মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা

মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা  সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পবিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন মীজানুর রহমান (১৯৩১-১৯৯৬)। সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং মানুষের প্রতি সম্প্রীতি ও দায়িত্ববোধ থেকে তিনি এ পত্রিকা সম্পাদনায় মনোযোগী হন।

মীজানুর রহমান তাঁর নিজের নামানুসারে পত্রিকাটির নামকরণ করেন। বিদেশী ভাষার দৃষ্টান্ত ছেড়ে দিলেও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসে এরূপ নামকরণের ঐতিহ্য লক্ষ করা যায়। পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত রমাপদ চৌধুরীর পত্রিকার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই সম্ভবত মীজানুর রহমান তাঁর নিজের নামে পত্রিকার নামকরণ করেন। পত্রিকাটির প্রকাশক ছিলেন নূরজাহান বেগম।

পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ, কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থ পরিচিতি। এ পত্রিকার প্রায় আশিটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সম্পাদকের লক্ষ্য ছিল প্রচলিত সাহিত্যিক বিশ্বাসে প্রভাবিত না-হয়ে একটি উন্নতমানের সাময়িক পত্রিকা উপহার দেওয়া। সম্পাদক তাঁর পত্রিকায় কেবল সাহিত্যসেবিদেরই জায়গা দেননি, ইতিহাসচর্চায় আগ্রহী এবং শিল্পকলাবিদদেরও লেখায় প্রবৃত্ত করিয়েছেন। যেমন—কামরুল হাসান লিখেছেন ‘আমার স্কেচ ও প্রেমের ভ্রমরেরা’, কাইয়ুম চৌধুরী ‘আমি ও আমার ছবি’; কামাল উদ্দিন হোসেন ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন ‘গ্রেট মোগল’; আবার সঙ্গীত বিষয়ে ওয়াহিদুল হক লিখেছেন ‘বাংলা সুরে বাংলা গান: বাঙালী গায়?’ অপরদিকে ইফতিখার আহমেদ আলোচনা করেন ‘সত্যের পরাজয়ের সমস্যা’ নিয়ে যা প্রধানত দর্শনের বিষয়। এভাবে লক্ষ করা যায়, আবদুল্লাহ আল মুতী, আলী আসগর, দ্বিজেন শর্মা, কলিম খান, ময়ল রায়চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল হালিম, শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ক্ষেত্র গুপ্ত, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, দেবীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় আসাদ চৌধুরী, হায়াৎ মামুদ, রফিক কায়সার, আবদুল মান্নান সৈয়দ, বেলাল চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মোয়াজ্জেম হোসেন, মাহমুদ শাহ কোরেশী, ফরহাদ মজহার, রশিদ হায়দার, শাহাবুদ্দীন আহমদ, বিপ্রদাস বড়ুয়া, সায়ীদ আতিকুল্লাহ, রফিক আজাদ প্রমুখ লেখক মীজানুর রহামনের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় লিখেছেন।

নিয়মিত সংখ্যা ছাড়াও পত্রিকাটির কতকগুলি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার এ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যেমন—‘কৃষ্ণদয়াল বসু সংখ্যা’ (১৯৮৪), ‘আহসান হাবীব সংখ্যা’ (১৯৮৫), ‘বৃক্ষ সংখ্যা’ (১৯৮৬), ‘কামরুল হাসান সংখ্যা’ (১৯৮৭), ‘রশিদ চৌধুরী সংখ্যা’ (১৯৮৮), ‘পক্ষী সংখ্যা’ (১৯৮৯), ‘বৃক্ষ ও পরিবেশ সংখ্যা’ (১৯৯১), ‘শামসুর রাহমান সংখ্যা’ (১৯৯১), ‘গণিত সংখ্যা’ (দুই খন্ড, ১৯৯৫), ‘বিদ্যাসাগর সংখ্যা’ (১৯৯৭), ‘নদী সংখ্যা’ (১৯৯৯) প্রভৃতি। এসবের প্রত্যেকটি সংখ্যায় সম্পাদকের বিচিত্র আগ্রহ ও কৌতূহলের স্বাক্ষর লক্ষ করা যায়।

‘বিদ্যাসাগর সংখ্যা’ প্রকাশ করে এ পত্রিকা যেমন উনিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ কর্মীপুরুষের সঙ্গে বিশ শতকের তরুণপ্রজন্মের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, যাতে ধরা পড়েছে উত্তর-প্রজন্মে কাছে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি সম্পাদকের দায়বদ্ধতা, তেমনি ‘পক্ষী সংখ্যা’ প্রকাশেও দেখা যায় সম্পাদকের মনস্বীতা। পাখিবিষয়ক সংখ্যাটি প্রায় সাতশ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত। এ সঙ্কলনে আছে একচল্লিশটি নিবন্ধ-স্মৃতিকথা, তিনটি গল্প, উনিশটি কবিতা, বিবিধ বিষয়ে তিনটি চয়নিকা এবং সবশেষে আছে পাখিবিষয়ক গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত তালিকা। পাখির পরিচয়কে কেবল বৈজ্ঞানিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ না করে কবিতায়, ছোটগল্পে, স্মৃতিচারণে, প্রবাদ-প্রবচনে, লোক-কথায়, ছড়ায়-ছবিতে—এককথায় আবেগে, কল্পনায়, ভাষায় মানুষের জীবনের সঙ্গে পাখি কতটা জায়গা দখল করে আছে, তার বিস্তৃত বিবরণ বিধৃত হয়েছে সংখ্যাটিতে।

সম্পাদকের চিন্তাশীলতা ও উন্নত রুচির প্রতিফলনে বোঝা যায়, এ পত্রিকার একটি মিশন ছিল। সে মিশন পুরোপুরি অর্জনের আগেই মীজানুর রহমান মারা যান (১৯৯৬)। তাঁর মৃত্যুর কিছুকাল পর তাঁর স্বপ্নের পত্রিকাটিরও মৃত্যু ঘটে। পত্রিকাটি সম্পাদনায় মীজানুর রহমান যে শ্রম, নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও চিন্তাভাবনার পরিচয় দিয়েছেন, সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসে তাঁর এ অবদান বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য।  [মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম]