মুখোপাধ্যায়, ভুবনচন্দ্র

মুখোপাধ্যায়, ভুবনচন্দ্র (১৮৪২-১৯১৬) অনুবাদক, সম্পাদক, সাহিত্যিক।  ১৮৪২ সালের ১০ জুলাই মাতামহাশ্রম চবিবশ পরগণার অন্তর্গত বারুইপুর সন্নিহিত শাসন গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রধানত মিশনরী স্কুলে অধ্যয়ন করেন। অল্প বয়স হতেই তাঁকে অন্নসংস্থানে মনোযোগী হতে হয়। স্কুলের পাঠ সমাপ্তির পর তিনি বারুইপুরের সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের তৃতীয় শিক্ষকের পদে অধিষ্ঠিত হন। সময় সময় তিনি গৃহ শিক্ষকের কাজ করে জীবিকা অর্জন করেন।

উনবিংশ শতকের শেষে যে কয়জন গদ্য লেখক ও অনুবাদক বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন ভুবনচন্দ্র তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। অনুবাদকর্মে তিনি বিশেষ কৃত্বিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর অক্লান্ত লেখনি বাঙালিকে বৈদেশিক গল্পের একান্ত দেশিরূপের স্বাদ এনে দিয়েছে। ইংরেজি ভাষায় তাঁর প্রগাঢ় বুৎপত্তি থাকা সত্ত্বেও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার টানে বাংলা সাহিত্যে তিনি মনোনিবেশ করেন।

সম্পাদক কালীপ্রসন্নসিংহের পরিদর্শন দৈনিক পত্রিকায় ভুবনচন্দ্রের অনেক কবিতা প্রকাশিত হতো। ১৮৬২ সালে ভুবনচন্দ্র উক্ত পত্রিকার সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে প্রধানত গ্রাহকগণের অনাদরের কারণে কালীপ্রসন্ন সিংহ পরিদর্শক পত্রিকার প্রচার বন্ধ রাখেন। কিন্তু ভুবনচন্দ্রের প্রতি তিনি প্রসন্ন থাকায় তাকে ভালো চাকরি পাইয়ে দিবেন এ আশ্বাসে তাঁর নিকট রাখেন। ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’ ১ম খন্ড প্রচারের অব্যবহিত পরেই ভুবনচন্দ্র পুনরায় কালীপ্রসন্ন সিংহের আশ্রয় লাভ করেন। দুবছর পর তিনি স্বয়ং কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোমে’র আদর্শে ‘সমাজ কুচিত্র’ নামে একটি সামাজিক নক্শা প্রকাশ করেন। তিনি এটি ‘সাহসের অদ্বিতীয় আশ্রয় অনরেবল হুতোম’কে উৎসর্গ করেন। ছদ্ম নামে প্রকাশিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল ভুবনচন্দ্রের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। পরে তিনি সোমপ্রকাশ পত্রে দেড় বছর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সম্ভবত ১৮৬৮ সালে তিনি সংবাদ প্রভাকরের সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করেন। উক্ত পদে তিনি দীর্ঘ ২২ বছর কর্মরত ছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি বিদূষক (১৮৭০) ও পূর্ণশশী (১৮৭৩) নামে দুটি মাসিকপত্র সম্পাদন করেন। ১৮৫৭ সালে তিনি সাপ্তাহিক বসুমতী (১৮৯৬) পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৯৮ সালে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট তিনি উক্ত দায়িত্ব অর্পণ করে বসুমতীর গ্রন্থপ্রকাশ বিভাগে যোগদান করেন। কিন্তু সম্পাদকীয় বিভাগ থেকে তিনি পুরোপুরিভাবে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। তাছাড়া তিনি ১৯০০ সালে প্রকাশিত জন্মভূমি মাসিক পত্রিকার ১১শ ভাগের (১৩০৯) প্রথম কয়েক সংখ্যার সম্পাদকের কাজ করেন। উক্ত পত্রিকায় তাঁর অনেক কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ ছাপা হয়।

বাংলা সাহিত্যের সব বিভাগেই ভুবনচন্দ্র তাঁর কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন। তাঁর রচিত কাব্য, গল্প-উপন্যাস, সামাজিক নক্শা, প্রহসন, ইতিহাস, জীবনী, ভ্রমণ কাহিনী রয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: সমাজ-কুচিত্র (১৮৬৫), তুমি কি আমার (উপন্যাস, ১৮৭৩-৭৯), মধু-বিলাপ (অমিতাক্ষর কাব্য, ১৮৭৩), রহস্য-মুকুর (উপন্যাস, ১৮৮৩), ঠাকুরপো (প্রহসন, ১৮৮৬), তুমি কে (অমিতাক্ষর কাব্য, ১৮৮৭), বঙ্কিমবাবুর গুপ্ত কথা (উপন্যাস, ১ম খন্ড-১৮৯০, ২য় খন্ড-সম্বৎ ১৯৪৭), গুপ্তচর (ডিটেকটিভ উপন্যাস, ১৮৯৮), মহাদেবের মাদুলী (রঙ্গরচনা),রামকৃষ্ণ-চরিতামৃত ৯১৯০১), চন্দ্রমুখী (ডিটেকটিভ গল্প, ১৯০২), ধর্ম্মরাজ (সচিত্র সমাজ-রহস্য, ১৯০৯)। ১৮ জুলাই ১৯১৬ সালে ভুবনচন্দ্রের মৃত্যু হয়।  [শামীমা আক্তার]