মুহিত, আবুল মাল আবদুল

আবুল মাল আবদুল মুহিত

মুহিত, আবুল মাল আবদুল (১৯৩৪-২০২২) অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, পরিবেশবিদ, আমলা, লেখক-গবেষক, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৩৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি সিলেট শহরের ধোপাদিঘির পারের সম্ভ্রান্ত এক পরিবারের তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী ও ভাষাসৈনিক এবং মাতা সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরী ছিলেন রাজনীতিবিদ ও ভাষাসৈনিক। তিনি ১৯৪৯ সালে সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা (মেট্রিক) এবং ১৯৫১ সালে সিলেট মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ থেকে সারা প্রদেশে প্রথম হয়ে আই.এ পাস করেন। আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বি.এ (অনার্স) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি একই বিষয়ে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি) যোগদানের পর মুহিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকার, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চিফ ও উপসচিব (১৯৬৪-৬৬) থাকাকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটি ছিল এ বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন। ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে অর্থনৈতিক কাউন্সিলর হিসেবে নিযুক্ত হন। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে তাঁকে অর্থ ও পরিকল্পনা সচিব এবং ১৯৭৭ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃস¤পদ বিভাগে সচিব হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

সিলেটের খ্যাতনামা রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হওয়ার সুবাদে কৈশোর বয়সেই মুহিতের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন এবং পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা ছিলেন। এসময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের যুগ্ম স¤পাদক (১৯৫২-৫৩) পদে নির্বাচিত হন। তাঁর সময়ে ডাকসাইটে আমলা ও কূটনীতিক মুহিত ১৯৮১ সালে চাকুরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তৎকালীন এরশাদ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে ১৯৮২ সালের মার্চ থেকে ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিলে মুহিত স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। বিদেশে অবস্থানকালে তিনি এরশাদের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গঠন ও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ফোরামে বক্তৃতা প্রদান করেন। ১৯৯০ সালে সামরিক শাসনের অবসান হলে তিনি দেশে ফিরে বিভিন্ন প্রগতিশীল, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। ২০০১ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মুহিত অর্থমন্ত্রী হিসেবে কৃতিত্বের সাথে ১২ বার জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেন।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটনের পাকিস্তানি দূতাবাসের সাথে স¤পর্ক ছিন্ন করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন, লবিস্ট হিসেবে কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সক্রিয় তৎপরতা চালান। স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরে তিনি প্রবাসে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও ভাবমূর্তি বিনির্মাণে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে মুহিত ওয়াশিংটন দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঠিক এই সময়ে তিনি বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের প্রথম বিকল্প নির্বাহী পরিচালকের পদ অলংকৃত করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) নির্বাহী পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সালে তিনি অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদে যোগদান করেন। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ থেকে এসকাপের প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন মুহিত। ১৯৮৯ সালে ইউএনডিপির ভূমিকাবিষয়ক একটি বিশেষজ্ঞ পর্ষদে কাজ করেন তিনি।

শিক্ষা ও গবেষণায় মুহিতের মুখরিত পদচারণা ছিল। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের উড্রো উইলসন স্কুলে ফেলো হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি ৩০ টিরও অধিক গ্রন্থ এবং প্রায় ৭০০ নিবন্ধ ও প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে Bangladesh: Emergence of a Nation (1978), Thoughts on Development Administration (1981), Problems of Bangladesh– An attempt at survival (1986), বাংলাদেশ: পুনর্গঠন ও জাতীয় ঐকমত্য (১৯৯১), American Response to Bangladesh Liberation War (1996), স্মৃতি অম্লান ১৯৭১ (১৯৯৬), Bangladesh in the Twenty-first Century: Towards An Industrial Society (1999), বাংলাদেশ: জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব (২০০০), জেলায় জেলায় সরকার : স্থানীয় সরকার আইনসমূহের একটি পর্যালোচনা (২০০২), An Agenda for Good Governance: From lawlessness and corruption to a caring and prosperous democracy (2007), The State Language Movement in East Bengal 1947-1956 (2008), বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ (২০১৩), স্মৃতির মণিকোঠায় (২০১৪) প্রভৃতি।

মুহিতের সততা ও কর্মদক্ষতার জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘তমঘায়ে পাকিস্তান’ সম্মানে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে তিনি উপাধি বর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান ও অন্যান্য কৃতিত্বের জন্য ২০১৬ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আ্যলামনাই অ্যাসোসিয়েশনের দুইবারের নির্বাচিত সভাপতি (১৯৯৯ এবং ২০০১)। বরেণ্য এই ব্যক্তির সম্মানার্থে ২০১৫ সালে ‘সিলেট জেলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স’ এর নাম পাল্টে ‘আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স’ করা হয়। ২০২২ সালের ২৯শে এপ্রিল তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। [আবু সুফিয়ান]

তথ্যসূত্র আবুল ফতেহ ফাত্তাহ (সম্পা.), প্রজ্ঞাদীপ মুহিতমানস, সিলেট: প্রত্নপাঠ ২০১৫; A.M.A. Muhith, Bangladesh: Emergence of Nation, Dhaka: UPL 1978; আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্মৃতিময় কর্মজীবন, ঢাকা: চন্দ্রাবতী একাডেমি ২০১৭; আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্মৃতি অম্লান ১৯৭১, ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন ২০১৭