মিয়া, মো. ফজলে রাব্বী

মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া

মিয়া, মো. ফজলে রাব্বী (১৯৪৬-২০২২) আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৪৬ সালের ১৫ই এপ্রিল গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার গটিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম মোঃ ফয়জার রহমান এবং মাতা মোছা. হামিদুন নেছা। তিনি ১৯৬১ সালে সাঘাটার ভরতখালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৬৩ সালে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৬৫ সালে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে বি.এ পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬৮ সালে এল.এল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন।

মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া আইনজীবী হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল সনদ অর্জন করেন এবং গাইবান্ধা জেলা বারে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে, ১৯৮৮ সালে তিনি সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সদস্য পদ লাভ করেন।

রাজনীতি সচেতন পরিবারের সদস্য হওয়ার সুবাদে কৈশোর বয়সেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়ার। ১৯৫৮ সালে ভরতখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ জারির বিরুদ্ধে মিছিল ও আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। গাইবান্ধা সরকারি কলেজের ছাত্র থাকাকালীন ১৯৬২-৬৩ সালে তিনি শরীফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। এই কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের (আইয়ুব খানের শাসনামলে দলভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় ‘অগ্রদূত’ ছদ্মনামে কার্যক্রম পরিচালনা হত) আহ্বায়ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকাস্থ রংপুর জেলা ছাত্র কল্যাণ সমিতির সাংগঠনিক স¤পাদক নির্বাচিত হন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের গাইবান্ধা জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ স¤পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-৫ আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। চতুর্থ জাতীয় সংসদে (১৯৮৮-১৯৯০) তিনি জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে তিনি এরশাদ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সপ্তম জাতীয় সংসদে (১৯৯৬-২০০১) তিনি জন উদ্যোগ বিষয়ক কমিটি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় স¤পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেন।

২০০১ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে গাইবান্ধা-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদে (২০০৯-২০১৪) তিনি সরকারি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন স¤পর্কিত এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছাড়াও আইন প্রণয়ন কমিটি, কার্য উপদেষ্টা কমিটি এবং সংবিধান সংশোধনী বিষয়ক বিশেষ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দশম (২০১৪) ও একাদশ (২০১৯) জাতীয় সংসদে তিনি ডেপুটি স্পিপকার হিসেবে নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া ১১ নং সেক্টরে সরাসরি যুদ্ধ করেন। স্থানীয় মানুষদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার পক্ষে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। এছাড়াও, তিনি মুজিবনগর সরকারের রাজস্ব বিভাগে (মোল্লার চরে অবস্থিত অস্থায়ী কার্যালয়ে) দায়িত্ব পালন করেন।

গাইবান্ধার সামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া। তিনি গাইবান্ধা ল’ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ স¤পাদক (১৯৭৯-১৯৮৬), গাইবান্ধা জেলা বার এসোসিয়েশন, গাইবান্ধা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, গাইবান্ধা শিল্পকলা একাডেমি এবং গাইবান্ধাস্থ বি.এ.ভি.এস (Bangladesh Association for Voluntary Sterilization) এর নির্বাচিত সাধারণ স¤পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি বি.এ.ভি.এস-এর সভাপতি এবং টেনিস এসোসিয়েশনের যুগ্ম-স¤পাদক ছিলেন। মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া সাঘাটা উপজেলার হামিদুন্্ নেছা বালিকা বিদ্যালয়, আরিফ রাব্বী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট এবং ফুলছড়ি উপজেলার এফ.আর. বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ অসংখ্য স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসার জন্য তিনি সাঘাটা ডায়াবেটিস সমিতি গঠন করেন।

সদা নিভৃতচারী এই রাজনীতিবিদের জীবনের বৃহৎ সময় কেটেছে রাজনীতি ও জাতীয় সংসদকে ঘিরে। পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনের সদস্য হিসেবে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। তিনি তাঁর মহৎ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ দীনেশ চন্দ্র সেন স্বর্ণপদক লাভ করেন। নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২০২২ সালের ২২শে জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। [আবু সুফিয়ান]