসব ও মেলার আয়োজন করে থাকে। এধরনের মেলা ও উৎসবের আয়োজন স্থান হচ্ছে- বাংলাদেশের বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ও বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চল।

কিছু মেলা আছে যা ঋতুভিত্তিক। যেমন-বসন্তবরণ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বসন্ত-উৎসব ও মেলা, বর্ষবরণ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বৈশাখী মেলা ইত্যাদি। বাংলা বর্ষবরণ বা নববর্ষ উপলক্ষে বৈশাখী মেলার চল এদেশে বেশ পুরানো। সম্প্রতি এদেশের নাগরিক জীবনের চাহিদার প্রতি লক্ষ রেখে ‘ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থহা’, ‘পর্যটন কর্পোরেশন’, ‘বাংলা একাডেমী’ এবং ‘লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে’র পরিকল্পিত আয়োজনে বৈশাখী মেলা নতুনমাত্রা পেয়েছে। এখন বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শহরেই বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়ে থাকে।

বিভিন্ন সাধু-সন্ত প্রবর্তিত ওরশ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে থাকে। ওরশ উপলক্ষে সারাদেশেই অসংখ্য ছোট-বড় মেলা বসে। এরমধ্যে সাধু-ফকির প্রবর্তিত বিভিন্ন মেলার মধ্যে লালন সাঁইয়ের আখড়াতে অনুষ্ঠিত দোলপূর্ণিমার ওরশ-মেলা, গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দির হরিঠাকুরের মেলা, সানাল শাহ ফকিরের মেলা, বগুড়ার মহাস্থহানগরের শাহ সুলতানের মেলা, চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারের মেলা, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরীর মেলা, নরসিংদীর বাউল ঠাকুরের মেলা, ফরিদপুরের সুরেশ্বরের মেলা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

জাতীয় জীবনে উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন বরেণ্য ব্যক্তি, কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিকের স্মরণে নিয়মিতভাবে স্মরণোৎসব অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই উপলক্ষেও মেলা বসে। এধরণের স্মারক মেলা সাধারণের কাছে খুবই জনপ্রিয়। খ্যাতিপ্রিয় লেখক-কবির আবির্ভাব বা তিরোধান বার্ষিকীতে উৎসব-অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গী হয়ে এসব মেলার জন্ম। ছেঁউড়িয়ার লালন মেলা, সুনামগঞ্জের হাসনমেলা, শিলাইদহের রবীন্দ্রমেলা, দরিরামপুরের নজরুলমেলা, অম্বিকাপুরের জসীমমেলা, সাগরদাঁড়ির মধুমেলার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়।

মিষ্টান্ন

জাতীয় দিবসসমূহ উদ্যাপন উপলক্ষে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেমন- একুশে ফেব্রুয়ারি, স্ব^াধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস। এই সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এদেশে নিয়মিতভাবে বইমেলারও আয়োজন হয়। এসব সাংস্কৃতিক মেলার স্থহান মূলত শহর এলাকা, তবে সম্প্রতি এ ধারা কিছু কিছু জেলা শহর ও বিভাগীয় শহরে বিস্তৃতি লাভ করেছে। একুশে বা বিজয় দিবসের মেলার পরিকল্পনা অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক কালের। বাংলা একাডেমীর বইমেলাকে কেন্দ্র করে একুশের বইমেলা পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়ে ক্রমশ ঐতিহ্যের পথে অগ্রসরমান। বইমেলা এখন রাজধানী থেকে দূর মফস্বল শহরেও প্রসারিত। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে জাতীয় পর্যায়ের পাশাপাশি মফস্বল ভ্রাম্যমাণ বইমেলার আয়োজনও হয়ে থাকে। জাতীয় দিবস উপলক্ষেও মেলার প্রচলন হচ্ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে প্রবর্তিত হয়েছে বিজয়মেলা।

মেলার সাম্প্রতিককালের সংযোগ হচ্ছে বাণিজ্যিক সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় মেলা। এদেশে বাণিজ্যিক প্রদর্শনীর মেলা মূলত বিদেশী আদর্শ ও অভিজ্ঞতার ফসল, আর এ বাণিজ্যিক প্রদর্শনীর মেলাগুলো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে শহরে। উল্লেখ্য, বাণিজ্যিক মেলার জন্মও হয়েছে শহুরে নাগরিক মাটিতে। বাণিজ্যিক প্রদর্শনী মেলার সূচনা কলকাতায় হলেও অল্প দিনের মধ্যেই মফস্বলেও এর ঢেউ লাগতে থাকে এবং এ কৃষিপণ্য ও শিল্প প্রদর্শনীর মেলা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। প্রতি বছর বিভিন্ন জেলা বা মহকুমা শহরে এ মেলার আয়োজনের প্রতি প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানও যুক্ত হয়। কিন্তু কালের খেয়ালে নানা কারণে বাংলার ঐতিহ্যবাহী সেই কৃষিপণ্য বা শিল্প প্রদর্শনীর মেলা বিলুপ্ত হতে থাকে। বর্তমানে বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়মিতভাবেই ঢাকার শেরেবাংলা নগরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ও রফতানি মেলা অনুষ্ঠিত  হয়ে থাকে। উল্লেখ্য এ মেলাটিই বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রদর্শনী ও বাণিজ্যিক-পণ্য বিক্রয়ের সবচেয়ে বৃহৎ বৈচিত্র্যমন্ডিত ও আড়ম্বরপূর্ণ মেলা। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে ঢাকায় প্রায় নিয়মিতভাবে বাণিজ্যিক পণ্যের বহুবিধ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, এসব মেলার কোনো কোনোটার নাম হয়-কুটিরশিল্প মেলা, তাঁতবস্ত্র মেলা, শিল্পমেলা, বস্ত্রমেলা ইত্যাদি। এসব মেলার আয়োজকগণ হয়ে থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের সংগঠন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক বা সামাজিক ব্যক্তিত্ব। এ ধরণের মেলাতে গৃহ-সামগ্রী বা পোশাক সামগ্রী কিনতে শহরবাসী নরনারী ও শিশুদের ভিড় দেখা যায়।

