মুখোপাধ্যায়, ধনগোপাল

মুখোপাধ্যায়, ধনগোপাল (১৮৯০-১৯৩৬)  লেখক, শিশুসাহিত্যিক, দেশপ্রেমিক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচারক। কলকাতায় তাঁর জন্ম। পিতা কিশোরীলাল মুখোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী ও সঙ্গীতসাধক। অগ্রজ যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় এবং ক্ষীরোদগোপাল মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিপ্লবী। এঁদেরই প্রভাবে ধনগোপাল কিশোর বয়সেই বিপ্লবিমন্ত্রে দীক্ষিত হন।

ধনগোপাল স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখতেন। এজন্য একটি গুপ্ত সমিতি গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯০৮ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার নাম করে জাপান যান। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে তাঁর মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে এবং তিনি প্যাট (এথেল রে ডুগান) নামে এক মার্কিন তরুণীকে বিবাহ করে স্থায়িভাবে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।

আমেরিকায় প্রতিষ্ঠা অর্জনে ধনগোপালকে খুব কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর অগ্রজ যাদুগোপালের পরামর্শে তিনি সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে আমেরিকাবাসীদের দৃষ্টি ভারতের প্রতি আকৃষ্ট করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর সব সাহিত্যকর্মই ইংরেজি ভাষায় রচিত।

ধনগোপালের প্রথম গ্রন্থ Rajani একটি  কাব্য, দ্বিতীয়টি নাটক Layla Maznu (১৯১৬)। তাঁর যে গ্রন্থটি পাশ্চাত্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং তাঁকে ব্যাপক খ্যাতি এনে দেয়, তা হলো: A Son of Mother India Answers (১৯২৮)। মিস ক্যাথারিন মেয়ো Mother India  গ্রন্থে ভারতের যে কুৎসা রটিয়েছিলেন, তারই প্রতি-উত্তরে ধনগোপাল এ গ্রন্থটি রচনা করেন। ধনগোপালের আরও যে গ্রন্থগুলি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং যেগুলির মাধ্যমে পাশ্চাত্যের মনীষীরা ভারতবর্ষের ঐশ্বর্যে আকৃষ্ট হয়ে ভারতকে জানতে আগ্রহী হন, সেগুলি হলো: The Face of Silence (১৯৩০), My Brother’s Face, Caste and Outcaste (১৯২৩) এবং Visit India with Me। প্রথমটিতে পাশ্চাত্যে  রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়েছে এবং এটি পাঠ করেই ফরাসি মনীষী রোমাঁ রোলাঁ রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের জীবনী রচনায় উদ্বুদ্ধ হন। My Brother’s Face গ্রন্থে ধনগোপালের অগ্রজ যাদুগোপালের বিপ্লবী জীবন, তাঁর নিজের বাল্যজীবন এবং পারিবারিক নানা প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। তৃতীয় গ্রন্থটি তাঁর  আত্মজীবনী। এতে বিদেশে তাঁর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং চতুর্থ গ্রন্থে ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান ও নগর ভ্রমণের বর্ণনার মাধ্যমে মূলত ভারতাত্মার স্বরূপটিই তুলে ধরা হয়েছে।

শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও ধনগোপাল যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর Gay Neck নামক গ্রন্থটি ১৯২৭ সালে আমেরিকার বিখ্যাত পুরস্কার ‘জন নিউবেরি’ পদক লাভ করে। তাঁর অন্যান্য শিশুগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে Kari the Elephant, Jungle Beasts and Men, Ghond, The Hunter, Hari, The Jungle Lad, The Chief of the Herd (১৯২৯) ইত্যাদি। তাঁর ধর্মদর্শনমূলক একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হলো Divotional Passages of the Hindu Bible (১৯২৯)। এটি  গীতা ও উপনিষদের সংকলন গ্রন্থ। ধনগোপালের রচনাবলি সুদূরপ্রসারী কল্পনা, সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি এবং যথার্থ অধ্যাত্ম ভাবনার সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও ভারতীয় মানসের যথার্থ পরিচায়ক।

ধনগোপাল ব্যক্তিজীবনে রামকৃষ্ণদেবের ধর্মদর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন এবং স্বামী শিবানন্দ ছিলেন তাঁর গুরু। ১৯২২ ও ১৯৩০ সালে দুবার স্বদেশে এসে তিনি বেলুড় মঠে অবস্থান করেন। মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে ধনগোপাল ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কে আত্মহত্যা করেন।  [দুলাল ভৌমিক]