মৃত্তিকা জৈবপদার্থ

মৃত্তিকা জৈবপদার্থ (Soil Organic Matter)  প্রধানত প্রাকৃতিক গাছপালা থেকে জাত বস্ত্ত, প্রাণীর দেহাবশেষ বা মানুষের ক্রিয়াকলাপের ফলে প্রয়োগকৃত জৈবপদার্থ, যা মৃত্তিকার পৃষ্ঠ ক্ষিতিজে প্রবিষ্ট হয়। এসব বস্ত্তর বিয়োজন দ্বারা হিউমাস উৎপন্ন হয়। শস্যের অবশেষ, আগাছা, ঘাস, গাছের পাতা, পোকামাকড়, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, অ্যাকটিনোমাইসিটস, প্রাণীর মল, পৌর নর্দমার আবর্জনা, কাঠের টুকরা ও কাঠ কারখানার অবশেষ, শিল্পকারখানার জৈব অবশেষ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানার অবশেষ জৈবপদার্থের প্রধান উৎস। জৈবপদার্থে গাছের জন্য অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান (সার্বিক বৃদ্ধির জন্য ১৭টি মৌল) ছাড়াও গবাদি পশু ও মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলও থাকে। প্রাণীর বৃদ্ধির জন্য এসব মৌল হলো সোডিয়াম, কোবাল্ট ও আয়োডিন। জৈবপদার্থে অতি সামান্য পরিমাণে নিকেল, ফ্লোরিন, গোল্ড ও অন্যান্য মৌল থাকে।

বাংলাদেশের নিচু এলাকার পাললিক অবক্ষেপ সারা বছরই ভিজা থাকে। ফলে পচনশীল জলজ গাছপালা বা এসব এলাকায় চাষ করা বোরো ধান গাছের অবশেষ থেকে জাত জৈবপদার্থ মৃত্তিকা পৃষ্ঠে ধীরে ধীরে জমা হয়। এসব জৈবপদার্থ পৃষ্ঠমৃত্তিকাতে গাঢ় রং প্রদান করে। তুলনামূলকভাবে পুরাতন নিচু এলাকাতে জৈবপদার্থ মৃত্তিকা-পৃষ্ঠের উপর পিট বা মাক (muck) আকারে জমা হতে পারে। যেসব এলাকা মৌসুমমাফিক শুষ্ক হয়, সেসব মৃত্তিকাতে জৈবপদার্থের পরিমাণ ভিজা অবস্থার স্থায়িত্বকাল এবং বয়স ও মৃত্তিকা ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত। মৌসুমমাফিক প্লাবনের সময় যত দীর্ঘায়িত হয়, জৈবপদার্থের দ্রুত সবাত বিয়োজনের সময় তত কমে আসে। সাধারণত বাংলাদেশের নিচু এলাকার মৃত্তিকাতে এর সংলগ্ন উঁচু এলাকার মৃত্তিকা থেকে জৈবপদার্থ বেশি থাকে। সাম্প্রতিক কালের পললভূমির উঁচু এলাকাগুলোতে পৃষ্ঠমৃত্তিকার জৈবপদা©র্থর পরিমাণ ১ শতাংশ। এ পরিমাণের জৈবপদার্থ তুলনামূলকভাবে পুরাতন পললভূমির উত্তম-বাতান্বিত উঁচু মৃত্তিকাতে পাওয়া যায়। তুলনামুলকভাবে পুরাতন পললভূমির সর্বাপেক্ষা উঁচু স্থানে অবস্থিত মৃত্তিকা ব্যতীত অন্যান্য মৃত্তিকার পৃষ্ঠস্তরে জৈবপদার্থের পরিমাণ সাধারণত ১ থেকে ২ শতাংশ এবং অধিক নিচু এলাকার মধ্যস্থলে অবস্থিত পৃষ্ঠমৃত্তিকাতে জৈবপদার্থের পরিমাণ ২ থেকে ৫ শতাংশ। কালো তেরাই (Black Terai) মৃত্তিকার পুরু পৃষ্ঠমৃত্তিকাতে জৈবপদার্থের পরিমাণ সাধারণত ২ থেকে ৫ শতাংশ। বাংলাদেশের পুরাতন মৃত্তিকাগুলো লম্বা তৃণভূমি বা বনভূমিতে উৎপন্ন হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এসব গাছপালা বর্তমানে চাষাবাদকৃত শস্যের তুলনায় মৃত্তিকাতে অধিক জৈবপদার্থ প্রদান করেছিল। শস্য-অবশেষগুলো মৃত্তিকা থেকে অপসারণ করে নেওয়ার কারণে মৃত্তিকাতে জৈবপদার্থের পরিমাণ কমে গিয়েছে। বাংলাদেশের মধুপুর শালবন, সুন্দরবন, চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার মতো সর্বাপেক্ষা বড় বড় বনভূমি দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে মৃত্তিকাতে জৈবপদার্থের সঞ্চয়ন হ্রাস পাচ্ছে।

এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য এটাই নির্দেশ করে যে, বাংলাদেশের মৃত্তিকাতে জৈবপদার্থের পরিমাণ কম। কৃষি আবাদি উঁচু ও মধ্যম-উঁচু ভূমির প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকাতে জৈবপদার্থের পরিমাণ ২ শতাংশেরও কম। কম পরিমাণের এ জৈবপদার্থই বাংলাদেশের অনেক মৃত্তিকায় স্বল্প উৎপাদনশীলতার প্রধান কারণগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মৃত্তিকা ও শস্য উৎপাদনের ওপর সবুজ সারসহ জৈব অবশেষের প্রভাব সুস্পষ্ট। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শস্য অবশেষকে মৃত্তিকাতে রেখে দেওয়া বা পুনরায় প্রয়োগ করা উচিত। এ ধরনের সাধারণ নির্দেশনা মৃত্তিকাতে জৈবপদার্থের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করবে। এ জৈবপদার্থ মৃত্তিকা কণার দ্বারা সংযুতি সৃষ্টি, বাতান্বয়ন, পানির অনুপ্রবেশ ও চলাচল, পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং অণুজীবের ক্রিয়াকলাপের জন্য শক্তির ভান্ডার হিসেবে কাজ করবে।

সাধারণত মৃত্তিকাতে ৩ থেকে ৮ শতাংশ বা এর চেয়ে অধিক পরিমাণ জৈবপদার্থ গাছের বৃদ্ধিকে উন্নত করে। কিন্তু একজন কৃষকের নিকট সঠিক মাত্রায় জৈবপদার্থের নিম্ন সীমা বজায় রাখতে এর ব্যয় ও ব্যবহারের সুবিধা গুরুত্বপূর্ণ। [মোঃ খলিলুর রহমান]