নাগরদোলা

অনিবার্যভাবেই মেলায় থাকে বিনোদনের ব্যবস্থা। যেমন- নাগরদোলা, পুতুলনাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, যাত্রা, বাউল-ফকির বা কবিগান, বায়োস্কোপ, লাঠিখেলা, কুস্তি, জারিগান ইত্যাদি। তাছাড়া মেলার আয়োজনকে মাতিয়ে রাখে সঙ-কŠতুকের দল, তারা স্বাধীনভাবে মেলাতে ঘুরে ঘুরে রঙ্গ করে থাকে। মেলায় বিশেষ ব্যবস্থহাপনায় থাকে তাড়ি-মদ আর জুয়ার আসর। অনেকেই নেশায় ডুবে এবং জুয়া খেলায় সর্বস্ব হারিয়ে থাকে। এটা মেলার একটি প্রাত্যহিক চিত্র।

সম্প্রতি অধিকাংশ গ্রামীণ মেলাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এদেশের গ্রামে এখন বিজলিবাতি পৌঁছেছে এবং এদেশের গ্রামীণ মেলার স্বাভাবিক ও সাধারণ চিত্র কুটির শিল্পজাত গ্রামীণ পণ্যের বদলে দেশী-বিদেশী বাহারি পণ্যের জৌলূস ছড়িয়ে পড়েছে।

বৈশাখ প্রধানত মেলার মাস। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এ মেলা ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাঙালির মেলা। অন্যান্য মেলার মতো বৈশাখী মেলারও রয়েছে দুটো দিক। একটি বাণিজ্যিক আর একটি সাংস্কৃতিক। ব্যবসায়ীরা ‘চৈত্রসংক্রান্তি’তে এবং বৈশাখের প্রথম দিনে ‘হালখাতা’ করে থাকে। ‘চৈত্রসংক্রান্তি’র দিনটা পালন করা হয় পুরানো বছরকে উৎসবের মাধ্যমে বিদায় দেওয়ার লক্ষ্যে। আর সে উপলক্ষে দেশের সর্বত্র জমে ওঠে বৈশাখী মেলা।

এ মেলার গান-বাজনা আর খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনের মধ্য দিয়ে এক আনন্দঘন পরিবেশে বাংলার একটা বছর বিদায় নেয় এবং নতুন একটা বছরের সূচনা হয়। এদেশে বৈশাখী মেলার সূচনা হয় চৈত্রের শেষের দিক থেকে। তবে বৈশাখের প্রথম দিনটিই আসলে উৎসবের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সবাই পরিষ্কার ও সুন্দর জামা-কাপড় পরে। ঘরে ঘরে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। আর ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ছুটে যায় মেলাতে

গ্রামে-গঞ্জে কৃষক, কামার, কুমার, তাঁতি, ময়রা এবং শিল্পী-কারিগরেরা যেসব সামগ্রী তৈরি করে, বৈশাখী মেলায় তা প্রদর্শন ও বিক্রি করার সুযোগ এনে দেয়। গ্রামীণ কৃষিজাত পণ্য, মিষ্টান্ন দ্রব্য, কুটির শিল্পজাত পণ্য, মাটি ও বেতের তৈরি শিল্পসামগ্রী প্রভৃতি নিয়ে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা দোকান সাজায় এ মেলায়। বাঁশ ও তালপাতার রঙিন বাঁশি, ভেঁপু, একতারা, দোতারা, ডুগডুগি, বেলুন, লাটিম, মার্বেল, ঘুড়ি-লাটাই, চরকি, পুতুল, মাটির ঘোড়া, কাঠের ঘোড়া, কাঠ, কাগজ ও বাঁশের পাখি, মাটির হাড়ি-বাসন, কলস, কাচের চুরি, পুঁতির মালা ইত্যাদি জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে ছোট ছোট দোকানিরা। এছাড়া আছে কাঠের আসবাবপত্র, খাট, পালঙ্ক, চৌকি, চেয়ার-টেবিল, আলনা, আলমারি, ঢেঁকি, পিঁড়ি, গাড়ির চাকা প্রভৃতি। মেলায় আরও পাওয়া যায় পিতলের হাড়ি, কলস, বাসন-কোসন, লাঙল-জোয়াল, লোহার দা, বটি, কুড়ুল, খন্তা, কাচি, নিড়ানি, গরুর গলার ঘুঙুর। ময়রারা তৈরি করে নানা রকমের মিষ্টান্নদ্রব্য-কদমা, জিলিপি, বাতাসা, খাজা, ছাঁচের মিঠাই, দিল্লির লাড্ডু, মটরভাজা, তিলের খাজা খাগড়াই আরো অনেক কিছু।

বৈশাখী মেলার আরেক আকর্ষণ হচ্ছে তাঁতবস্ত্র। এই মেলাতে তাঁতিরা নিয়ে আসে নক্সীপাড়ের শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি, গামছা, বিছানার চাদর প্রভৃতি। মেলার একপাশে ছেলেমেয়েদের জন্য তৈরি জামা-কাপড়ও পাওয়া যায়। স্যাকরার দোকানে মেয়েরা ভীড় জমায় রূপা, তামা ও পিতলের গহনা কিনতে। বৈশাখী মেলায় গ্রামের কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের উন্নত জীবন গঠনের উপযোগী কিছু শিক্ষামূলক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকে। এরমধ্যে রয়েছে-পশু প্রদর্শনী, চরকায় সুতা কাটা, গালার কারিগরি, গাছের চারা বা নার্সারি এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক প্রদর্শনী। গ্রামের মেয়েদের তৈরি নানাপ্রকার পাখা, মাদুর, কাঁথা, শিকে, বেত ও বাঁশের তৈরি হরেক রকম জিনিসপত্র সাজানো হয়। আর থাকে উন্নত ধরনের শাক-সবজি, উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, শস্যের বীজ প্রদর্শনী ও কেনার ব্যবস্থা।

যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মেলার যে রীতি ও ধরণ আমাদের দেশে চালু রয়েছে, বৈশাখী মেলা তার সবটাই ধারণ করে আছে। যেমন- ১. বহু মানুষের সমাবেশ, ২. গানবাজনাসহ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, ৩. গ্রামীণ ব্যবহারিক শিল্পসামগ্রীর প্রদর্শনী ও বিক্রয়, ৪. বিভিন্ন রকমের খেলার আয়োজন।

পালাগান, বাউলগান, যাত্রা, কবিগান, গম্ভীরা, আলকাপ, জারিগান, পুতুলনাচ, সার্কাস প্রভৃতি বৈশাখী মেলার প্রধানতম সাংস্কৃতিক দিক। দেশজ খেলাধূলা মানুষকে অনাবিল আনন্দ দিয়ে থাকে তার প্রমাণ মেলে বৈশাখী মেলায়। লাঠিখেলা, কুস্তি, হা-ডু-ডু, ঘুড়ি ওড়ানো, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড়, মোরগের লড়াই, বানরের খেলা ইত্যাদি সনাতন খেলা সবাইকে আনন্দ জোগায়। বৈশাখী মেলা একদিনেই শেষ হয় না। একদিন, তিনদিন, সাতদিন, পক্ষকাল, পুরো মাস আবার কোথাওবা দুই মাসব্যাপীও বৈশাখী মেলা চলে। দেশের প্রায় সব জেলাতেই বৈশাখ থেকে শুরু করে মাসব্যাপী বৈশাখী মেলা চলতে থাকে।

কুমিল্লা জেলার বৈশাখী মেলার মধ্যে সিদলাই, কান্দুঘর, ময়নামতি এবং ব্রাহ্মণপাড়ার চান্দনা গ্রামের বৈশাখীমেলাগুলোর প্রসিদ্ধি বেশি। এসব মেলার আড়ম্বর, জাঁকজমক দেশের অন্যান্য মেলার চেয়ে একটু বেশি থাকে। কারণ যাত্রা, সার্কাসের ব্যবস্থার সঙ্গে কাঠের সামগ্রী, মৃৎশিল্প, বাঁশ-বেতের বৈচিত্র্যময় গৃহসামগ্রীর উপস্থিতি ছাপিয়ে এ মেলাগুলোতে থাকে হরেক রকম মিষ্টির দোকান। মিষ্টির এমন সমাবেশ বাংলাদেশের অন্যান্য মেলাতে দেখা যায় না।

ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার ভাদুঘর, গোকর্ণঘাট, নবীনগর ও খড়মপুরের বৈশাখী মেলাতে বিশেষভাবে পুতুলনাচের আয়োজন হয় একটু বেশি। কারণ এ জেলাতেই বাংলাদেশের সর্বাধিক পুতুল নাচিয়ের উপস্থিতি বর্তমান। এছাড়া, সার্কাসের আয়োজন থাকে ব্রাহ্মণবাড়ির বৈশাখীমেলাগুলোতে।

উত্তরবঙ্গের উল্লেখযোগ্য বৈশাখী মেলার মধ্যে রয়েছে দিনাজপুরের আমবাড়ির মেলা, বগুড়ার গাঙনগরমেলা। উত্তরবঙ্গের এ মেলাগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে-নানান রকম কাঠের আসবাবপত্রের বেচাকেনা। এছাড়া মাটির পুতুল-হাড়ি-পাতিলের বিশাল সমাবেশ ঘটে, শিশুদের জন্যে থাকে খৈ, মুড়ি আর মৌসুমী ফলের সমাহার।

খুলনা বিভাগের বৈশাখী মেলার মধ্যে যশোরের নিশিনাথ তলার মেলা, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা-বিত্তিপাড়ার ঘোড়াপীরের মেলার নাম উল্লেখ করা যায়। আর বরিশাল বিভাগের মধ্যে বাকালের বৈশাখীমেলা উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা বৈশাখী মেলার একটি সমৃদ্ধ এলাকা শুধু নয় এ জেলার বৈশাখীমেলা দেশের অন্যান্য বৈশাখীমেলা থেকে বেশ স্বতন্ত্র। চট্টগ্রামের বাঙালিদের বৈশাখীমেলার অন্যতম একটি পর্ব হচ্ছে-‘জববারের বলীখেলা’। একদিনের এ বলীখেলা উপভোগ করতে সমবেত হয় অসংখ্য মানুষ। এছাড়া, চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা চৈত্রের শেষে আয়োজন করে ‘মহামুনির মেলা’। এ মেলা বর্ষবরণেরই অংশ। চট্টগ্রামের আদিবাসী মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসব সাংগ্রাই, বিজু বা বিষু পরিচিত নামে। এসব উৎসব উপলক্ষে পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীদের বৈশাখীমেলা বেশ জমে ওঠে।

মুহররমের মেলা  কারবালা প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসেন (রা.)-এর শহীদ হবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহরম মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে এদেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় উৎসবভিত্তিক এ মেলাটি বসে। এখানে সুন্নি মুসলমানরা সংখ্যায় বেশি আর শিয়া মুসলমানরা সংখ্যায় কম। ‘মহরম’ বিশেষত শিয়া মুসলমানদের পালনীয় একটি অনুষ্ঠান। কিন্তু শিয়াদের এ অনুষ্ঠানে দেশের সুন্নি মুসলমানরাও অংশ নিয়ে থাকে। কারণ মুহররমের ঘটনার সঙ্গে হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর পরিবারের সদস্যরা জড়িত। এ মহরম মাসের ১০ তারিখ আশুরার দিন হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর সর্বশেষ দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.) ইরাকের কারবালা প্রান্তরের ইয়াজিদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শাহাদতবরণ করেন। এজন্যে প্রতিবছর মহরম মাস এলেই শিয়াদের সঙ্গে সুন্নি মুসলমানরাও নবীর বংশ ধ্বংস হবার শোকে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। মহরমের ঘটনা যদিও শোক-বিষাদের, বর্তমানে উৎসবে পরিণত হয়ে সার্বজনীন রূপ পেয়েছে।

ঢাকায় মহরম পর্বের সূচনা করেন মুঘল শাসন আমলে শিয়া মতবাদী ক্ষমতাসীন রাজকর্মচারীরা। সে সময় ঢাকাতে শিয়াদের আধিপত্য ছিল। ঢাকার মহরমের অনুষ্ঠান ও মেলার প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে বক্শিবাজার এলাকায় অবস্থিত প্রাচীন ইমামবাড়ি হোসেনী দালান। প্রতিবছর এ হোসেনী দালান চত্বর এলাকাসহ ফরাসগঞ্জ, আজিমপুর জুড়ে মহরম উপলক্ষে বিশাল মেলা বসে থাকে। অতীতে এ মেলা আজিমপুর কবরস্থান এবং নিউমার্কেট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। জানা যায় ১৮৬৪ সালের দিকে মহরমের সময় হোসেনী দালানের চারদিকে একটি বাজার বসতো ১০ মহরম পর্যন্ত এ বাজার চলতো এবং দিন-রাত কেনাবেচা হতো মেলায় বিভিন্ন কারুপণ্য, সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, প্রসাধন সামগ্রী, দা-খুন্তি, বাঁশি থেকে শুরু করে মুড়ি, মুড়্লি, শির্নি, তবারক ইত্যাদি খাবার-দাবারসহ বিবিধ পণ্য কেনাবেচা হয়। কাঠ ও পাত্লা টিনের তৈরি ছোট খেলনা ঢাল-তলোয়ার এ মেলার আরেকটি বৈচিত্র। টিনের পাতের উপর আরবি অক্ষর লেখা এ খেলনা তলোয়ার ধরে রেখেছে কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধের চিহ্নকে।

