মেয়র কোর্ট

মেয়র কোর্ট  ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিচারসংক্রান্ত আদালত। বাংলা, মাদ্রাজ ও মুম্বাইয়ের ইংরেজ উপনিবেশের সীমা-চৌহদ্দির মধ্যে ইউরোপীয় আইন লঙ্ঘনকারীদের অভিযুক্ত ও বিচার করা ছিল এ প্রতিষ্ঠানের কাজ। কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের পূর্ববর্তী কোর্ট হিসেবে মেয়র কোর্ট ইংল্যান্ডের রানির মূল সনদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সনদ ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (সে সময়ে এ কোম্পানির নাম ছিল Governor and Company of Merchants of London trading into the East Indies) ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর রানি এলিজাবেথের কাছ থেকে লাভ করে। বিদেশে সমুদ্রচারী একটি ব্রিটিশ জাহাজকে তাত্ত্বিকভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এ সনদ কোম্পানি ও কোম্পানির বিষয়াদির জন্য এবং কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের কল্যাণে বিভিন্ন আইন ও অধ্যাদেশ প্রণয়ণের প্রয়োজনে কোম্পানিকে কোর্ট প্রতিষ্ঠা করার অধিকার প্রদান করে।

১৬৮৩ সালের চার্টারে সুনির্দিষ্টভাবে এক বিচার আদালত প্রতিষ্ঠার বিধান রাখা হয়। একজন ব্রিটিশ আইন বিশেষজ্ঞ ও তাঁর দুজন সহকারীকে নিয়ে এ আদালত গঠিত হয়। এ আদালতের কাজ ছিল গভীর সমুদ্রে কিংবা কোম্পানির বিভিন্ন উপনিবেশ এলাকার সীমার মধ্যে সংঘটিত বিভিন্ন প্রকারের অনধিকার প্রবেশ, ক্ষতি, জখম ও অন্যায়কাজ সম্পর্কিত মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এভাবে কথিত মেয়র আদালত প্রথমে মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৭০০ সালে বাংলার ফোর্ট উইলিয়মকে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি থেকে আলাদা করার পূর্ব পর্যন্ত বাংলায় নিয়োজিত কোম্পানির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির আদালতের এখতিয়ারাধীন ছিল। ১৭০০ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সির নির্বাহী কর্তৃপক্ষ ফোর্ট উইলিয়মের প্রেসিডেন্ট ও গভর্নর উপাধি নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং একই সময়ে প্রাথমিক আকারে মেয়র আদালতও প্রবর্তন করা হয়। একজন বিচারক সম্বলিত এই আদালতের এখতিয়ার সম্প্রসারিত ছিল কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানটি এই তিনটি গ্রামে। মেয়র আদালতের বৈধ আওতায় ছিল ‘কলকাতা জমিদারি’র স্থায়ী নিবাসী ইউরোপীয় ও দেশীয় প্রজাবর্গ।

১৭২৭ সালে মেয়র কোর্ট গঠন ও তার এখতিয়ারের দিক থেকে ব্যাপক সম্প্রসারিত হয়। এই সময় এক নতুন রাজকীয় সনদের আওতায় কোম্পানির বিভিন্ন কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোম্পানির সকল কর্মকর্তা, কর্মচারী ও দেশীয় কর্মচারীদের ওপর এখতিয়ারসম্পন্ন নিয়মিত আদালত গঠনের বিষয়ে কোম্পানিকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়। সনদে ‘Court of Mayor and Aldermen’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রিটিশ আইনে রাজার মনোনীত নয় জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে মেয়র কোর্ট গঠিত হয়। মেয়র আদালতের ডিক্রি সম্পূর্ণভাবে চূড়ান্ত কিছু ছিল না। এ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ও কাউন্সিলের কাছে এবং পরিশেষে, সপরিষদ রাজার কাছে আপিল করার বিধান রাখা হয়।

লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, যে মুগল রাজকীয় ফরমানের আওতায় বাংলায় ইউরোপীয়রা তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করত, সেই ফরমানে ইউরোপীয়দেরকে তাদের উপনিবেশে এ ধরনের আদালত প্রতিষ্ঠার কোন আনুষ্ঠানিক কর্তৃত্বাধিকার দেওয়া হয়নি। মুগল সাম্রাজ্যিক ব্যবস্থায় দেশী-বিদেশী নির্বিশেষে সকল লোক কেন্দ্রীয় সরকারের প্রজা ছিল। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের বেলায় মুগল বিচারবিভাগীয় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার প্রয়োগ কদাচিৎ দেখা যায়। ভারতের হিন্দুরা একই আদালতের আওতায় প্রধানত হিন্দু আইন দ্বারা শাসিত হতো। ইউরোপীয়দেরকেও একই কারণে ইউরোপীয় আইনের দ্বারা শাসিত হতে দেওয়া হতো। তবে এক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ ঘটত ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ন্যায়বিচারের সাধারণ ধারণাসমূহের আলোকে ভারত ও ব্রিটেনের আইন ও আইনগত কার্যবিধি বা পদ্ধতি পরস্পরের এতই বিপরীত প্রকৃতির ছিল যে, মুগলরা ইংরেজদেরকে তাদের নিজস্ব আইন ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা শাসিত হতে দেওয়াকেই বিচক্ষণতার কাজ বলে মনে করতেন।

তবে মুগলরা দেশীয় অধিবাসীদের ওপর কোম্পানির আইনগত এখতিয়ারের বিষয়ে কখনও সস্ত্তষ্ট ছিলেন না। এ ধরনের প্রয়োগরীতি ছিল মুগল সার্বভৌমত্বের সরাসরি লঙ্ঘন। আর এটি স্পষ্টত কোম্পানি ও মুগল সরকারের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতির ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ হিসেবে কাজ করে। অবশ্য, দেশীয় প্রজাদের ওপর মেয়র আদালতের এখতিয়ারের প্রশ্নে পর পর কয়েকজন নওয়াবের প্রতিবাদ সত্ত্বেও কলকাতার সীমার মধ্যে বসবাসকারী কোম্পানির দেশীয় কর্মচারী ও জনসাধারণের বিচারের রীতিটি কখনও বন্ধ থাকেনি। বাংলায় ব্রিটিশ উপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ১৭৭৩ সালের নিয়ামক আইনের (Regulating act) আওতায় অধিকতর বিশদ ও পূর্ণাঙ্গ বিচার ব্যবস্থা মেয়র আদালতের স্থান দখল করে। [সিরাজুল ইসলাম]