ঢাকা ছাড়াও মহরমের মেলার আরেকটি সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী এলাকা হচ্ছে মানিকগঞ্জ। এ অঞ্চলের আলীনগরের ‘গড়পাড় এমামবাড়ি’ এবং পশ্চিম হাসলী গ্রামের ‘‘বরকত মা’র থল’’-কে কেন্দ্র করে প্রতি বছর মহরম অনুষ্ঠান ও মেলা বসে থাকে। এ দুটি স্থানে সাধারণত মুহররমের চাঁদ উঠার দিন থেকে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে এবং তা চলে টানা ১০দিন পর্যন্ত। গড়পাড়া এমামবাড়ির মহরমের তাজিয়া মিছিলসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের পাশেই বিশাল এলাকা জুড়ে মেলা বসে। মেলায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার লোক সমাগম হয়। এক হাজারের বেশি দোকানী এখানে বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে। এসব পণ্যের মধ্যে কারুপণ্যের দোকান বেশি। মেলায় রাজশাহী, পাবনা, টাঙ্গাইল প্রভৃতি এলাকা থেকে বাঁশ, বেত, কাঠ, কাগজের তৈরি জিনিস-পত্র, মন্ডা-মিঠাই ইত্যাদি আসে।

মুহররমের অনুষ্ঠান ও মেলার আরেকটি সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী এলাকা হচ্ছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের অষ্টগ্রাম। অষ্টগ্রামের একসময়ের জমিদারবাড়ি বা দেওয়ান বাড়ির বর্তমান নাম ‘হাবলী বাড়ি’। হাবলী বাড়ি আবার আঞ্চলিকভাবে ‘হাওলী বাড়ি’ নামে পরিচিত। এ ‘হাওলী বাড়ি’কে কেন্দ্র করে সমগ্র অষ্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মহরম অনুষ্ঠানটি খুবই জাঁকজমকভাবে পালিত হয়। মহরমের চাঁদ দেখার পরের দিন থেকে শুরু করে আশুরার পূর্বদিন পর্যন্ত সমগ্র অষ্টগ্রামে মহরমের অনুষ্ঠানের আয়োজন চলে। এ সবের মধ্যে তাবুত, তাজিয়া ও বোরাক তৈরি, জারিগান পরিবেশন, শিরনি বিতরণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ আয়োজনের পাশাপাশি বসে বিশাল একটি মেলা। এ মেলাতে স্থানীয়ভাবে তৈরি নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের পাশাপাশি থাকে শিশুদের খেলনা পুতুল, সখের হাড়ি, চরকি, সখের বাড়ি, কাগজের ফুল, প্ল্যাস্টিকের পুতুল ইত্যাদি।

মুহররমের মেলা ও অনুষ্ঠানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হবিগঞ্জ। এ জেলার সদর থানা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে কয়েক কিলোমিটার সামনে দিয়ে একটি নদী প্রবাহিত হয়ে গেছে। এই নদীর অপর পাড়ের একটি গ্রামের নাম ‘সুরাবই’। এ সুরাবই গ্রামের একটি বাড়ি ‘সাহেব বাড়ি’ নামে পরিচিত। জনশ্রুতি আছে স্মরণাতীত কাল থেকেই সুরাবই গ্রামের ‘সাহেব বাড়ি’তে প্রতিবছর আনুষ্ঠানিকভাবে মহরম পর্বে বিবিধ অনুষ্ঠান ও মেলা উদ্যাপিত হয়ে আসছে। এছাড়া হবিগঞ্জ জেলারই অন্য একটি গ্রাম ‘সুলতানশী’। এক সময়ের বিচ্ছিন্ন জনপদ এ সুলতানশীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মহাকবি সৈয়দ সুলতান (রা.)। তাঁর নামেই এর নামকরণ করা হয় ‘সুলতানশী’। এ ‘সুলতানশী’ গ্রামের মহরম অনুষ্ঠান ও মেলা এখন ওই এলাকার সবচেয়ে বড় একটি উৎসব হয়ে আছে।

উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে রংপুর, নীলফামারী ও সৈয়দপুরে খুবই আড়ম্বরপূর্ণভাবে মহরমের অনুষ্ঠান ও মেলা চলে। এ এলাকাতে সাধারণত মহরম মাসের ৩ তারিখ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত মেলা বসে থাকে। এছাড়া রাজশাহী জেলার মোহনপুর এলাকার ‘নওনগর-জাহানিবাদ’ নামক স্থানে মুহররমের চাঁদ দেখার পর থেকে অনুষ্ঠানমালার প্রস্ত্ততি চললেও মেলা চলে মুহররমের মাসের ৮ তারিখ থেকে শুরু হয়ে ১৪ তারিখ পর্যন্ত। বাংলাদেশের অপর একটি জেলা কুষ্টিয়ার ‘চক্ দৌলতপুর’ গ্রামে মহরমের অনুষ্ঠান ও মেলা বসে। এসব মেলাতে মৃৎশিল্পের যাবতীয় সরঞ্জাম, শিশুতোষ খেলনা, সখের হাড়ি, সখের বাঁশি ও প্লাস্টিকের সামগ্রীর সমাবেশ ঘটে এবং কৃত্যমূলক অনুষ্ঠান হিসেবে কারবালার মার্শিয়া, জারীগান ও শোকমিছিল হয়ে থাকে।

অষ্টমীস্নান বা পুণ্যস্নান মেলা সাধারণত চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী বা অশোকাষ্টমী তিথিতে পুণ্যস্নান শাস্ত্রমতে নির্ধারিত। এ সময় লাঙ্গলবন্দে সনাতন ধর্মাবলম্বী কয়েক লাখ পুণ্যার্থীর আগমন ঘটে এবং তারা এ তীর্থস্থান আদি ব্রহ্মপুত্রনদে নেমে ‘হে মহাভাগ ব্রহ্মপুত্র, হে লোহিত্য, তুমি আমার পাপ হরণ করো’ এ মন্ত্র উচ্চারণ করে নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী ফুল, বেলপাতা, ধান, দূর্বা, হরীতকী, ডাব, আমের পল্বব প্রভৃতি সহযোগে পাপমুক্ত হওয়ার বাসনায় পুণ্যস্নান করে থাকে। এ স্নান উপলক্ষে লাঙ্গলবন্দের আদিব্রহ্মপুত্র নদী তীরে সেখানকার ঐতিহ্যবাহী বাসন্তী মেলা বসে। এ মেলার ক্রেতা-ভোক্তাগণ হচ্ছে- বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মায়ানমার থেকে আগত কয়েক লাখ পুণ্যার্থী। লাঙ্গলবন্দের আদি ব্রহ্মপুত্রনদের তীর ধরে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে যে বর্ণিল মেলা জমে ওঠে তার পাশেই বসে সারা দেশ থেকে আগত সাধু-সন্ন্যাসীদের আস্তানা। সাধু সন্ন্যাসীদের আস্তানা ভক্তদের আনন্দে দিলেও মেলার প্রকৃত অলঙ্কার ওঠে দেশী-বিদেশী বিচিত্র সব সখের সামগ্রীর পসরা, যেমন- কাঠের সো-পিস, মাটি-কাঠ-ঝিনুক দিয়ে তৈরি মেয়েদের গহনা, হাতের শাখা, ব্রেসটেল, নকশি জুতা-স্যান্ডেল। এর বাইরে পুণ্যার্থীদের পূজার উপকরণ ও বাহারি খাবারের দোকান তো আছেই, সেখানে দেশী খাবারের সমাহারের সঙ্গে থাকে মিঠাই-মন্ডা, জিলাপি, কদমা, ছাঁচখাজা, রসোগোল্লা, কালোজাম, বুনদিয়া, খাগড়াই ইত্যাদির আয়োজন। দেশ-বিদেশের পূণ্যার্থীরা পাপ মোচনের আশায় লাঙ্গলবন্দ ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গান্ধীঘাট, রাজঘাট, ললিত সাধুর ঘাট, অন্নপূর্ণা মন্দির ঘাট, জয়কালী মন্দির ঘাট, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ী ঘাট, আকরী সাধুর ঘাটসহ মোট ১৪টি ঘাটে স্নান সম্পন্ন করে ফিরে যাবার পথে পুণ্যস্নান মেলা থেকে স্মৃতিস্বরূপ কিছু না কিছু কিনে সঙ্গে করে নিয়ে যান। এছাড়া ময়মনসিংহ জেলার শহরের গাঙ্গিনার পাড় সংলগ্ন শম্ভুপুরের ব্রহ্মপুত্রনদে যে পুণ্যস্নান হয় তার পাশ ঘেঁষেও পুণ্যস্নান মেলা বসে থাকে। সুনামগঞ্জ ও দিনাজপুরের পার্বতীপুরসহ আরো কয়েকটি জেলাতেও জাকজমকপূর্ণভাবে পুণ্যস্নান মেলা বসে থাকে।

রথের মেলা সাধারণত বাংলা বছরের আষাঢ় মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথের মেলা বসে থাকে। রথের মেলাকে বলা হয়- রথযাত্রার মেলা। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রাকে স্মরণ করে প্রতিবছর এদেশের সনাতনধর্মাবলম্বীরা বহু স্থানে এ ধরণের রথযাত্রার মেলা করে থাকে। রথযাত্রার কৃত্যাচারে দেখা যায় যে, আষাঢ় মাসে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার দিন বা তিথি এলে মন্দির সম্মুখে রাখা রথকে টেনে দূরে নির্দিষ্ট কোনো স্থানে বা খোলা প্রান্তরে রেখে আসা হয় আর তার ঠিক সাতদিন পরে সে রথকেই আবার টেনে আনা হয় জগন্নাথ মন্দিরের সামনে। এ রথযাত্রা ও উল্টোরথের পুরা সপ্তাহ জুড়ে বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই রথের মেলা বসে থাকে। কোথাও তার নাম রথযাত্রার মেলা, আবার কোথাও তার নাম উল্টোরথের মেলা। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, রথযাত্রার মেলার সূচনা কিন্তু রথযাত্রাকে উপলক্ষ করে আর উল্টোরথের মেলার সূচনা হয় প্রাসঙ্গিকভাবে উল্টোরথকে উপলক্ষ করে।

বাংলাদেশের মধ্যে সাভারের ধামারাইয়ের রথের মেলা সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ দুটি কারণে- ১. সবচেয়ে বড় রথ ধামারাইয়ের জগন্নাথ মন্দিরেই বর্তমান, ২. সবচেয়ে বেশি লোক সমাগম এবং বড় রথের মেলাটাও বসে এই ধামারাইয়ে। এ রথের মেলাতে মৃৎশিল্প, বাঁশ-বেত-কাঠ শিল্পসহ মেয়েদের বিবিধ প্রসাধন সামগ্রী, মন্ডা-মিঠাই, মৌসুমী ফলমূল বেচকেনার পাশাপাশি থাকে সার্কাস, পুতুল নাচের আয়োজন। এছাড়া শিশুদের আনন্দ-বিনোদনের জন্যে থাকে নাগরদোলা, ইয়ারগান দিয়ে বেলুন ফোটানো বা শূটিংয়ের ব্যবস্থা। ধামরাইয়ের রথের মেলা ছাড়াও বাংলাদেশের কুষ্টিয়া শহরের রথখোলার মেলা, রাজশাহী জেলার পুঠিয়ার রথের মেলা, সিলেটের জৈন্তপুরের লামাপাড়া রথযাত্রার মেলা, গোপালগঞ্জের মোকশেদপুরের রথযাত্রার মেলা, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের রথযাত্রার মেলা, ঢাকা তাঁতীবাজার ও রাধাগোবিন্দ মন্দিরের উল্টোরথ মেলা, কুমিল্লার জাহাপুর মুরাদনগরের উল্টোরথ মেলা, ফেনীর ট্রাঙ্করোডের উল্টোরথ মেলা এবং গাইবান্ধার কালিবাড়ির উল্টোরথ মেলাও কম প্রসিদ্ধ নয়।

লালন মেলা কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি থানার ছেঁউড়িয়া গ্রামে লালন সাঁইয়ের সামাধিকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর দুইবার লালনমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তার একটি হচ্ছে- বাউল সম্প্রদায়ের সাধকগুরু লালন সাঁইজির (১৭৭৪-১৮৯০) তিরোধান তিথি উপলক্ষে স্মরণানুষ্ঠান কেন্দ্রিক লালনমেলা এবং অন্যটি হচ্ছে-দোলপূর্ণিমায় লালন প্রবর্তিত সাধুসঙ্গ উপলক্ষে লালনমেলা। এ মেলা দুটির আলাদা কিছু চরিত্র আছে- ১. এটা মূলত লালনপন্থী সাধুদের সম্মিলনের মেলা, ২. মেলার একটি প্রান্ত জুড়ে থাকে বাউলদের বাদ্যযন্ত্র বিক্রির দোকান। এসব দোকানে সাজানো বিচিত্র ধরণের একতারা, দোতরা, ডুগি, প্রেমজুড়ি বা কাঠজুড়ি, মন্দিরার ভিতর থেকে দেশ-বিদেশের সাধুরা তাদের প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্রটি কিনে থাকেন, ৩. এই মেলাতে লালনপন্থী তাঁতী সাধুদের তাঁতে তৈরি গামছা-লুঙ্গি বিক্রির ভ্রাম্যমান কিছু বিক্রেতার দেখা মেলে, ৪. অন্যদিকে প্লাস্টিকের সামগ্রী, কারু দারু পণ্য থেকে আসবাব সামগ্রী, পাটি, মাটির পুতুল, মাটির হাড়ি, গহনা ইত্যাদির পাশাপাশি থাকে লালন সাঁইজির গানের ক্যাসেট ও গানের বইয়ের দোকান। ৫. এ মেলাতে এসে যে কেউ কিনতে পারে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা, যার প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে লালন সাঁইজির গান- ‘হায় রে মজার তিলের খাজা/খেয়ে দেখলি নে মন কেমন মজা’, এমন গরম জিলাপি খাওয়ার মজা যে কেউ নিতে পারে এ লালনমেলাতে এসে। সব মিলিয়ে লালনমেলা পেয়েছে পাঁচমিশালি মেলার রূপ। তবে, ছেঁউড়িয়ার লালন স্মরণোৎসব ও দোলপূর্ণিমার অনুষ্ঠান এমন মেলার চেহারা পেয়েছে খুব বেশিদিন আগে নয়, আসলে বিগত শতকের পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত লালন উৎসব ছিল অনেকটাই অনানুষ্ঠানিক এবং সাধু-ভক্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেসময় এখানকার অনুষ্ঠানের একটি স্বতঃস্ফূর্ততাও বর্তমান ছিল। কিন্তু ষাটের দশকে লালন আখড়ার অনুষ্ঠান দুটি প্রশাসনিক সহায়তায় ক্রমশ আনুষ্ঠানিকতার ভেতরে আবদ্ধ হয়ে এর স্বতঃস্ফূর্ত রূপটি হারিয়ে ফেলে। আগে দোলপূর্ণিমা বা লালন তিরোধানের অনুষ্ঠান ছিল মূলত সাধুসেবার অনুষ্ঠান- বাউল-ফকির সম্মিলন, সেবা ও সঙ্গীত এবং দীক্ষানুষ্ঠান। এখন এসবের সঙ্গে মন্ত্রী-আমলার উপস্থিতি যুক্ত হয়ে লালন স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠান বা দোলপূর্ণিমার অনুষ্ঠান দুটিই লালনমেলাতে রূপান্তরিত হয়েছে। তবুও কোনো কোনো বছর এ মেলার মধ্যেই চলে সাধুদের দীক্ষা বা ভেক খিলাফতের অনুষ্ঠান। সাধারণত লালন সাঁইয়ের মাযারকে সামনে রেখে খেলাফতের সাদা কাপড় পরিয়ে লালন সমাধিকে সাতবার প্রদক্ষিণের রীতি এ খেলাফতের অনুষ্ঠানে পালিত হয়। খেলাফতের অনুষ্ঠানের মাঝে ভিক্ষাপর্বে গান গেয়ে মেলা প্রাঙ্গণের সাধুভক্তদের কাছ থেকে নতুন খেলাফতধারীরা ভিক্ষা গ্রহণ করে থাকে সারা মেলাতে ঘুরে ঘুরে। লালন মেলাকে কেউ কেউ আবার বাউলমেলা নামে আখ্যায়িত করে থাকেন।

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া ছাড়া মেহরপুর এবং নরসিংদী জেলার বাউলপাড়াতে এ ধরণের বাউলমেলা বসে থাকে। এ মেলাগুলোতে লালনমেলার মতোই সাধারণত বাউলদের সমাবেশের সঙ্গে থাকে বাউলগানের আয়োজন। আর মেলার বেচাকেনার পসরা হিসেবে থাকে বাউলদের প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র সামগ্রী-একতারা, মন্দিরা, কাঠজুড়ি ইত্যাদির দোকান। অবশ্য এসবের সঙ্গে গামছা, লুঙ্গির দোকানও বসে। মেহেরপুর-নরসিংদী ছাড়াও ঢাকার ডেমরা-কয়েতপাড়ার বাউলবাজারে বাউল সম্প্রদায়ের জনৈক সিদ্ধপুরুষের স্মৃতি উৎসব হিসেবে ২৯ মাঘ থেকে পরবর্তী ২ দিন ভক্ত নরনারীর সম্মিলনে একটি বাউলের মেলা বসে থাকে।

মাইজভান্ডারী মেলা  সুফি সাধকদের ঐতিহ্যের ধারায় সমন্বয়ধর্মীর বিশেষত্বে মাইজভান্ডারী তরিকা সৃষ্টি আর মাইজভান্ডারী তরিকার মৌলিক বিশেষত্ব সমন্বয়ধর্মিতা। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের এ দিনে মাইজভান্ডারী তরিকার প্রবর্তক শাহ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারীর মৃত্যু হয়, আর ওই দিবস উপলক্ষেই মাইজভান্ডার শরীফে প্রতিবছর যে লাখ লাখ ভক্ত-আশেকানের মেলা বসে তাই মাইজভান্ডারী মেলা। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব জাতির সব শ্রেণীর মানুষের স্বাভাবিক প্রবেশাধিকার রয়েছে মাইজভান্ডার দরবার শরীফে। স্বাভাবিকভাবে মাইজভান্ডারী ওরশকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সবধর্মের মানুষের এক মহামিলনক্ষেত্র। প্রতিবছর মাঘ মাসের ১০ তারিখে ফটিকছড়িতে মাইজভান্ডার মেলা বসে। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক আবহের পাশাপাশি মাইজভান্ডারী মেলার অন্যতম বিশেষত হচ্ছে- বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের অবাধ গমনাগমন, আশেপাশের উপজাতীয় এবং স্থানীয় কৃষিজীবী ও কুটিরশিল্প উৎপাদনকারী জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ। মাইজভান্ডারী মেলার বিশেষ আকর্ষণ মাইজভান্ডারী সঙ্গীত তাছাড়া নতুন-পুরাতন মাইজভান্ডারী গানের বই-বিক্রি, মাইজভান্ডারী গানের সিডি ও ক্যাসেট, গ্রাম্য কবিয়ালদের প্রেম-বিচ্ছেদ-মিলনের রকমারী গানের আসর, শ্রোতাদের কাছ থেকে কবিয়ালের নেওয়া কবিতা পাঠের সম্মানী।

জসীম মেলা  এটি পল্লিকবি জসীমউদ্দীন স্মরণোৎসব মেলা। ফরিদপুর শহরের কাছেই কবির জন্মভিটা অম্বিকাপুরে প্রতিবছর এ মেলা বসে থাকে। এ মেলার প্রধান আকর্ষণ থাকে পল্লিগীতি ও বিচারগানের আসর। সেসঙ্গে এ মেলাতে থাকে ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি, মাটির হাড়ি, মাটির পুতুল, লোহার সামগ্রী ও বাঁশ-বেতের গৃহসামগ্রী। আর খাদ্যবস্ত্তর মধ্যে থাকে বৈচিত্র্যময় মিষ্টির সমাহার ও ঝালযুক্ত পিয়াজু, মোগলাই, সিঙাড়া, পুরি বিক্রির ধুম পড়ে যায়। অন্যদিকে বিচিত্র রকমের দর্শক রুচির দিকে মেলা কমিটির লোকদের থাকে সতর্কচোখ, তাই তারা সার্কাস, পুতুলনাচ ও মৃত্যুকূপ সার্কাসের আয়োজন মেলা প্রাঙ্গণে রেখে থাকেন।

রাস মেলা কার্তিক মাসের শেষ দিকে মণিপুরীদের রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকেও মণিপুরী সম্প্রদায়ের ভক্তকুল শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা ও রাখাল খেলায় তাদের মানত পুরো করতে আসেন। কমলগঞ্জ থানার মাধবপুর ইউনিয়নের শিব বাজারে উৎসবের সাড়া পড়ে যায়। শিব বাজারের জোড়া মন্ডপ। দুই তিন ফার্লং দূরে দূরে পর পর অবস্থিত তিনটি মন্ডপের মিলনক্ষেত্র। যতই দিন যাচ্ছে ততই রাস উৎসবের আকর্ষণ বাড়ছে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার আগমনে সব দিক মুখরিত হয়ে উঠে। কার্তিক মাসের আগ থেকেই রাস লীলায় অংশগ্রহণের জন্য নৃত্য-গীতের তালিম নেয়ার ধূম পড়ে। নয় বছরের নাবালিকা থেকে শুরু করে কুড়ি বছরের অবিবাহিতা কুমারীদের এতে অংশ নিতে দেখা যায়। জোড়া মন্ডপের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তিন তিনটি পরিবারের কিশোরী কন্যাকে শ্রীরাধার অভিনয়ে ও নৃত্যগীতে পারদর্শী করে তোলা হয়। শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় রাখা হয় তিনজন বালককে। তাছাড়া খুলনা জেলার দুবলারচর রাস মেলা, বাগেরহাটের খানপুর রাস পূর্ণিমার মেলা, ফরিদপুর ওড়াকান্দির রাস মেলা, দিনাজপুর কান্তনগর রাস মেলা, বরিশালের গোশিঙ্গা রাস উৎসবের মেলা, সিলেটের লামাবাজার রাস উৎসব মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

বিষুব সংক্রান্তির মেলা  পাবর্ত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের উৎসবকেন্দ্রিক মেলা। আসলে বাংলা বছরের শেষ দুদিন এবং পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ধুমধামের সঙ্গে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের যে উৎসব উদ্যাপিত হয় তারমধ্যে সবচেয়ে বড় উৎসব ও মেলার নাম হচ্ছে-বৈসাবি। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন মুখ্য আদিবাসীগোষ্ঠী- চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমাদের মধ্যে এ উৎসব পরিচিত যথাক্রমে বিজু, বৈসুক ও সাংগ্রাইন নামে, যাদের আদ্যক্ষর নিয়ে ইদানীং এ অঞ্চলের সকল আদিবাসীগোষ্ঠীর জন্য এ উৎসবকে অভিহিত করা হয়েছে ‘বৈ-সা-বি’ নামে। বৈসুক, সাংগ্রাইন এবং বিজুর মূল শব্দটি সম্ভবত ‘বিষুব সংক্রান্তি’। আসলে চাকমা ভাষায় ‘স’ বা ‘ষ’-কে ‘জ’ হিসেবে উচ্চারণ করা হয়। একারণে বিষু শব্দটি চাকমা ভাষায় হয়ে গেছে ‘বিজু’। ‘ফুল বিজু’, ‘মূল বিজু’ এবং ‘গোর্য্যাপর্য্যার দিন’ মিলে মোট তিন দিন চলে চাকমাদের বিজু উৎসব ও মেলা। বাংলা বর্ষের শেষ দিনের আগের দিন পালিত হয় ফুল বিজু। এ দিন ভোরের আলো ফোটার আগে চাকমা নারীপুরুষ, ছেলেমেয়ে ফুল তোলার জন্য বাড়ির বাইরে বাগানে, বনবাদাড়ে আসে। এমনকি প্রতিবেশীর বাগান থেকে ফুল চুরি করতে এদিন কারো কোনো বাধা থাকে না। তোলা ফুলের একাংশ দিয়ে বুদ্ধপুজা দেওয়া হয়, বাকি অংশ নদীকে পুজার অর্ঘরূপে দেওয়া হয়। নদীতে ফুল পুজা দেওয়ার আগে গোসল করা হয়। গোসলের সময় আর ফুল দেওয়ার সময় নদীর কাছে প্রার্থনা করা হয়-‘জু মা গঙ্গী, ম-র পুরোন ঝরঝর আপদবলা, ফিবলা বেগ ধোয় নে যা’ অর্থর্াৎ ‘প্রণাম হে মা গঙ্গা, আমার পুরানো বছরের যাবতীয় আপদ-বিপদ সব ধুয়ে নিয়ে যাও’।

বিজু উৎসবের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ বাংলা বর্ষের শেষ দিনকে বলা হয় ‘মূল বিজু’। এ শব্দবন্ধ থেকে বোঝা যায় বিজু উৎসবের মূল বা প্রধান আকর্ষণ হলো এ দিনটি। এ দিন সকালে ছোট ছেলেমেয়েরা থালায় ধান নিয়ে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠোনে ধান ছিটায় মুরগিদের খাওয়ানোর জন্য। পরে ছেলেমেয়েরা সবাই মিলে প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ঘুরে ঘুরে বিজু খেয়ে থাকে। প্রতিবেশীদের বাড়িতে ঘুরতে এদিন কোনো দাওয়াতের প্রয়োজন হয় না। প্রতি বাড়িতে পাজনসহ খাবারের বিভিন্ন আয়োজন থাকে। সম্ভবত পাঁচ অণ্ণ (পাঁচন) শব্দ থেকেই পাজন শব্দের উৎপত্তি। ন্যূনতম পাঁচ পদের সবজির সংমিশ্রণে রান্না করা তরকারিকে পাজন বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে একশ পদেরও বেশি সবজি দিয়ে পাজন রান্না করা হয়। এ পাজন ছাড়াও থাকে পিঠা, পায়েস, সেমাই, শরবত ইত্যাদি নানা ধরণের খাবার ও পানীয়। পাজনের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের আপ্যায়ন করা হয় ঘরে তৈরি মদ দিয়ে। সাধারণত মূল বিজুর দিনে ভাত এবং মাছ-মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় না। দুপুরে তরুণ-তরুণীরা নদী, কুয়ো থেকে জল তুলে বয়সীদের গোসল করায়। বৌদ্ধ মন্দিরে বুদ্ধের মূর্তিকে গোসল করানো হয়। গোসল করা বা করানোটা হলো পুরানো বছরের ময়লা-আবর্জনাস্বরূপ আপদ-বিপদ ধুয়ে পূতঃপবিত্র হওয়ার প্রতীক। সন্ধ্যায় মোমবাতি দিয়ে বুদ্ধকে, গঙ্গী মাকে (নদীকে) পুনরায় পুজা করা হয়, বাসায় আলোকসজ্জা করা হয় এবং গোয়ালঘরও মোমবাতি দিয়ে আলোকিত করা হয় পুরানো বছরের যাবতীয় অজ্ঞানতা, আপদ-বিপদের অন্ধকার যেন দূরীভূত হয়ে যায়।

বিজু উৎসবের তৃতীয় দিন বা বাংলাবর্ষের প্রথম দিনকে বলা হয় ‘গোর্য্যাপোর্য্যা’ দিন অর্থাৎ ‘গড়িয়ে পড়া দিন’। হিন্দিতে যেমন জন্মদিনকে বলা হয় ‘সাল গিড়া’ বা ‘বর্ষ গড়িয়ে যাওয়া’র দিন, তেমনি চাকমাদের কাছে পহেলা বৈশাখ হলো বছর গড়িয়ে পড়ার দিন। এদিন নিকট আত্মীয়দের ভাত-মাছ-মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। গৃহবধূ যারা আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকার কারণে মূল বিজুতে তেমনভাবে শরিক হতে পারে না তারা এদিন বাড়ি বাড়ি ঘোরেন।

ত্রিপুরা আদিবাসীগোষ্ঠী বিষুব সংক্রান্তিকে ‘বৈসুক’ নামে অভিহিত করে, যা সম্ভবত বিষু বা বৈষু থেকেই উদ্ভূত। তাদের বৈসুক উৎসব চাকমাদের মতোই, তবে তাদের বাড়তি আকর্ষণ হলো ‘গোড়াইয়া নৃত্য’। এ উদ্দেশ্যে ২০ থেকে ৩০ জন নারীপুরুষ নর্তক-নর্তকী নিয়ে গঠিত হয় একেকটি গোড়াইয়া দল। বৈসুকের দিনে এ গোড়াইয়া দল পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে।

মারমা আর রাখাইন আদিবাসীগোষ্ঠীর কাছে বিষুব সংক্রান্তি ‘সাংগ্রাইন’ নামে পরিচিত, যা উদ্ভূত হয়েছে সংক্রান্তি শব্দ থেকে। চাকমারা যেখানে পুরানো বছরের আপদ-বিপদ দূরীভূত করার মানসে নদীতে গোসল করে, বয়সীদের গোসল করায়, সেখানে সাংস্কৃতিক বিবর্তনে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের উৎসব ‘সাংগ্রাইন’ মারমাদের কাছে হয়ে গেছে পানি ছিটানোর ‘জলকেলি’ উৎসব। এ উৎসবে নারীপুরুষ সবাই অংশগ্রহণ করে পরস্পরের উপর জল ছিটানোর জন্য। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায় সাড়ম্বরে বিষুব সংক্রান্তি পালন করে। এ উপলক্ষে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতা। খেলার মধ্যে বাংলাদেশের সমতল এলাকা থেকে ব্যতিক্রমধর্মী খেলা হলো নাধেং খেলা, ঘিলা খেলা ইত্যাদি। তাছাড়া অন্যান্য জেলার আদিবাসীরাও পালন করে বিষুব সংক্রান্তি উৎসব। কমলগঞ্জের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের কাছে এ উৎসব ‘বিষু’ নামে অভিহিত। পুরানো বছরের শেষ দিন থেকে শুরু হয়ে একটানা সাত দিন চলে এ উৎসব।

বিষুব সংক্রান্তি, যা ত্রিপুরা ভাষায় বৈসুক, বোডো ভাষায় বৈসাগু, খুব সম্ভব তারই সংস্কৃত রূপ ‘বৈশাখ’। আরাকানিরা বৈশাখ মাসকে বলে ‘থাংগ্রাই লাহ’ অর্থাৎ থাংগ্রাই (সাংগ্রাই) বা বিষুব সংক্রান্তির মাস। সেই হিসেবে বৈশাখ মাস মূলত বিষু অর্থাৎ বৈসুক বা বৈসাগুর মাস এবং বৈশাখ শব্দটির উৎপত্তি।

বারুণী মেলা মতুয়াদের প্রতিষ্ঠিত প্রধান মেলার নাম বারুণী মেলা। মতুয়ারা বলেন মহাবারুণী। প্রতিবছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী অর্থাৎ চৈত্র মাসের পূর্ণিমার পূর্ববর্তী ত্রয়োদশী তিথির বারুণী যোগের স্নান উপলক্ষে হরিচাঁদ ঠাকুরের লীলাক্ষেত্র গোপালগঞ্জ জেলার ওড়াকান্দি গ্রামে সপ্তাহব্যাপী এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

দুবলার চরের মেলা ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে হরিচাঁদ ঠাকুরের এক বনবাসী ভক্ত হরিভজন (১৮২৯-১৯২৩) এ মেলার প্রতিষ্ঠা করেন। বাঘেরহাট জেলার সুন্দরবনের দক্ষিণে পশুর নদীর মোহনায় দুবলারচর নামক স্থানে প্রতি বছর রাসপূর্ণিমা উপলক্ষে বিরাট মেলা বসে। প্রতিবছর অসংখ্য পূণ্যার্থী রাসপূর্ণিমা উপলক্ষে এখানে সমুদ্রস্নান করতে আসেন।  [সাইমন জাকারিয়া]